কলম

‘স্ক্যারলেট লেটার’-এর প্রতিচ্ছবি: ‘লাভ জিহাদ’ বিতর্কের আন্তঃধর্মীয় প্রেমের ট্র্যাজেডি

ধর্মীয় মতাদর্শের আড়ালে প্রেম: লাভ জিহাদের বিতর্ক ও সমাধানের সন্ধানে

‘লাভ জিহাদ’ শব্দটি প্রথমে ২০০৬ সালে ভারতের হিন্দু জাতীয়তাবাদী সংগঠন বাজরং দল ব্যবহার করেছিলেন বলে জানা যায়। কারো কারো মতে, এরও আগে ২০০২ সালে গুজরাত দাঙ্গার পর একাধিক হিন্দু সাম্প্রদায়িক ওয়েবসাইটে এই শব্দ এবং এই শব্দকে ঘিরে ধারণা প্রকাশ করে। বিষয়টি দিন দিন অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। অদ্ভুত এই শব্দাংশ (লাভ জিহাদ) শুধু আক্ষরিকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে না, যে বা যারা আন্তঃধর্মীয় (হিন্দু-মুসলিম) বিয়ে করেছেন (ভারতে) তাদের কে হত্যা পর্যন্ত করা হয়েছে। চাই তারা কোন ধর্ম মানুক, বা না মানুক।

 

প্রথমে আসা যাক, লাভ জিহাদ কি? লাভ জিহাদ হলো, মুসলিম বিদ্বেষমূলক ষড়যন্ত্র তত্ত্ব যা বলে, একজন মুসলিম পুরুষ যখন কোন হিন্দু নারীকে বৈবাহিক সম্পর্কের মধ্যে দিয়ে ধর্মান্তরিত করে (ইসলাম ধর্মে)। এখানে টুইস্ট হচ্ছে পবিত্র আল-কোরআনে মুসলিম পুরুষদের ইহুদি ও খ্রিস্টান নারীদের কিছু শর্ত সাপেক্ষে বিয়ে করার অধিকার দিয়েছে। অন্যদিকে এই একই অধিকার ইসলামে নারীদের দেওয়া হয় নাই। ইসলাম মনে করে, এতে নারীরা পথভ্রষ্ট হবে এবং নিজ ধর্ম থেকে সরে যেতে পারে।

 

আর যেহেতু ইহুদী ও খ্রিস্টান আব্রাহামিক ধর্মের অনুসারী তাই তাদেরকে বিয়ে করা গেলেও একজন হিন্দু নারীকে কোন পুরুষ বিয়ে করতে পারবেন না। সুতরাং লাভ জিহাদ ধারণাকে এখানেই উহ্য/বাতিল করে দেওয়া যায়। কারণ ঐ বিয়েতে হিন্দু নারীকে মুসলিম না হওয়া ছাড়া বিয়েটা ইসলাম ধর্ম অনুযায়ী ‘বিয়ে’ হিসেবে বিবেচিত হবে না। এবার ভালো করে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, একারণেই পুরোপুরি ‘লাভ জিহাদ’ কনসেপ্ট বাতিল করা সম্ভব হচ্ছে না।

 

কারণ সাম্প্রতিক ভারতে বেশ কিছু এমন বিয়ে হয়েছে যেখানে ইসলাম ধর্ম মোতাবেক হয়েছে। আবার অন্যদিকে কিছু বিয়ে হয়েছে দুই ধর্মের নিয়মকানুন অনুযায়ী। এখানে এমন বিয়েতে মুসলিম নারীরা তো যেতেই পারবে না, আর মুসলিম পুরুষ ধর্মান্তরিত না করে কোন হিন্দু নারীকে বিয়ে করতে পারবেন না। কিন্তু এই সমস্ত বিয়ের বেশিরভাগ বিয়ে হচ্ছে দুই ধর্মের প্রতি সম্মান রেখে। এতে করে ইসলাম ধর্ম অনুযায়ী এমন বিয়ে বাতিল হিসেবে গণ্য হবে, লাভ জিহাদ তো অনেক দূরে।

 

এখানে আব্রাহামিক ধর্মের লেগেছি বহন করা নারী-ই শুধু একজন মুসলিম পুরুষকে বিয়ে করতে পারবেন। তাহলে কেন হিন্দু নয়? ওরা শর্ত পালন করে বিয়ে করুক? না, আপাতদৃষ্টিতে ইসলাম হিন্দুদের প্রতি বৈষম্য, মুসলিম নারীদের অধিকারে হাত দিলেও মূলত ‘আল্লাহ্’ বা এক ‘ঈশ্বর’ এর ধারণায় হাত দেই নাই। কিন্তু যেসব ধর্মে একের অধিক ‘ঈশ্বর’ আছেন মানে ‘Polytheistic’ সব ধর্ম কে বাতিল করেছে। এবং প্রধান শর্ত যোগ করা হয়েছে আহলে কিতাব (আসমানী গ্রন্থ) অনুসারী হতে হবে। কোন কোন আসমানী গ্রন্থ? তাওরাত, যবুর, ইঞ্জিল ও পবিত্র আল-কোরআন।

 

এখন এই উপমহাদেশে আন্তঃধর্মীয় বিয়ের বিষয়টি জরুরী হতে পারে। এখানে সবচেয়ে বড় দুটি ধর্ম হলো ইসলাম ও হিন্দু ধর্ম। তাহলে এই বিষয়ে সমধান কি হতে পারে? কারণ এদের সহাবস্থান জরুরী। আর সহাবস্থান থেকেই তো সম্পর্ক এবং তারপর বিয়ে পর্যন্ত গড়ায়। এই উপমহাদেশে হাজারো হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কে ব্যর্থ প্রেমের গল্প লেখা হয়েছে, এখনো হচ্ছে। বাস্তবে এই সংখ্যা আরো অনেক বেশি। সহাবস্থান করতে গেলে সমাধান জরুরী, সংঘর্ষ নয়। কিন্তু সরি! ইসলামের কাছে এর কোন সমাধান নাই। অন্যদিকে হিন্দুধর্মে মুসলিম নারী ও পুরুষকে বিয়ে না করার ক্ষেত্রে সরাসরি কোনো নিষেধাজ্ঞা নাই।

 

সুতরাং ‘লাভ জিহাদ’ তো হচ্ছে কিন্তু উল্টা ‘লাভ জিহাদ’। অনুমান অনুযায়ী, যেভাবে মুসলিমরা হিন্দু নারীকে বিয়ে করছেন সেক্ষেত্রে তিনি ঐ আহলে কিতাবের শর্ত পালন করে বিয়ে করছেন। এবং এখানে বেশিরভাগ মুসলিম স্কলার’রা চুপ আছেন। ঠিক যেমনটি কনডম নিয়ে চুপ আছেন বা ইসলামে জন্ম নিয়ন্ত্রণ নিয়ে চুপ আছেন।

 

কারণ আমরা তো কেউ-ই এসব জানার চেষ্টা করি নাই, হয়তো একজন মুসলিম পন্ডিতও কিছু বিষয় দেখেও না দেখা করেছেন। সমস্যা হলো, এত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আমাদের সমাধান চাই, চোখ বন্ধ অবস্থা নয়। তাই এখানেই ‘দ্য স্কারলেট লেটার’ উপন্যাস প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। এবং খুব গুরুত্বের সাথে ‘দ্য স্কারলেট লেটার’ ইংরেজি সাহিত্যে পড়ানোও হয়।

 

কিন্তু কি এই ‘দ্য স্ক্যারলেট লেটার’? নাথানিয়েল হথর্নের বিখ্যাত উপন্যাস ‘দ্য স্ক্যারলেট লেটার’ ১৭ শতকের পুরাতন ইংল্যান্ডের পটভূমিতে রচিত, যেখানে ধর্ম ছিলো সমাজের মূল ভিত্তি। তিনটি বুলেট পয়েন্ট,

 

১. ধর্মীয় পার্থক্যের বাধা: হেস্টার ও ডিমেসডেলের ভিন্ন ধর্মীয় বিশ্বাস তাদের প্রেমের পথে বড় বাধা সৃষ্টি করে। তাদের সমাজ ধর্মীয় মতাদর্শের বাইরে প্রেমকে গ্রহণ করে না, তাই তাদের সম্পর্ক গোপন রাখা ছাড়া অন্য কোন উপায় ছিল না।

