বব ডিলান কি সাহিত্যিক! কবি! না কি সঙ্গীত রচয়িতা! কিংবা গায়ক! তাঁকে কেন সাহিত্য সম্মান! ডিলান কে ঘিরে নানাবিধ প্রশ্ন ও উত্তরও বহুধাবিভক্ত। কিন্তু ডিলান কে অস্বীকার কেউ করছে না। এখানে এই গায়কদের নামোল্লেখ প্রয়োজন যাঁদের ভারত ও বঙ্গ এই সঙ্গীত শিল্পীগণ অপরিচিত নন।
শব্দ তরঙ্গ শুনে এগিয়ে যান বাবা। দেখেন তাঁর কিশোর, ছেলের লং প্লেয়িং রেকর্ডে বাজছে,
“For Between Sundowns Finish an Midnight’s Broken Toll…”
এ গান সেই বিখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ ব্রুস স্প্রিংস্টিন এর মনে পড়ে যায় তাঁর ছেলেবেলার গান। তিনি নির্জন ঘরে বিছানায় শুয়ে এই গান শুনতেন। সন্তানের পাশে বসে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কেমন লাগছে?’ নিষ্পাপ কিশোর সারল্যে বলে, ‘এপিক’।
যাঁকে ঘিরে এই প্রশ্নোত্তর, তিনি তো চর্চিত ব্যক্তি বব ডিলান। ২০১৬ সালে সাহিত্যে ‘নোবেল’ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর ভক্ত ও অ-ভক্তর আগ্রহী ও অনাগ্রহী উন্মাদনার বিষয় হয়ে উঠেছেন তিনি।
বব ডিলান কি সাহিত্যিক! কবি! না কি সঙ্গীত রচয়িতা! কিংবা গায়ক! তাঁকে কেন সাহিত্য সম্মান! ডিলান কে ঘিরে নানাবিধ প্রশ্ন ও উত্তরও বহুধাবিভক্ত। কিন্তু ডিলান কে অস্বীকার কেউ করছে না। এখানে এই গায়কদের নামোল্লেখ প্রয়োজন যাঁদের ভারত ও বঙ্গ এই সঙ্গীত শিল্পীগণ অপরিচিত নন।
তাঁরা এলভিস প্রেসলে, জন লেনন, জিম মরিসন, পল সাইমন, এরিক ক্ল্যাপটন, জোন বাজেজ, রজার্স ওয়াটার্স, জিমি পেজ, ও এমন অনেক সঙ্গীত শিল্পী। শুরুতে ঐ কিশোরের পিতা ব্রুস স্প্রিংস্টিন অনেক শ্রোতার কাছে ‘The Boss’। ডিলানের চেয়ে বছর আটের ছোট তিনি। ডিলানের জন্ম ১৯৪১ স্প্রিংস্ট্রনের ২৯৪৯ -এ।
তাঁর পরিচয় সৎ, শান্তিকামী, মানবিকতাবাদী আমেরিকাবাসী হিসেবে গোছানো। বব ডিলান তাঁর সহশিল্পীদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হলেও কেউ কেউ তাঁর মন্তব্যকে কোন সময় বক্রোক্তি বলে ধরে নিয়েছেন।
বব ডিলান উল্লিখিত শিল্পীদের সঙ্গে থেকেও অন্য এক ধাপে দাঁড়িয়ে! তাঁর সমকালকে শুনতে চাইলে আসবে… ডেভ ভ্যান রংক। পাঁচের/ছয়ের দশক থেকে দাপুটে ভয়েস, প্রাণখোলা অট্টহাস্য দুর্দান্ত গীটার স্ট্রামিং এ এক বিশেষ শ্রেণীর শ্রোতাকে মুগ্ধ করে রেখেছিলেন। ডিলান ও ভ্যান একই ঐতিহ্যের শরিক।
শুরুতে উল্লিখিত ব্রুস স্প্রিংস্টিনের কিশোর পুত্র ‘Chimes of Freedom’ গানটি শুনছিলো, যেটি ১৯৬৪ সালে ‘এনাদার সাইড অব’ বব ডিলানের অ্যালবামে প্রকাশিত। ডেভ ভ্যান রংক বরাবর বব ডিলানের প্রতি স্নেহ প্রবণ। ববকে তিনি প্রথম দর্শণ ও শ্রবণে কতটা বুঝতে সক্ষম হয়েছিলেন, বলেছেন।
নিউ ইয়র্কে ডিলানের প্রথমদিকের লড়াইয়ের কথা, ক্লাবে, পাবে, কাফেতে ডিলানের হারমেোনিকা বাজানো ও গান গাওয়া সামান্য ক’টা টাকার জন্য। আবার তাঁর স্নেহের ববি কখনো-সখনো স্লাইট মিথ্যে কথা বলেন, তা- ও বলেন তিনি।
ডিলানও ডেভ সম্পর্কে শ্রদ্ধাশীল, উদার। কিন্তু তাঁর গুরু উডি গাথরি। অথচ কিছু বছরের সিনিয়র ডেভ এর কাছ ঘেকেও বব বহু কিছু শিখেছিলেন। আত্মজীবনী ‘ক্রনিকলস্’ এ ডিলান লিখেছেন কীভাবে ‘প্যাশনেট’ ভ্যান রংক অনায়াসে কণ্ঠস্বরকে নানা ভাবে ব্যবহার করতেন কীভাবে ‘ব্লুজ’ ও ‘ব্যলাডস’ এর সীমারেখা ভাঙতেন। লিখেছেন,
“I loved his style. He was what the city was all about. In Greenwich Village, Van Ronk was king of the street, he reigned supreme.”
