কলম

চা: বাঙালির জীবনে এক অপরিহার্য অংশ

চায়ের ইতিহাস: চীন থেকে বাংলার কাপে

বিজ্ঞাপন

চা, আহা, চা! এই চা শিল্পের কি কোনো তুলনা আছে? চায়ের কাপে তুফান তোলে কারা? হ্যাঁ, বাঙালিরা। চায়ের জন্ম কোথায়? বৌদ্ধ ভিক্ষুরা চিনে গিয়ে চায়ের স্বাদ পেলো। আর তাকে বানিজ্যের চেহারা দিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। স্কটিশ উদ্ভিদ বিজ্ঞানী রবার্ট ফরচুনকে ভার দেওয়া হয়েছিল, গোপনে চীন থেকে ভারতে চা গাছ নিয়ে আসতে।

চায়ের ইতিহাস

কে জানতো এ এক বিরাট শিল্পের রূপ নেবে! চায়ের উৎস চীন অথচ চায়ের কাপে তুফান তোলা বাঙালিরা জগতে একমাত্র চায়ের নেশায় “চাতাল” হতে পারে!

চা এবং সংস্কৃতি

জাপান তাদের দেশে অপরূপ চাপান উতোর চা নিয়ে চা তৈরী করা, পরিবেশন করা, চা পান করা—ওহো! এক আর্ট! তারপর দেখো, আমেরিকায় বস্টন বন্দরে চায়ের পেটি ফেলে হলো আমেরিকান বিপ্লব, কিন্তু জীবনের প্রেম, অপ্রেম, ক্ষোভ, যন্ত্রণা, তুচ্ছতা ঘৃণা কে এমন ফুটিয়ে তুললো কে? সেই বাঙালি, দুটি পাতা একটি কুঁড়ি! কে পেরেছে এমন! বাঙালির জুড়ি মেলা ভার!

বাংলা সাহিত্যে চা

বাংলা সাহিত্যের ছত্রে ছত্রে পাওয়া যায়—পরশুরাম ‘স্বয়ংবরা’ গল্পে চায়ের গুণের কথা বলেছেন। চায়ে মনের কথা খুলে যায়, বেঁফাস কথা বেরিয়ে যায়। নিরীহ বাঙালি যেন চায়েতেই মদের নেশা পায়।

বঙ্কিম চট্টোপাধ্যায় কখনো তারিফ করেননি চায়ের—সর্দি হলে আদা-নুন দিয়ে চা খেতেন। তাতেই লিখেছেন, “বন্দী আমার প্রাণেশ্বর”। আজকাল তো চা-ই এনেছে ঘরে ঘরে চা, ঘরে ঘরে প্রেম।

বিজ্ঞাপন

গ্রামীণ জীবনে চা

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় গল্পে শহুরে ছেলে গ্রামের দিদিমা, মাসিমার কাছে চা চেয়ে পেয়েছে বেলের পানা। গ্রামে সে সময় চায়ের পাট ছিল না। কোন চালাক, চতুর নারী গ্রামের একমাত্র চা-পায়ী বাড়ি থেকে চা পাতা চেয়ে এনে চা বানিয়ে অবাক করে দিয়েছে। এমন অবাক করেছিল অনঙ্গবৌ দিনু ভট্টাচার্যকে ‘অশনি সংকেত’-এ।

ছেলেকে পাঠিয়ে কাপাসীর মা শিবু ঘোষের বাড়ি থেকে চা যোগাড় বৃদ্ধের সামনে চায়ের গেলাস ধরে বলেছিল—দেখুন তো কেমন হয়েছে! এ বাড়িতে তো চায়ের চল নেই!

‘উন্নতি’ গল্পে গুড়ের চা নিয়ে অভিযোগ শুনতে হয়েছে, ওই টুকু গুড় সারা বছরের পুজো ও রান্নাবান্নার জন্য তোলা আছে, ও নিয়ে বাজে খরচ কেন! অর্থাৎ চা পাতা জোগাড় হলেও চিনি, গুড় বা দুধের জোগান কঠিন ছিলো।

চা এবং বাঙালির জীবন

এই চা কে বাঙালি জীবনের অসংযম বলেছেন জীবনানন্দ দাশ। অনটনের মধ্যেও এর টান বাঙালি কাটিয়ে উঠতে পারেনি। শুকনো করমচা গুঁড়ো জলের মতো পাতলা দুধ আর আখের গুড়ের চা হলেও হলো।

কোথাও চা-চিনি-দুধ কিনে নিয়ে যেতে হয়, গৃহস্থ শুধু উনুনের আঁচটুকু দেন, তাই সই। সুবোধ ঘোষের ‘বহুরুপী’ গল্পে আছে—উনানের আগুন তখন বেশ গনগনে হয়ে জ্বলছে। আমাদের চায়ের জন্য এক হাঁড়ি ফুটন্ত জল নামিয়েই হরিদা ভাতের হাঁড়ি উনানে চাপালেন।

বিজ্ঞাপন

এই ছোট্ট ঘর-ই হরিদার ঘর, আর আমাদের চার জনের সকাল-সন্ধ্যের আড্ডার ঘর। চা চিনি আর দুধ আমরাই নিয়ে আসি। হরিদা শুধু তাঁর উনানের আগুনে আমাদের জল ফুটিয়ে দেন।

