দর্শন

৩%! মেধাতন্ত্র ও সমতার দ্বন্দ্ব

মেধাতন্ত্রের মায়াজাল আর গণতন্ত্রের সংকট

- Advertisement -

মানুষের দ্বারা নির্মিত কোন প্রক্রিয়া কি ‘Absolute Justice’ কায়েম করতে পারবে? মানুষ কি অদৌ এমন একটি সিস্টেম তৈরি করতে পারবে যেখানে ‘মেধা (Merit)’ ভিত্তিক সমাজ তৈরি হবে? মানুষ কি কোনভাবে ‘Absolute’ বা ‘ধ্রুব’ মাপকাঠিতে অন্য মানুষের অধিকার বলে দিতে সক্ষম?

ব্রাজিলের একটি জনপ্রিয় টিভি সিরিজ ‘3% (৩%)’ এই দর্শন নিয়ে এত গভীরভাবে কাজ করেছে যা সচরাচর আমি দেখি না। আমি এই সিরিজের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ক্লান্তহীনভাবে দেখে গেছি এবং এই পরিচালকের দেওয়া অনেক প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে আমি বারবার নিজেকে হারিয়ে ফেলেছি কিন্তু উত্তর পাই নাই।

ডিস্টোপিয়ান এই সিরিজে যে অন্ধকার পৃথিবী দেখানো হচ্ছে এবং তাদের মধ্যে যারা ২০ বছর বয়সী তাদের পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে, এবং অসংখ্য প্রার্থীর মধ্যে থেকে মাত্র ‘৩%’ শতাংশ তরুণ/তরুণীদের ‘Offshore’ বা একটি দ্বীপে (ইউটোপিয়ান রাজ্যের মত) পাঠানো হচ্ছে। এই পরীক্ষার নাম দেওয়া হয়েছে ‘প্রবেশ প্রক্রিয়া (The Process)’। যারা এই প্রবেশ প্রক্রিয়া পরিচালনা করছেন তাদের কাছে আছে মারাত্মক হাই-টেক সম্পন্ন ব্যবস্থা ও নিয়ন্ত্রণ/মনিটরিং করার জন্য প্রয়োজনীয় হাই-টেক সম্পন্ন যন্ত্রপাতি।

বেশ দীর্ঘ চার সেশনের এই সিরিজ ভয়ানক কিছু প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বেড়ায়। কিছু দৃশ্য দূর্বল হৃদয়ের মানুষদের জন্য নয়। এখানে বিপ্লবের যে সংজ্ঞা তার উত্তর দেবার চেষ্টা করেছেন পরিচালক সাহেব কিন্তু ‘Absolute’ বা ‘ধ্রুব’ কিছুই বলেন নাই। তিনি হয়তো এটুকু বলেছেন বা বলার চেষ্টা করেছেন, “শোষিত যারা হবে তারা একদিন পরিবর্তন নিয়ে আসবেই, তাদের এক প্রজন্ম না পারলে আরেক প্রজন্ম পারবে, আর যদি কেউ-ই না পারে তাহলে সময় শোষকদের জবাব দিয়ে দেবে।”

গণতন্ত্র বনাম মেধাতন্ত্রের ভয়ানক লড়াই। আমার মতে, মেধাতন্ত্র একটি রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে গণতন্ত্রের চেয়ে অনেক ভালো শাসন হতে পারে, যদিও মেধাতন্ত্র নিয়ে বহু সমালোচনা বিদ্যমান। এই সিরিজে বারবার বলা হচ্ছে, “You deserve it!” মানে হলো, আপনার মেধা আছে এবং আপনি যেহেতু আমাদের প্রবেশ প্রক্রিয়ায় পাশ করেছেন তাই ৩% শতাংশে আপনাকে স্বাগতম! এখন আপনি আমাদের ইউটোপিয়ান রাজ্যে (Affluent Offshore) যাওয়ার জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত।

- Advertisement -

এখানের প্রবেশ প্রক্রিয়া এবং গল্পের উন্নতির ক্ষেত্রে আরো দশটা ডিস্টোপিয়ান সিনেমা বা সিরিজের মত নয়। বিশেষ করে আমরা যারা কিছুটা আদর্শিক ডিস্টোপিয়ান সিনেমা ‘ব্লেড রানার ২০৪৯ (Blade Runner 2049)’ দেখেছি। এখানে প্রক্রিয়ার মধ্যে কোন ধরণের পক্ষপাত নাই, দুর্নীতি নাই, স্বচ্ছ ও পরিষ্কার। কিন্তু তারপরেও সেই সিস্টেম ভেঙ্গে চুরমার এবং ভয়ানকভাবে ব্যর্থ।

গণতন্ত্র নিয়ে আমাদের ধারণা থাকলেও মেধাতন্ত্র নিয়ে আমাদের অনেকের ধারণা কম। মেধাতন্ত্র হলো, একটি সিস্টেমে ঐ মানুষটি শাসন করবেন যার মেরিট বা মেধা আছে। যিনি কোন একটি পরীক্ষা বা প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে পাশ করে শাসনের দায়িত্ব নেন। এক্ষেত্রে ঐ ব্যক্তির অন্য কোন পরিচয়, যেমন: ধর্ম, বর্ণ, বংশ, গোত্র, অর্থনৈতিক অবস্থা ইত্যাদি বিবেচনায় নেওয়া হবে না।

বাংলাদেশের BCS, ভারতের UPSC এবং যে কোন দেশের সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই মেধাতন্ত্রের মধ্যে দিয়ে চলে। তাদেরকেও কিছু শাসনভার রাষ্ট্র দিয়ে থাকে। কিন্তু রাষ্ট্রের সামগ্রিক শাসনে গণতন্ত্রের বিকল্প অন্য কিছুই খুঁজে পায় না। তার পেছনের কারণ কি?

আমরা ৩% সিরিজের দিকে ফিরে যাই এবং এখানে যে মেধাতন্ত্রের চর্চা সেটা একটু দেখি। অভিজাত অফশোর যে নীতি নির্ধারণ করেছেন, যে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মানুষকে ইনল্যান্ড থেকে অফশোরে নেওয়া হচ্ছে তা ব্যাপক বৈষম্যের তৈরি করছে। উনারা মনে করেন একটি খারাপ ব্যবস্থা শক্তিশালী মানুষদের তৈরি করতে পারে আর এ-কারণেই ইনল্যান্ড কে সবসময় নৈরাজ্যের অন্ধকারে রেখে দেন এবং সেখান থেকে বেছে বেছে কিছু মানুষকে একটি স্বচ্ছ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অফশোরে পাঠিয়ে দেন।

সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশ ও ভারতের দরিদ্র সমাজকে ইনল্যান্ড এবং BCS বা UPSC পরীক্ষার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ব্যাপক প্রাচুর্য, সম্মান ও শাসনের দায়িত্ব পাওয়াকে যদি মেটাফোরিক অফশোর বিবেচনায় নিই তাহলে হয়তো খুব বেশি ভুল বলা হবে না।

- Advertisement -

কিন্তু রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সাংসদ নির্বাচনেও যদি অনুরুপ মেধাতন্ত্র কাজে লাগানো হয় তাহলে কিন্তু সর্বনাশ! উক্ত ব্যবস্থার গণতান্ত্রিক মানুষগুলো বিদ্রোহ করবেই করবে। কারণ মেধাতন্ত্র টেনে নিয়ে আসা এক জিনিস কিন্তু সেটাকে যথাযথভাবে প্রতিষ্ঠা করা অন্য জিনিস। সবার সমান সুযোগ, বৈষম্যের বিরোধ এবং নৈরাজ্যও যদি না থাকে তাহলে অনেকেই অফশোর কামনা করবেন না। বেশিরভাগ লোকজন ইনল্যান্ডে থেকে যাবেন। সুতরাং অফশোর তখন পর্যন্ত ‘Valid’ যখন পর্যন্ত ইনল্যান্ড সার্বক্ষণিক নৈরাজ্যের অন্ধকারে পড়ে থাকবে।

৩% সিরিজের গ্রেট মাইন্ডের যে চিন্তা তা ভয়ানক ভালো ছিলো। তারা প্রায় প্রতিটি প্রক্রিয়ার মধ্যে মানুষের চিন্তা, সহনশীলতা, ধৈর্য্য, শারীরিক ফিটনেস, বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তা সহ একাধিক অসাধারণ সব মাপকাঠি নিয়ে ৩% শতাংশ মানুষকে ইনল্যান্ড থেকে অফশোরে নিয়ে যাচ্ছেন। শুধু তাই-ই নয়, এদের মধ্যে যারা খুবই ভালো পারফর্ম করছেন তারা শাসন ব্যবস্থায় জায়গা পাচ্ছেন। অফশোরে সবার জন্য থাকছে বিনামূল্যে সব! ইচ্ছামতো যা ইচ্ছে খেতে পারবেন, অবাধ যৌনমিলন করতে পারবেন, মানে রীতিমতো পার্থিব বেহেশত।

এছাড়াও আপনাকে অতীত ও দুশ্চিন্তা ভুলিয়ে রাখার জন্য নিয়মিত এক ধরণের মাদকদ্রব্য বা মেডিসিন প্রদান/ইনজেক্ট করা হবে। আপনি বাচ্চা নিতে পারবেন না। কিন্তু এসবের অনূভুতি কি সেটাও জানবেন না! মানে খারাপ/মন্দের অনুভূতি বা বিদ্রোহ করার অনুভূতি আপনার মনে জাগবে না। এই মাদক আপনাকে সবসময় আনন্দে রাখবে। তাহলে তো মামলা সব ঠিকই আছে! তাই না? তাহলে এখানে বিপ্লব হলো কেন? সিস্টেম চুরমার করে ফেলা হলো কেন?