ডিলানের উচ্চারণে উঠে এলো যে স্থান নাম সেটি একশো বছর আগে থেকে শিল্পীদের বিচরণ ভূমি, তাঁদের স্বর্গ, তাঁদের ‘Free and Independent Republic’, যেখানে মত প্রকাশের অবাধ স্বাধীনতা, যেখানে নতুনের নির্ভয় জয়গান। ছয়ের দশকেই গ্রিনিচ ভিলেজ সেই বিন্দু এক চরম উৎকর্ষতা ছুঁয়েছিল ‘গ্রাম’ এ কবিতা, চিত্রকলা, নাটক, আর অবশ্যি সঙ্গীত।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সেখানে সব ‘শিল্পিত’। এই জীবন ধারার খোঁজ সেই ছয়ের দশকে আমাদের দিয়েছিলেন বাংলা ভাষার অন্যতম কথা সাহিত্যিক বুদ্ধদেব বসু তাঁর ‘বীটবংশ ও গ্রিনিচ গ্রাম (১৯৬১) প্রবন্ধে।
জীবন এখানে প্রথামুক্ত, আচরণ স্বাধীন, বেশবাস আলুথালু, শ্বেত-কৃষ্ণ বা ধনী-দরিদ্র ভেদ নেই, এখানে ছত্রিশ জাত একসঙ্গে কালো কফি ভডকা পান করতে পারে, আর ঘড়িতে রাত এলিয়ে পড়লেও কাফের দরজা বন্ধ হয়ে যায় না।
আর বব ডিলানের চোখে,
Down in the Village nothing seemed wrong.Life was not complex.Everybody was looking for openings.
এমনই এক ‘কালচার’ এর সন্তান ডেভ ভ্যান রংক। তিনি এক দায়বদ্ধতা বহন করেছেন চিরকাল। সঙ্গীতের প্রতিধারার প্রতি – জ্যাজ, ব্লুজ, নিগ্রো স্পিরিচুয়াল, ফোক। তিনি রাস্তার লোকের কাছ থেকে তুলে নিতেন অশ্রুত সুর, কথা। তানাহলে আমরা পেতাম না ‘ডাংকান এন্ড ব্রাডি’, ‘ব্ল্যাক মাউন্টেন ব্লুজ’, ‘টুয়েলভ গেটস টু দ্য সিটি’, ‘ডিংকনস সং’। ‘দ্য হাউস ওব দ্য রাইজিং সান’ গানটি নিয়ে বিবাদ বাধলেও তা মিটে গিয়েছিলো।
ভ্যান রংক ডিলানের রাজনীতি পাঠেরও গুরু স্থানীয়। তাঁর মার্কসবাদীয় দৃষ্টিভঙ্গির কথা ডিলান স্মরণ করেন নিজ আত্মজীবনীতে। আর লিখে যান তাঁর প্রাণময়তার কথ। ডিলান গান লিখতে শুরু করেন পাঁচের দশকে, তখন তাঁর মূল অনুপ্রেরক ছিলেন উডি গাথরি। অবশ্য কিশোর রবার্ট জিমার ম্যান (ডিলানের আসল নাম)।
গভীর ভাবে আকৃষ্ট হয়ে পড়েছিলেন ‘রক এন্ড রোল’, ‘ব্লুজ’, ‘এলভিস প্রেসলি’, ‘লিটল রিচার্ড’, ‘হ্যাংক উইলিয়াম’, ‘জনি ক্যাশ ও মাডি ওয়াটার্স’ এ। কিন্তু আমেরিকা জুড়ে চারের দশক জুড়ে অন্যধারার গান শুরু হয়ে গিয়েছে সেই অন্য ধারার গানের পরিবেশ গড়ে তুলেছেন উডি গাথরি, পিট সিগার, সিস ক্যানিংহ্যাম, বেস হস, আর্থার স্টার্ন। সবাই মিলে গড়ে তুলেছেন- দি অলম্যানাক সিঙ্গার্স।
একের পর এক প্রতিবাদের গান লেখা। দুধ বিক্রেতারা কেন কেন তাঁদের ন্যায্য মূল্য পাচ্ছেন না, এমন বিষয়ও। সঙ্ঘবদ্ধ হবার গান। সাধারণ মানুষের জন্য সহজ সরল ভাষা, ছন্দে নির্মিত সে সঙ্গীত-সুর অনেক সময় কোনও লোকগান থেকে।
রাজনৈতিক দিক থেকে এঁরা কোন দিকে ঝুঁকেছিলেন সে প্রশ্নের উত্তর আজ সকলের জানা।
“Which Side Are You On?”
এর উত্তর দিতে এঁদের দ্বিধা বোধ ছিল না। ১৯৪৬ সালে পিট সিগার, লি-হেসরা মিলে বের করলেন এক পত্রিকা নাম ‘People’s Song’। ১৯৪৭ সালে সেখানে প্রকাশিত হলো একটি গান,
“We Shall (Will) Overcome.”
এই গানের পরিচয় দেওয়ার দরকার আছে কি! সব ধরণের শোষণ, অপমান অত্যাচার, নীচতা থেকে উত্তরণের এই সঙ্গীত। এতে জুড়েছে নতুন নতুন পঙক্তি। বিশ শতকের একেবারে গোড়ার দিকের লেখা গান এখনো কতটা প্রাসঙ্গিক।
এই গান এক দীপ্ত উচ্চরণে গাওয়া হয় আমাদের বাংলায় অনূদিত হয়ে,
“আমরা করবো জয় নিশ্চয়!”
Discover more from অভিযাত্রী
Subscribe to get the latest posts sent to your email.