অখণ্ড বাংলা: ক্ষতিগ্রস্ত স্বপ্ন, অপূর্ণ ইচ্ছা, এবং কী কী হতে পারত?
কাল্পনিক এক বাংলার সম্ভাব্যতা
Disclaimer: In this article, I have expressed my personal opinions and thoughts. The information and analyses presented here are from historical and theoretical perspectives and may not be entirely accurate or precise. The purpose of the article is solely to provide food for thought and encourage discussion among readers. None of the information or opinions mentioned here should be taken as absolute truth. Readers are requested to make their own research and analysis before making any decisions.
বাংলা ভাগ না হলে কি হত? বাংলা ভাগ কি বাঙালী জাতীয়তাবাদের জন্য আশীর্বাদ নাকি অভিশাপ? এই প্রসঙ্গে নিরপেক্ষ কিছু লেখা প্রায় অসম্ভব। কিন্তু কিছু ভালো সম্ভাবনার কথা আলোচনার টেবিলে রাখা যেতে পারে। এই সমস্ত সম্ভাবনা আমাদের চিন্তার খোরাক জোগাতে পারে।
প্রথমত, বাংলা ভাগ শুধুমাত্র ধর্মীয় বিভাজনে ঘটে নাই। বাংলা ভাগের বহু কারণের মধ্যে ধর্মীয় পার্থক্য তলানিতে পড়ে যাওয়া একটি বিষয়। আমার মতে, বাংলা ভাগ প্রধানত ঘটেছে আর্থিক বৈষম্যের কারণে। দ্বিতীয়ত, বাংলা ভাগ শুধুমাত্র পশ্চিম বা পূর্ব বাংলার সংকট নয়, বরং এই সংকট পুরো বাঙালীদের জন্য অনেক বড় একটি সংকট এবং বিশাল একটি চ্যালেঞ্জ। তৃতীয়ত, বাঙালীরা একসাথে থাকলে এদের মধ্যে প্রচুর সম্ভাবনা দেখা যেতে পারতো। এমনকি বাংলা হয়ে উঠতে পারতো একটি সুপার পাওয়ার।
কলকাতা, যেখানে পূর্ব বাংলা (বর্তমান বাংলাদেশ) থেকে অনেক লোক ব্যবসা ও বাণিজ্যের জন্য যাতায়াত করতেন। এতে পশ্চিম বাংলার অর্থনৈতিক অবস্থা চাঙ্গা থাকতো। অন্যদিকে, স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের ঢাকাকেন্দ্রিক জীবন অনেক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে বা হচ্ছে। কিন্তু বাংলা ভাগ না হলে আমরা অন্তত দুটি প্রধান শহর পেতাম, যা আমাদের জীবনে শহর বা রাজধানীর অবস্থান বিকেন্দ্রীকরণে সহায়ক হত।
গণতন্ত্র
বাংলা ভাগ না হলে হিন্দুদের জন্য কিছুটা হলেও সমস্যা হত। কারণ পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রাদায়ের অনুপাত হত যথাক্রমে ৩১.১℅ শতাংশ এবং ৬৫.৫℅ শতাংশ। এতে করে মুসলিম প্রধান দেশ হলেও বিরোধী হিসেবে বিবেচনায় আমাদের হাতে বড় একটি সংখ্যা বিরোধীদলে থাকতো।
আর গণতন্ত্রে বিরোধীদল থাকা খুব গুরুত্বপূর্ণ। যে কোনো স্বৈরতান্ত্রিক শাসকের বিরুদ্ধে জনতার সামান্য একতা থাকলেও টেকসই গণতান্ত্রিক দেশ হতে পারতো। ফলে কোন শাসক বা প্রধানমন্ত্রী স্বৈরতান্ত্রিক হবার সাহস পর্যন্ত রাখতে পারতেন না। না ধর্মীয় বিভাজনে আমাদের মধ্যে বৈষম্য তৈরি করতে পারতেন।