চায়ের নেশা ধরানোর কথা

চায়ের নেশা ধরানোর কথা আছে ‘মনীন্দ্র গুপ্তর অক্ষয় মালবেরি’ তে। হাটে খানিকটা জায়গা নিয়ে চায়ের পাতা, দুধ আখের গুড় পাঁচনের মতো জ্বাল দেওয়া হতো লোককে ডেকে ডেকে বিনিপয়সায় চা খাওয়ানো। সারা দিনই চা সিদ্ধ হচ্ছে, একই লোক কতবার এসে খেতো। লোকে যত চা খেতো টি-বোর্ডের ভদ্রলোক ততো খুশী হতেন।

চায়ের দোকান

হাটে চা বিক্রি হওয়ার গল্প বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘মড়িঘাটের মেলা’ গল্পে চমৎকার এঁকেছেন। ততো দিনে চায়ের নেশা লেগে গেছে আর বিনি পয়সায় চা নয় পয়সা দিয়ে কিনে খেতে হবে। পাঁড়াগাঁয়ে চায়ের দোকানে যারা এসেছে বাপের জন্মে চা দেখে নি।

মা নিজে খাচ্ছে, ছেলেকেও প্ররোচিত করছে চা খেতে। অনিচ্ছুক ছেলেকে বলছেন—মুখের কাছে ভাঁর তুলে বলছেন—এ রে বলে চা… ভারী মিষ্টি… দেখ খেয়ে… খেলে জ্বর আসবে না। আ মোলো যা… ছেলে রকম দেখো… চার পয়সা দিয়ে কিনে আমি এখন ফেলে দেব কনে! মুই তো দুই ভাঁর খ্যালাম, দেখলি নে?

চা এবং নারীরা

মেয়েদের চা খাওয়ার চল বা অনুমতি দেরিতে এসেছে। অনেক দিন পর্যন্ত বিলিতি চিনির মতো বিলিতি চা খাওয়া মানা ছিলো মেয়েদের। মনে পড়ে ঋতুপর্ন ঘোষের ‘চোখের বালি’ সিনেমায় রাজলক্ষীর চা খাওয়ার দৃশ্য।

বিজ্ঞাপন

আমিও আমাদের ছোটবেলায় এই দিন পার করেছি। বহুদিন চা খাওয়ার চল হয়নি বাড়ীতে। মনে আছে অন্ধকার হয়ে সন্ধ্যে নামলে বাবা যখন অফিস হতে ফিরতেন বাড়ী, তখন মা বানাতেন বাবা ও নিজের জন্য চা। আমরা করুণ দৃষ্টিপাতে বসে থাকতাম। মানে পুরুষতন্ত্র চায়ের ওপর কেমন থাবা বসিয়ে ছিলো খেয়াল করো। পরে ধীরে ধীরে পেয়েছিলাম অনুমতি চা পান এর। এটাও ধীরে ধীরে প্রচলন হল যে উপোসে চা চলে।

ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা

দিদাই বলতে থাকতেন কতবার—মাঠে খেলা হয়ে যায় নাকি অনুমতি পেয়ে যায়, তখন চা আর না দেখা যায় মায়ের কাছে।

চা মানে কথাটি কিন্তু বাসার অধ্যায় বিচিত্র মিলনস্থল, তৃণমূল, রবীন্দ্রনাথের বাংলা, কাজী নজরুল ইসলামের আসল বাংলা, অনিচ্ছুক ছেলেদের খাওয়া বিশেষ অভিজ্ঞতা।

‘চা আর না কপিতে সকলের বাঁচা যায় না’ এই কথাটি মনে থাকে আমার। আমরা বিবাহিত জীবন যাচ্ছি সেই আগুনের পাশে দিক পরিবর্তন আনা। আমার জীবনে যারা চা খাওয়ার সময় মিলেছেন তাদের সবার জন্য আমার মনের গভীর শ্রদ্ধা।

চায়ের সামাজিক প্রভাব

চা শুধু একটি পানীয় নয়, এটি বাঙালির জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। চায়ের কাপে তুফান তোলা থেকে শুরু করে চায়ের আড্ডা, সবকিছুই বাঙালির জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। চা নিয়ে বাঙালির এই ভালোবাসা এবং আবেগ চিরকাল অটুট থাকবে।

বিজ্ঞাপন

ছবি: Image by zirconicusso on Freepik


Discover more from অভিযাত্রী

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন

শ্রীমতী স্মৃতি দত্ত

অ্যাডভোকেট, লেখিকা, বঙ্গীয় সাহিত্যের সদস্য, কীবোর্ড প্লেয়ার, অ্যামওয়ে ব্যবসার মালিক। আমার লেখা সর্বশেষ বইয়ের নাম, ‘কেমেষ্ট্রি প্র্যাকটিক্যাল ও টি.ভি শো’ এবং ‘লেনিন সাহেবের সাথে দেখা’ বইটি Flipkart -এ নেবার জন্য ক্লিক করুন: https://www.flipkart.com/lenin-saheber-sathe-dekha/p/itmc9bfae4c39392

Related Articles

Leave a Reply

বিজ্ঞাপন
Back to top button

Discover more from অভিযাত্রী

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading