বিশেষ প্রতিবেদন

বিশ্ববিদ্যালয় ও গ্রন্থাগার: জ্ঞান চর্চার বাতিঘর

প্রাচীন থেকে আধুনিক যুগে শিক্ষার কেন্দ্রবিন্দু এবং জ্ঞান সংরক্ষণের ইতিহাস

দেশ ভালো হয় যদি দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভালো হয়। কথাটি বলেছিলেন ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী পন্ডিত জওহরলাল নেহেরু। এই ছোট বাক্যের মর্মার্থ এত বেশি যে বর্তমান সময়ের বিভিন্ন আঙ্গিকে বিশ্লেষণ করলেই বোঝা সম্ভব।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা

বিশ্ববিদ্যালয় হলো একটি রাষ্ট্রের ভিতরে আরেকটি রাষ্ট্রের মত। এখানে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা একে অপরের পরিপূরক হিসেবে জ্ঞান চর্চা করে থাকেন। যেখানে প্রতিনিয়ত নানান ধরণের নতুন জ্ঞানের সৃষ্টি হয়। যেটিকে কাজে লাগিয়ে দেশ ও সমাজের সব স্তরের মানুষেরা উপকৃত হয়। ফলে একটি দেশের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্ব অপরিসীম।

গ্রন্থাগারের গুরুত্ব

তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে আরেকটি বিষয় খুব গুরুত্বপূর্ণ সেটি হলো গ্রন্থাগার। বিশ্ববিদ্যালয় ও গ্রন্থাগারের মধ্যে দারুণ এক সম্পর্ক রয়েছে। একটি ছাড়া অপরটি অপরিপূর্ণ। এই দুটি জিনিসের ইতিহাস সহ আজকের আলাপ।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস

বন-জঙ্গল থেকে একেবারে সমতলে এসে মানুষের বসবাস শুরুর সাথে সাথে নানা কিছুর বিকাশ ঘটেছে। মানুষ আগুন আবিষ্কার থেকে শুরু করে গাছের পাতায় লেখার চর্চাও শুরু করে। এরপর থেকে শিল্প, সাহিত্য ও কলার বিকাশ আরো দ্রুত শুরু হয়। সব কিছুর প্রয়োজনের সঙ্গে সঙ্গে কাঠামোভাবে সবকিছুর চর্চা শুরু হয়। এখান থেকে মূলত বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হয়।

প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়

এক সময় ছিল যখন মানুষ ঘোড়া-গাধার পিঠে চড়ে পর্বত-মরুপ্রান্তর পাড়ি দিয়ে জড়ো হতো এ জায়গাটায়। সেখানে ছিল একটি বিশ্ববিদ্যালয়। যেখানে বসে নানান সাধক বিভিন্ন বিষয়ে ছাত্রদের মাঝে জ্ঞান ছড়িয়ে দিতেন।

বিশ্ববিদ্যালয়টি ৪৫৫ খ্রিস্টপূর্বেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তা বলা যায়। এটি প্রাচীন ভারতের মগধ (বর্তমানে বিহার) রাজ্যের রাজধানী রাজগীর থেকে ১০ কি.মি. দূরে অবস্থিত বিশ্ববিদ্যালয়টি। গুপ্ত রাজবংশের বিখ্যাত সম্রাট কুমারগুপ্ত এটি নির্মাণ করেছিলেন। প্রাচীন বাংলার জ্ঞানবৃক্ষ শীলভদ্র, পদ্মসম্ভব, চন্দ্রগোমী, কমলশীল, শান্তরক্ষিত তথা শ্রেষ্ঠ পন্ডিতরাও ছিলেন এখানকার শিক্ষকতায়।

তৎকালীন সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে ছাত্র সংখ্যা ছিল প্রায় দশ হাজার আর শিক্ষক দুই হাজার। মাটি খুঁড়ে আবিষ্কার করা হয়েছে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের ধ্বংসাবশেষ। ২০১৪ সালে পুনরায় চালু করা হয় নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়।

ভারতের নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের নেতৃত্বে একদল পন্ডিতের উদ্যোগে বিশ্ববিদ্যালয়টি পুনর্গঠন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় তৈরির মূল কারণ হলো জ্ঞান তৈরি ও ছড়িয়ে দেওয়া।

মধ্যযুগীয় বিশ্ববিদ্যালয়

মধ্যযুগে ইউরোপে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিকাশ ঘটে। ১০৮৮ সালে প্রতিষ্ঠিত ইতালির বোলোনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়কে ইউরোপের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে ধরা হয়। এরপর অক্সফোর্ড, কেমব্রিজসহ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ধর্ম, আইন, চিকিৎসা, এবং দর্শনশাস্ত্রের উপর গুরুত্ব দেওয়া হতো।

আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়

আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মূল লক্ষ্য হলো গবেষণা ও উচ্চশিক্ষা প্রদান। ১৮০৯ সালে প্রতিষ্ঠিত বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়কে আধুনিক গবেষণা বিশ্ববিদ্যালয়ের মডেল হিসেবে ধরা হয়। এখানে শিক্ষার্থীরা গবেষণার মাধ্যমে নতুন জ্ঞান সৃষ্টি করে এবং তা সমাজে প্রয়োগ করে।

বিজ্ঞাপন

গ্রন্থাগারের ইতিহাস

সভ্যতার সঙ্গে সঙ্গে মানুষ তার সব নথিগুলো সংরক্ষণ করতে শুরু করে। এখান থেকেই মূলত গ্রন্থাগার তৈরির ইতিহাস শুরু হয়। আদিম গ্রন্থাগারগুলি লেখার প্রাথমিক ধরণগুলির মহাফেজখানা ছিল। খ্রিস্টপূর্ব ২৬০০ বছরের পুরানো সুমের অঞ্চলের মন্দিরে প্রথম লিপিবদ্ধ কিছু নোট পাওয়া যায়।

প্রাচীন গ্রন্থাগার

সেখানে প্রায় এক ইঞ্চি পুরু মৃত্তিকা ফলকগুলি বিভিন্ন মাপ এবং আকারে নির্মিত। গুরুত্বপূর্ণ শিলালিপি খোদাই করার পর সেটিকে রোদে শুকানো হত মজবুতভাবে তৈরী করার জন্য। সংরক্ষণ করার সময় মৃত্তিকা ফলকগুলিকে প্রান্ত বরাবর রাখা হতো।

বর্তমানে একটি গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠানের প্রাচীনতম রেকর্ডগুলি পৃথিবীর দক্ষিণ-পশ্চিম এশীয় অঞ্চলগুলিতে প্রায় ৫,০০০ বছর পূর্বে তারিখ হতে পারে। প্রাচীনতম গ্রন্থাগারগুলির মধ্যে একটি হ’ল এটি প্রাচীন গ্রন্থাগারের এবলা (প্রায় ২৫০০ BCE) বর্তমান সিরিয়ায়।

আল কারাওইয়িন গ্রন্থাগারটি ৮৫৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ফাতেমা আল-ফিহরি এবং এটি বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন ওয়ার্কিং লাইব্রেরি। এটি ফেজ, মরক্কোতে অবস্থিত এবং বিশ্বের সবচেয়ে পুরানো ক্রমাগত অপারেটিং বিশ্ববিদ্যালয়, এর একটি অংশ আল-কারাওইয়িন বিশ্ববিদ্যালয়।

গ্রন্থাগারে প্রায় ৪,০০০ প্রাচীন ইসলামিক পাণ্ডুলিপি রয়েছে। এছাড়া গ্রীক সরকার সর্বপ্রথম পাবলিক লাইব্রেরি স্পন্সর করেছিল। খ্রিস্টপূর্ব ৫০০ অব্দে অ্যাথেন্স এবং সামোস উভয়ই জনসাধারণের জন্য গ্রন্থাগার তৈরি শুরু করেছিলেন।

মধ্যযুগীয় গ্রন্থাগার

মধ্যযুগে ইউরোপে গ্রন্থাগারের বিকাশ ঘটে। ৭০০ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত সেন্ট ক্যাথরিনস মনাস্টেরি গ্রন্থাগারটি অন্যতম প্রাচীন গ্রন্থাগার। এখানে বাইবেলসহ বিভিন্ন ধর্মীয় গ্রন্থ সংরক্ষিত ছিল। এছাড়া ৮০০ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত কর্ডোবা গ্রন্থাগারটি ছিল মুসলিম বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ গ্রন্থাগার।

আধুনিক গ্রন্থাগার

আধুনিক গ্রন্থাগারগুলোর মূল লক্ষ্য হলো জ্ঞান সংরক্ষণ ও বিতরণ। ১৮৩৩ সালে প্রতিষ্ঠিত বোস্টন পাবলিক লাইব্রেরি ছিল যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম পাবলিক লাইব্রেরি। বর্তমানে ডিজিটাল গ্রন্থাগারগুলোর বিকাশ ঘটেছে, যেখানে ই-বুক, জার্নাল, এবং অন্যান্য ডিজিটাল সামগ্রী সংরক্ষিত থাকে।

বিশ্ববিদ্যালয় ও গ্রন্থাগারের মধ্যে সম্পর্ক

জ্ঞান চর্চার উৎকৃষ্ট জায়গা যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয় সেহেতু জ্ঞান সংরক্ষণেরও সবচেয়ে ভালো জায়গা হলো বিশ্ববিদ্যালয়। তাই আদিকাল থেকে বিভিন্ন শিল্প, সাহিত্য ও দর্শনের যাবতীয় বিষয়ে চর্চাকৃত নতুন জ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারে সংরক্ষণ করা হয়। কারণ এখান থেকে নিয়ে নতুন এসে আগেরগুলোকে মূল হিসেবে ধরে নতুন কিছু করার চেষ্টা করে। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার নিজস্বভাবেই একটি বাতিঘর হিসেবে রূপ লাভ করে।

জ্ঞান সংরক্ষণ

বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিনিয়ত উৎপন্ন হওয়া জ্ঞান যখন একটি নির্দিষ্ট কিছুর মধ্যে সংরক্ষণ হতে শুরু করে তখন সেটির কদর আপনা-আপনি বৃদ্ধি পায়। আর সেই জায়গাতে সাধারণভাবে নানা ধরণের মানুষের আসার আগ্রহ তৈরি হয়।

কারণ আদিকাল থেকে মানুষ সবচেয়ে বেশি ক্ষুধার্থ জ্ঞানের জন্য। এটি অর্জনের জন্য বিভিন্ন মানুষ দুর্গম পথ পাড়ি দিয়েছে। পথে মৃত্যুর কথা জেনেও অনেকে সেই পথের পথিক হয়েছেন। তবুও জ্ঞান অর্জনের জন্য পিছুপা হননি। ফলে বিশ্ববিদ্যালয় ও গ্রন্থাগারের মধ্যে নিবিড় সম্পর্ক বলে বোঝানো সম্ভব নয়।

আদি ও বর্তমানের পার্থক্য

আদিমকালে মানুষ গ্রন্থাগারে যাওয়ার জন্য ভিড় করতেন। নতুন কোন বিষয়ের গবেষণা ও ভিন্ন কিছু পড়ার জন্য গ্রন্থাগারের ঘন্টার পর ঘন্টা ব্যয় করতেন। কিন্তু সময়ে মানুষের গ্রন্থাগারে যাওয়ার ভিড় ঠিক আগের চেয়ে অনেক বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে সেটির কারণ ভিন্ন। এটি নিয়ে দেশের প্রচলিত সব গণমাধ্যমে সংবাদ প্রচার করা হয়েছে যে, দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারে শিক্ষার্থীরা শুধু যান বিসিএসসহ বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক পড়াশোনা করার জন্য।