যদি আমরা যথাযথ সংবিধানের মাধ্যমে হিন্দুদের জন্য নির্দিষ্ট সিট প্রয়োজনে যুক্ত করতে পারতাম তাহলে কখনো কখনো প্রধানমন্ত্রী বা প্রেসিডেন্টও একজন হিন্দু ধর্মের থাকতো। নূন্যতম বেশ কিছু হিন্দু ধর্মের মন্ত্রী থাকতো। যেটা কিনা বর্তমান ভারতে সম্ভব হচ্ছে না।
সুন্দরবন
পূর্ব ও পশ্চিম একত্রে থাকলে সুন্দরবনের মোট আয়তন দাঁড়াতো ১০,০০০ বর্গকিলোমিটার। শুধুমাত্র সুন্দরবন কে একত্রিত প্রশাসন দিয়ে বিশ্বের অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র তৈরি করা যেত। খাবারের জন্য প্রয়োজনীয় মাছ, মধু, কাঠের প্রাচুর্যে ভরপুর থাকতো। এছাড়াও বন সংরক্ষণে একত্রিত প্রশাসন দ্বিগুণ কাজ করতে পারতো ফলে রয়েল বেঙ্গল টাইগার সংকটে উভয় ভাগ কে আজ এভাবে পড়তে হতো না।
সিলেট
সিলেট বিভাগের মোট আয়তন প্রায় ১২,৫৯৬ বর্গকিলোমিটার। এবং আসাম রাজ্যের মোট আয়তন প্রায় ৭৮,৪৩৮ বর্গকিলোমিটার। যদি সিলেট ও আসাম একত্রে থাকত, তাহলে তাদের সম্মিলিত আয়তন হত ৯১,০৩৪ বর্গকিলোমিটার। এক্ষেত্রে প্রধান যে সুবিধা পাওয়া যেত সেটা হলো, পর্যটনশিল্পের বিকাশ। যদিও বর্তমান বাংলাদেশের সিলেট বিভাগ অত্যন্ত ভালো অবস্থানে আছে কিন্তু এখানে যে বিভাজন দেখা যায় তা খুবই স্পষ্ট বা ঘা দেয়।
কিন্তু একত্রিত প্রশাসন থাকলে সেসব নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখা যেত। দার্জিলিং, কক্সবাজার, সেন্টমার্টিন, কুয়াকাটা সহ এই একাধিক পর্যটন কেন্দ্র থেকে বড় অঙ্কের বিদেশী পর্যটকদের টাকায় আমাদের আর্থিক সংকট অনেকখানি সামলিয়ে উঠা যেত।
ভারত ও চীন কে কড়া টক্কর
বাংলা ভাগ না হলে জিডিপি ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে ভারত ও চীন কে কড়া টক্কর দিতে পারতো বাংলা। হোক সেটা যেকোনো শিল্পবিপ্লব সম্পর্কিত কিছু, বাংলা সবসময় এক ধাপ এগিয়ে থাকতো। ১৯৪৭ সাল থেকে একটি সক্রিয় ধারা বিবেচনায় বাংলা হতে পারতো ভারত ও চীনের চেয়ে যে কোন দিক দিয়ে শক্তিশালী। শুধু তাই নয়, এই উপমহাদেশে ইউরোপীয়, আমেরিকান ও রাশা শক্তি কিছু করার পূর্বে বাংলা ছেড়ে কথা বলতে পারতো না।
বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের সম্মিলিত সেনাবাহিনী
১. বাংলাদেশ সেনাবাহিনী: ১,৬০,০০০ সৈন্য
২. পশ্চিমবঙ্গ সেনাবাহিনী (সমান পরিমাণে ধরা হয়েছে): ১,৬০,০০০ সৈন্য
মোট: ১,৬০,০০০ + ১,৬০,০০০ = ৩,২০,০০০ সৈন্য
তুলনা:
ভারত: ১৪,৪৪,০০০ সৈন্য
চীন: ২১,২৩,০০০ সৈন্য
বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ: ৩,২০,০০০ সৈন্য
কিন্তু এই সংখ্যা মোটেই কম নয়। এখন যদি ১৯৪৭ সালে বাংলা ভাগ না হত তাহলে পূর্ব ও পশ্চিম বাংলার সৈন্য ৫ লাখের কম তো হত না! এতে করে পাকিস্তান, ভারত ও চীন তাদের ইচ্ছে মোতাবেক বাংলাকে শাসন করতে পারতো না। আর যেহেতু স্পেশ্যাল ফোর্সের সংখ্যাও দ্বিগুণ থাকতো তাহলে মায়ানমারের বর্তমান সেন্টমার্টিন আক্রমণ কে খেলা দেখানো যেত।
বাংলা ভাষা