ইনল্যান্ডের মানুষ মনে করেন যে তাদের প্রতি বৈষম্য করা হচ্ছে এবং তাদের প্রকৃত ক্ষমতা অফশোর চিন্তায় নিচ্ছে না। এটা আরো বেশি প্রমাণিত হয় যখন অফশোরের প্রতিষ্ঠাতার মেয়ে এই প্রক্রিয়ায় অল্পের জন্য ব্যর্থ হয়। ঠিক যেমন বিসিএস পরীক্ষায় সবার জন্য নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন জ্ঞানীয় যোগ্যতার একক মাপকাঠি। তাই গণতান্ত্রিক ও বৈষম্য বিরোধী চিন্তার মানুষদের জন্য কিছু বামপন্থী দল কাজ শুরু করে করেন, এই সিরিজে তাদের চরিত্রের নাম,

১. মিশেল সান্তানা

- Advertisement -

২. জোয়ানা কোয়েলহো

৩. ফার্নান্দো কারভালহো এবং আরো অনেকে

কমরেড মিশেল সান্তানা অফশোর কে এমন বিপাকে ফেলে দেয় এবং সে নিজেও একটি অফশোর তৈরি করেন সমতা ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে। এবং সেটার প্রবেশ পথে লেখা আছে, “এখানে সবাই স্বাগতম!” কিন্তু এক পর্যায়ে দেখেন, তিনি সবার জন্য সমতা তো করতেই পারছেন না, এমনকি নিজেই ভয়ানক বিপাকে। ইনল্যান্ডের মানুষগুলো যারা মিশেল কে বিশ্বাস করেছিলো তারা বিশ্বাস পর্যন্ত হারিয়ে ফেলেন। তারা পুনরায় ফিরে যান ইনল্যান্ডে এবং দারিদ্রতার মধ্যে বসবাস শুরু করেন। আর কমরেড মিশেল খুঁজে পান যে, মানুষের তৈরি কোন প্রক্রিয়া ‘Absolute Justice’ এনে দিতে পারে না। আরো আবিষ্কার করেন, তার প্রক্রিয়া যদি এত ভয়ানকভাবে ব্যর্থ হয় তাহলে অফশোরের প্রক্রিয়া আরো নোংরা হতে বাধ্য।

এই গল্পে অফশোর কে পুরোপুরি খতম করা হয়। এই বামপন্থী মানুষগুলো পুরো বিষয় স্টাডি করে দেখেন ভোগান্তি অফশোরেও, ভোগান্তি ইনল্যান্ডেও। পার্থক্য হলো, অফশোরে মাত্র ৩% শতাংশ মানুষের বসবাস এবং ইনল্যান্ডে ৯৭% শতাংশ মানুষের বসবাস। তাই তারা সিদ্ধান্ত নেন ভোগান্তি যখন অপরিহার্য তখন সবাই ভোগান্তির মধ্যেই থাকবে, ইনল্যান্ডের জন্য সবাই কাজ করবে। একসময় সবাই বিষয়টি বুঝতেও সক্ষম হোন, হাত থেকে আগ্নেয়াস্ত্র ফেলে দেন। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হয়।

এই লেখাটি আপনার কাছে খুব পরিচিত পরিচিত লাগছে কি? সদ্য ঘটে যাওয়া কোনকিছু নয়তো! ধন্যবাদ

- Advertisement -

- Advertisement -
- Advertisement -

মেহেদি হাসান

পরিচয়: আমি মোঃ মেহেদি হাসান, কলম নামে মি. বিকেল। আমি একজন বহুমুখী ব্যক্তি, বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমার পেশাগত জীবন বিস্তৃত। লেখক, অভিনেতা, সমাজকর্মী, রেডিও জকি, ওয়েব ডেভেলপার, ওয়েব ডিজাইনার, সম্পাদক, উপস্থাপক, রক্তদাতা, অডিও ও ভিডিও সম্পাদক, ছবি সম্পাদক, ইউটিউবার এবং নাট্য পরিচালক হিসেবে কাজ করি। মাইক্রোসফটের একজন ডেভেলপার এবং অ্যাপ ডেভেলপারও আমি। More »

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

- Advertisement -
Back to top button