বর্তমান পরিস্থিতি

সেই জ্ঞান অর্জন কিংবা নতুন বা পুরাতন কোন তত্ত্ব জানার জন্য আর কেউ গ্রন্থাগারের তাক খুঁজে বই বের করেন না। বর্তমান যুগের শিক্ষার্থীরা ব্যাগে করে চাকরির প্রস্তুতিমূলক বই নিয়ে গ্রন্থাগারে প্রবেশ করেন। মাঝে মাঝে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারের নিচে পড়ার জন্য ব্যাগ রেখে নিজের জায়গা দখল করার দৃশ্য ভাইরাল হয়।

দেশের চাকরির বাজার ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনার মধ্যে এমন এক অদৃশ্য দেয়াল তৈরি হয়েছে যে সেটি পার হওয়ার জন্য গ্রন্থাগারের বই আর শিক্ষার্থীরা পড়ছে না। বরং তারা বাজারে প্রাপ্ত বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক বই কিনছেন।

সমস্যার কারণ

এটি হওয়ার মূলত দুটি কারণ হতে পারে:

১. বিশ্ববিদ্যালয়ের আসল উদ্দেশ্য থেকে বিচ্যুত হয়েছে। ২. বিশ্ববিদ্যালয় তার নিজস্বতা হারিয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশ্য

প্রথম কারণটি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল উদ্দেশ্য হলো জ্ঞান তৈরি ও সংরক্ষণের মাধ্যমে জাতিকে আরো উন্নত করা। ভবিষ্যতের বিভিন্ন কঠিন সময় মোকাবেলায় সুপরামর্শ দেওয়া। কিন্তু বর্তমানের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এটির কিছুই করতে পারছে না। ফলে শিক্ষার্থীরা ভিন্ন কিছু করছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্বতা

দ্বিতীয় কারণটি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন সমস্যার সমাধানের লক্ষ্যে চিন্তা করবে। এটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্বতার প্রথম বৈশিষ্ট্য। আর প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মিশন ও ভিশন নিয়ে এগিয়ে যাবে।

কর্পোরেট চাহিদা

কিন্তু বর্তমানে সেটির সব কিছু ভুলে কর্পোরেট জগতের চাহিদা অনুসারে সিলেবাস ও কারিকুলাম তৈরি করা হচ্ছে। ফলে শিক্ষার্থীরা নানা ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। নিজেকে সেভাবে মেলে ধরতে পারছে না। সার্বিকভাবে প্রধান কাজ অনুসারে এত বেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়োজন নেই। আর বিশ্ববিদ্যালয় কোন কারিগরি প্রতিষ্ঠান নয় যে এখান থেকে বিভিন্ন কারিগরি দক্ষতাসম্পন্ন মানুষ কর্পোরেট জগতের জন্য তৈরি হবে।

পরিশেষ

বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মূলত সাধারণ জনগণের টাকায় চলে ফলে তাদের উন্নয়নের জন্য চিন্তা করাই হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ। ফলে বিশ্ববিদ্যালয় তার নিজস্বতাকে ফিরিয়ে নিতে পারলে আর কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারে বসে বাজারি বই পড়বে না।

আর এটি অতি জরুরী হয়ে পড়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় তার নিজস্ব জায়গায় ফিরে না আসলে আমরা দ্রুত এক অন্ধ ভবিষ্যতে মধ্যে ডুবে যাবো।

বিজ্ঞাপন

আব্দুস সবুর (লোটাস)

My name is Abdus Sabur Lotus. I am a sub-editor at ovizatri.com and a co-founder of this online news and magazine portal. I have worked as a journalist for various Bangladeshi news portals and agencies, both online and offline. I contribute to Haal Fashion and previously served as the Rajshahi University Correspondent for Kalbela. I was also the General Secretary of the Rajshahi University Journalists' Association. I graduated with a degree in Journalism from Rajshahi University. Stay updated with ovizatri.com.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button