পিয়ন থেকে প্রকাশক হয়ে ওঠা লেখক বাদল বসু বলেছিলেন তাঁর জীবনের এক বিশেষ মাইল ফলক শরৎ রচনাবলী প্রকাশ। আজকে চেতন ভগত এর বইয়ের ধুন্ধুমার বিক্রি দেখে হতবাক বাঙালি ভুলে গেছে এক সময় শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর বইয়ের বিক্রি কেমন ছিল!
সে ১৯৮৫ সালের কথা। শরৎচন্দ্রর বইয়ের কপিরাইট শেষ হতে আর তিন বছর বাকি। বাদল বসু বলছেন, তাঁর হাতে একটা লিফলেট এলো, শরৎচন্দ্র এর বইয়ের গ্রন্থস্বত্ব যাদের হাতে রয়েছে, সেই এম.সি সরকার বিজ্ঞাপন দিয়েছে, তেরো খন্ডের রচনাবলী তারা চার খন্ডে বিক্রি করবে।
লিফলেট নাড়াচাড়া করতে করতে মনে হলো, রচনাবলী দু’খন্ডে বের করলে কেমন হয়! তাতো দাম কম হবে, বিক্রিও হবে প্রচুর। সেই আমলে শরৎ রচনাবলীর দাম ছিলো সাড়ে চারশো টাকার মতো। কথাটি কর্তৃপক্ষের কানে তোলা হলো। এবং তৎক্ষণাৎ সবুজ সংকেত পাওয়া গেলো।
কিন্তু শরৎচন্দ্রর গ্রন্থস্বত্ব তো তাঁদের অর্থাৎ ‘আনন্দ’র হাতে নেই। যোগাযোগ করা হলো এম.সি সরকার এর সঙ্গে। তারা কপিরাইট ফি বাবদ এক কালীন চল্লিশ লক্ষ টাকা চেয়ে বসলো। আটের দশকের মাঝামাঝি সেটা বিরাট অংকের টাকা।
ইংরেজি বইয়ের বড় বড় প্রকাশক রাও অতো টাকা খরচ করার আগে একশো বার ভাবতো। ‘আনন্দ’ তো নিছক বাংলা বইয়ের প্রকাশক। যাদের সীমিত পরিধিতে বই বিক্রি করতে হয়। তবু রাজী হয়ে কাজে এগুনো গেলো।
এরপর বইয়ের কপিরাইট হাতে এলো। যার মেয়াদ মাত্র তিন বছর। ওই সময়ের মধ্যে যদি টাকা তোলা না যায় তা হলে আর কিছু করার থাকবে না। কারণ কপিরাইট উঠে গেলো তো যে কেউ শরৎচন্দ্র’র বই প্রকাশ করতে পারবেন।
এতো বড়ো কাজ হাতে নেবার পর তো টেকা দায় হলো। আনন্দবাজারে গেলেই টিটকিরি শুনতে হতো, “কি মশাই! আনন্দ পাবলিসার্স কি তুলে দিলেন?”
বাদল বসু বলেছেন, সব টিটকিরি দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে বই বিক্রির পরিকল্পনা করা হতে লাগলো। সোজা যাওয়া হলো ইউনাইটেড ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়ার হেড অফিসে। ওই ব্যাংকের একশো দশটি শাখা ছিলো সারা ভারতে। ‘আনন্দ’ থেকে প্রস্তাব দেওয়া হলো শরৎরচনাবলীর গ্রাহক ইউবির মাধ্যমেই করা হবে। বইটি এক এবং দু’খন্ডে বিক্রি করা হবে এক খন্ড নিলে ৯০ টাকা, দু’খন্ডে নিলে ১০০ টাকা।
জানালো হলো, আনন্দ পাবলিশার্স অ্যাকাউন্ট খুলবে একটি-ই শর্তে। শরৎ রচনাবলীর গ্রাহক যাঁরা হতে চাইবেন তাঁরা টাকা জমা দেবেন ইউবিআইর অ্যাকাউন্টে আর বইটিও দেওয়া হবে ওই ব্যাংকের মাধ্যমে। গ্রাহক দের জন্য আনন্দ বিভিন্ন শাখায় বই পাঠিয়ে দেবে।
ইউবিআই সম্মত হলো আনন্দর এই প্রস্তাবে। একদিক সামলে এইবার বইয়ের কাজ শুরু করা হলো জানচ্ছেন বাদল বসু। কাগজ কেনা হলো ধারে বাঁধাই ও তাই। বইটি ছাপা হলো আনন্দবাজারের ছাপাখানায়।
ওদিকে পঞ্চাশ হাজার মানুষ ততোদিনে শরৎ রচনাবলীর গ্রাহক হয়ে গিয়েছেন। প্রথম সংস্ক্ররণ বিক্রি হয়ে যাওয়ার পর আরও পঞ্চাশ হাজার গ্রাহক হয়েছিলো। ‘শরৎ সাহিত্য সমগ্র’ নামে প্রকাশিত আনন্দ এর বইটি সম্পাদনা করেছিলেন সুকুমার সেন।
ফলে বইটির সম্পাদনা নিয়েও আর কারও কিছু বলার থাকলো না। শরৎ রচনাবলীর কপিরাইট এতো দাম দিয়ে কেনা এবং এ ভাবে বিক্রি করার ফলে তা এমন সাড়া ফেলেছিলো যে, ‘ইন্ডিয়া টুডে’, ‘পাবলিশার্স টুডে’র মতো পত্রিকা এটা নিয়ে বড়ো স্টোরি করেছিলো। কলকাতার বই পাড়ার খবরটি সারা দেশের গ্রন্থ ব্যবসায়ীদের হতভম্ব করে দিয়েছিলো তারা গালে হাত দিয়ে ভাবতো, বাংলা বইয়ের এতো বিক্রি!
এরপরে বাদল বসু একটি প্রশ্ন করেছেন, বলেছেন, তাঁকে যদি জিজ্ঞাসা করা হয় কি ভাবে এটা সম্ভব হল!.তিনি বলবেন, এটা দু’জনের জন্য সম্ভব হয়েছে। প্রথম জন অবশ্যই স্বয়ং শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় যাঁর মৃত্যুর ৪৭ বছর পরও সেই মানুষের লেখা নিয়ে এতো বড়ো ব্যবসা করা যায়, তিনি যে নমস্য!
আর ‘আনন্দ পাবলিশার্স’ কর্তৃপক্ষ। চল্লিশ লক্ষ টাকার ঝুঁকি যদি না নেওয়া যেতো তা হলে এতো বড়ো ব্যবসা করা সম্ভব হতো না। হতে পারতো সব টাকা জলে গেলো। আনন্দ পাবলিশার্স কিন্তু সেই ভয়ে পিছিয়ে আসে নি।
Discover more from অভিযাত্রী
Subscribe to get the latest posts sent to your email.