প্রায় ৩০ কোটি মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলেন। অসমীয়া ভাষা যুক্ত করলে ৩৫ কোটি হয়। প্রায় ৬১.৫ কোটি মানুষ হিন্দি ভাষায় কথা বলেন। অন্যদিকে প্রায় ৯৪ কোটি মানুষের মাতৃভাষা মান্দারিন। যদি দুই বাংলা একত্রে থাকতো তাহলে পুঁজিবাদী সমাজ সমস্ত জায়গায় এই বিশাল বাংলা ভাষাভাষী কে সন্তুষ্ট করতে বাংলা ভাষা তাদের প্লাটফর্মে রাখতে বাধ্য হতেন। কারণ বাজার হত বিশাল বড়। এছাড়াও সোশ্যাল মিডিয়ায় বাঙালীদের বিশাল প্রভাব বিবেচনায় বাঙালী জাতি হিসেবে আমাদের ভাষা কে এত ছোট করে কেউ দেখতে পারতো না।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ও মান
পূর্ব ও পশ্চিম বাংলা মিলে বর্তমান পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৩৫টি এবং প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ১১৯টি। ১৯৪৭ এর দেশভাগ না ঘটলে এবং একটি সক্রিয় ও সুন্দর প্রশাসন থাকলে এই সংখ্যা হত দ্বিগুণেরও বেশি। এবং মানের দিক থেকে ভারত ও পাকিস্তানের একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়কে অনেক আগেই টক্কর দিতে পারতো।
বাংলা চালাতো বর্তমানের গুগল, মাইক্রোসফট বা ফেসবুক। কারণ মুসলিমরা দীর্ঘসময় বা এখনো শিক্ষায় পিছিয়ে থাকায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা কে চাঙ্গা না করে হিন্দু ও মুসলিম সমন্বয়ে আমাদের জ্ঞানীয় বিকাশ ব্যাপকভাবে ঘটতে পারতো।
বেকার সমস্যার সমাধান
ভালো ম্যানেজমেন্ট এবং শিল্পায়ন ব্যাপকভাবে প্রসারিত করা গেলে বাংলা তার পূর্বের গর্ব নিশ্চিত অর্থে ফিরে পেত। ফলে দুই বাংলার অসীম বেকার সমস্যা আজ হয়তো থাকতো না।
রোহিঙ্গা সমস্যা ও ধর্মীয় মৌলবাদ
বাংলা একত্রে থাকলে রোহিঙ্গা সমস্যা কখনো হত-ই না। কারণ তখন আমাদের বিশাল নিরাপত্তা শক্তি থাকতো। একইসাথে দুই বাংলা একত্রে থাকার সাথে সাথে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে একটি সহনশীল জাতি হিসেবে বিশ্বে আমাদের পরিচয় মিলতো।
হিন্দু ও মুসলিম সহাবস্থানের সুবিধা
কূটনৈতিক ভাবে যদি সেনাবাহিনী থেকে নিরাপত্তা কর্মীর অনুপাত হিন্দু ও মুসলিম ১:১ করা যেত তাহলে মুসলিম বিশ্ব আমাদেরকে ইগনোর করার সাহস করতো না। একইসাথে ভারতও আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কথা বলার সাহস পেত না। প্লাস, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ও অন্যান্য ধর্ম (নাস্তিক সহ) মানুষদের নিরাপত্তা দিতে পারলে চীনের কথা বলতে পারছি না কিন্তু বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান ধর্মের জন্যও বিভিন্ন দেশের আগ্রহ থাকতো বাংলায়।
বাংলা ও বঙ্গোপসাগর
বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চল প্রায় ৭১০ কিলোমিটার দীর্ঘ। পশ্চিমবঙ্গের উপকূলীয় অঞ্চল প্রায় ১৫৭ কিলোমিটার দীর্ঘ। এভাবে, একত্রিত বাংলার মোট উপকূলীয় অঞ্চল হতো প্রায় ৮৬৭ কিলোমিটার। তবুও বঙ্গোপসাগরে ভারতের সবচেয়ে বেশি জায়গা থাকতো কিন্তু আমাদের কম থাকতো না। আর এই উপকূলীয় অঞ্চল কেন গুরুত্বপূর্ণ সেটা আমরা অনেকেই জানি এবং বাংলার সাথে তাল মিলিয়ে চলতে ভারত বাধ্য হত।