 

২. অপরাধবোধ ও লজ্জা: ধর্মীয় নিয়ম লঙ্ঘনের জন্য হেস্টার ও ডিমেসডেল তীব্র অপরাধবোধ ও লজ্জায় ভোগেন। এই অনুভূতি তাদের মানসিক যন্ত্রণা বৃদ্ধি করে এবং তাদের সম্পর্কের উপর চাপ সৃষ্টি করে।

 

৩. সমাজের নিন্দা: তাদের আন্তঃধর্মীয় সম্পর্কের জন্য হেস্টার ও ডিমেসডেল সমাজের নিন্দা ও অপমানের শিকার হন। তাদের প্রতি নেতিবাচক মনোভাব তাদের মানসিক শক্তিকে আরও দুর্বল করে তোলে।

 

‘দ্য স্ক্যারলেট লেটার’ উপন্যাসে হেস্টার প্রাইন ও ডিমেসডেলের মৃত্যুর কারণ জটিল ও বহুমুখী। ধর্মীয় নিয়ম লঙ্ঘনের অপরাধবোধ, সমাজের অপমান, রোগ, দুঃখ ও হতাশা – এই সবকিছুই তাদের মৃত্যুর কারণ হতে পারে। কিন্তু আন্তঃধর্মীয় প্রেমের বিষয়টি কি উপেক্ষা করা যেতে পারে?

 

১৭ শতক থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ৩৪৪ বছর সময়কাল অতিক্রম করেছে। মানে তখনও আন্তঃধর্মীয় প্রেমের মৃত্যু ঘটেছে, এখনও তাই, মাঝখানে শুধু শত শত বছর। তো, মানুষের কাছে বেঁচে থাকার জন্য প্রেম/ভালোবাসা/বিয়ে এসব কি এতই গুরুত্বহীন? কিন্তু আজও এসবের কোনো সমাধান নাই। ইসলাম কি এতই কঠিন? ইসলাম কি এতই নিষ্ঠুর? বা, হিন্দু বর্ণবাদ কি এতই দরকারী? আমাদের আরো অনেক অনেক গবেষণার প্রয়োজন আছে। একসাথে বাঁচতে গেলে এভাবে চোখ বন্ধ করে নয়, চোখ খোলা রেখে সমাধান খুঁজতে হবে। উত্তর নিশ্চয় কোথাও না কোথাও পাওয়া যাবে।

 

রেফারেন্স সমূহ

 

রেফারেন্স – ০১: আজ তোমাদের জন্য সব পবিত্র বস্তু হালাল করা হয়েছে। আহলে কিতাবের (ইহুদী ও খ্রিস্টান) খাদ্য তোমাদের জন্য হালাল এবং তোমাদের খাদ্য তাদের জন্য হালাল। আর মুমিন নারীদের মধ্যে যারা সতী, তাদের এবং তোমাদের পূর্বে যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছে, তাদের মধ্যে যারা সতী, তাদের সাথে তোমরা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারো, যদি তোমরা তাদের মোহরানা প্রদান করো এবং তাদেরকে সতী-সাধ্বী রাখো, ব্যভিচারিণী বা গোপন উপপত্নী না বানাও।

  • সূরা মায়েদা: আয়াত ৫

 

রেফারেন্স – ০২: একজন মুসলিম পুরুষ একজন কিতাবী নারীকে বিয়ে করতে পারেন, কিন্তু একজন মুসলিম নারী একজন অ-মুসলিমকে বিয়ে করতে পারে না।

  • সহীহ্ বুখারী

 

রেফারেন্স – ০৩: একজন মুসলিম নারী একজন অ-মুসলিমকে বিয়ে করতে পারে না, কারণ সে তাকে ইসলামের পথ থেকে বিচ্যুত করবে।

  • সহীহ্ মুসলিম

মেহেদি হাসান (বিকেল)

I'm MD Mehedi Hasan, also known by my pen name Mr. Bikel. I'm the admin of the site Ovizatri - News & Magazine. I am a versatile individual with a professional life that spans various fields. I work as a writer, actor, social worker, radio jockey, web developer, web designer, editor, presenter, blood donor, audio and video editor, photo editor, YouTuber, and drama director. I am also a developer and app developer at Microsoft.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button