মুদ্রাস্ফীতি থেকে মুক্তি
দুই বাংলা একত্রে থাকলে টাকার মান ডলারের সাথে তাল মিলিয়ে হয়তো চলতে পারতো।
সাহিত্য ও শিল্প
সাহিত্য ও শিল্পে বাংলা হত উপমহাদেশের প্রধান শক্তি। এমনকি এর প্রভাব ছড়িয়ে পড়তে পারতো বিদেশে ব্যাপকভাবে, যা এখন হঠাৎ কোন পত্রিকায় শেষের পাতায় দেখা যায় তাও বিভক্ত বাংলায়।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
টেকনোলজির ক্ষেত্রে উপমহাদেশে বাংলার থাকতে পারতো নিজস্ব মিডিয়া। তৈরি হতে পারতো একাধিক উন্নত যন্ত্র।
চিকিৎসা ও যোগাযোগ
দুই বাংলা একত্রে থাকলে সেখানে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো সহ একাধিক হাসপাতাল ও ক্লিনিক তৈরি করা যেতে পারতো। এতে করে কাউকেই বড় বড় সমস্যার জন্য সিঙ্গাপুর অবধি দৌড়ানো লাগতো না। বাংলার সাথে তখন ভারত, নেপাল, ভূটান, মায়ানমার এর যোগাযোগ আরো শক্ত হত এবং ব্যবসা ও বাণিজ্যে আমরা অনেক এগিয়ে যেতে পারতাম।
পয়েন্ট হচ্ছে, যা কিছুই ভাগ করা হয় তা শক্ত বলেই ভাগ করা হয়। যা নাজুক, যা দূর্বল, যা ভিতহীন তাকে নতুন করে ভাগ করার কি আছে? আমাদের বড় বড় নেতারা বড় বড় রাজনীতি করেছেন। ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ করেছেন বলে ন্যারেটিভও তৈরি করেছেন। আমি স্বীকার করছি, দুই বাংলা ভাগের জন্য ধর্মীয় বিদ্বেষ একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করেছে কিন্তু এটাও করেছে ব্রিটিশরা, ডিভাইড এন্ড রুল পলিসি দিয়ে।
১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর মার্কিন রাষ্ট্রদূত ইউ এলেক্সিস জনসন প্রথমবার বাংলাদেশ প্রসঙ্গে ‘বাস্কেট কেস’ শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন। যার সঙ্গে সুর মিলিয়েছিলেন হেনরি কিসিঞ্জার। কারণ দেশভাগের সময় তো আর বাংলা ভাগ হয় নাই। ভাগ হয়েছে ভারত ও পাকিস্তান। আর পাকিস্তান কে ঐ সব জায়গা দেওয়া হয়েছিলো যা ভারতের কাছেও দামী জায়গা বলে মনে হয় নাই।
কিন্তু বাংলা নিয়ে যেসব নেতারা ভেবেছেন তাদের তো কোন গুরুত্বই দেওয়া হয় নাই। তাই ঐ সব নেতাদের ফেরেশতা/দেবতা/দেবী আর ভাবতে রাজী নই। কারণ বাঙালী ভারতীয় নয়, আর আপনাদের সিদ্ধান্ত আমাদেরকে চরমভাবে ভোগান্তির মুখে ফেলে দিয়েছে। মনে রাখবেন, বাঙালীরা ভারতীয় নয় আবার পাকিস্তানিও নয়!
কিন্তু এই সর্বনাশ আমরাই আমাদের করেছি। বাংলা হতে পারতো সুপার পাওয়ার কিন্তু আমরা হয়েছি অন্যদের গোলাম। আমাদের মধ্যে থাকা গোঁড়ামি সার্থকতা পেয়েছে। কিন্তু আজ দুই বাংলার বহু বুদ্ধিজীবী সেটা টের পেলেও কাঁটাতারের বেড়া আর কোনদিন ভাঙ্গতে পারবেন না।
বন্ধু অনীক কুমার ঘোষের চিন্তা এবং আমার ফ্যান্টাসি প্রবন্ধ এখানেই শেষ করছি গোপালকৃষ্ণ গোখলের কথা দিয়ে, “বাঙালী আজ যা ভাবে, ভারত তা ভাবে আগামীকাল।”
Discover more from অভিযাত্রী
Subscribe to get the latest posts sent to your email.