‘আ সাইলেন্ট ভয়েস (A Silent Voice)’, নিঃশব্দ থেকে স্বরে, নিজের স্বর খুঁজে পাওয়া
বুলিং, অনুতাপ ও পরিবর্তনের গল্প
‘আ সাইলেন্ট ভয়েস’ (২০১৬) পরিচালিত একটি জাপানিজ অ্যানিমে ফিল্ম। সিনেমার গল্প ‘শোয়া ইশিদা (Shoya Ishida)’ নামের এক ৬ষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্রকে নিয়ে। একদিন তার ক্লাসে ‘শোকো নিশিমিয়া (Shoko Nishimiya)’ নামের এক নতুন ছাত্রী আসে, সে শুনতে ও বলতে পারে না। নিশিমিয়া এর বধিরতা ও নিরবতার কারণে অন্যান্যদের সাথে কমিউনিকেট (communicate) করতে পারে না। সে সবার সাথে কথা বলার জন্য তার নোটবুক (notebook) বা সাংকেতিক ভাষার (sign language) আশ্রয় নেয়।
ইশিদার উপলব্ধি এবং বিচ্ছিন্নতা
তার এই বাহানায় ক্লাসের কিছু ছেলেমেয়ে বিশেষ করে ইশিদা (Ishida) সবসময় তাকে নিয়ে ঠাট্টা ও বিরক্ত করে। কিন্তু নিশিমিয়া (Nishimiya) সবার কাছে সবসময় মাফ চেয়ে নেয় শত বিদ্রূপ সহ্য করার পরেও। কারণ নিশিমিয়া (Nishimiya) মনে করে তার শুনতে ও বলতে না পারার কারণে হয়তো অন্যরা বিরক্ত হয়। সিনেমায় নিশিমিয়া (Nishimiya) চরিত্রকে এতটা নিরীহ আর নিষ্পাপ দেখানো হয়েছে যে এটি আপনাকে অতি আবেগি করে ফেলবে, ভেতর থেকে ভেঙে ফেলবে আপনার ইমোশনকে (emotion)।
পুনর্মিলন এবং পরিত্রাণ
একদিন অনেকবেশি অত্যাচারিত হয়ে নিশিমিয়া (Nishimiya) সেই স্কুল ছেড়ে চলে যায়। এরপর ইশিদা’র (Ishida) সাথে ক্লাসের অন্যান্যরা কথা বলা বন্ধ করে দেয়। কারণ সবাই মনে করে ইশিদা’র (Ishida) বাড়াবাড়ির কারণেই নিশিমিয়া (Nishimiya) স্কুল ছেড়ে চলে যায়। সময় পার হতে থাকে, একদিন ইশিদা (Ishida) উপলব্ধি করে যে সে কত অন্যায় করেছে মেয়েটার প্রতি। তার এই অপরাধবোধ (guilt) তাকে ভেতর থেকে যেন প্রতিক্ষণ আঘাত করতে থাকে।
এরপর ইশিদা (Ishida) নিজেকে বাইরের জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন করে নেয়। মাথা উঁচিয়ে, কারোর চোখে চোখ রেখে কথা বলার সাহসটাও হারিয়ে ফেলে। ঘোর একাকিত্বের (loneliness) মধ্য দিয়ে জীবন কাটাতে শুরু করে। এরমধ্যে কয়েকবার আত্মহননের (suicide) চেষ্টাও করে বসে সে। কিন্তু, নিশিমিয়া (Nishimiya) এর কাছে ক্ষমা না নিয়ে মরতে চায়নি সে। এরপর থেকে সে নিশিমিয়া (Nishimiya) কে খুঁজতে থাকে, এভাবেই কেটে যায় কয়েকটা বছর।
আবেগের গভীরতা এবং অনন্য দৃষ্টিভঙ্গি
একদিন ইশিদা (Ishida) খুঁজে পায় নিশিমিয়া (Nishimiya) কে। কিন্তু তাকে দেখা মাত্রই নিজেকে আড়াল করে নেয় ইশিদা (Ishida)। কেননা, ছোটবেলা থেকে শুধু অন্যকে নিয়ে ঠাট্টা করা, অন্যকে বিরক্ত করা এসবই জানত সে। কিভাবে একজনের কাছে ক্ষমা চাইতে হয় সে কায়দা তার জানা ছিলো না। কিভাবে নিজের দোষটা স্বীকার করতে হয়, মনের অনুভূতি অন্যের সামনে প্রকাশ করতে হয় সেটুকুও অজানা ছিল তার।
তাই, এমন একটা চরিত্র কিভাবে ধীরে ধীরে পরিবর্তন হয়, বিকশিত হয় এটি ভালোই উপভোগ করার মত একটা ব্যাপার ছিল। সিনেমার এই দুটি চরিত্রের সাথে আপনি ইমোশনালি (emotionally) এমনভাবে কানেক্ট (connect) হয়ে যাবেন, যা আপনি নিজের জীবনের সাথেও মেলাতে পারবেন। এছাড়া সিনেমায় অন্যান্য চরিত্রদের সাথেও আপনি এভাবেই জড়িয়ে পড়বেন। প্রত্যেকটি চরিত্রের মাঝে কোনো না কোনোভাবে আপনি নিজেকে খুঁজে পাবেন।
মাস্টারফুল পরিচালনা এবং প্রভাবশালী স্কোর
নিশিমিয়া (Nishimiya)! সে অন্যের সাথে কথা বলতে না পারায় নিজের মধ্যে যে কষ্টটা অনুভব করে তা দর্শকের মনেও অনুভব করায়। আর ইশিদা (Ishida) যে অপরাধবোধ নিয়ে সর্বদাই কষ্ট পেতে থাকে যে সে কি ভুলটা করেছে, আর সে তার চাওয়া সত্বেও তার ভুলগুলো শোধরাতে না পারায় যে ব্যথা অনুভব করে তা আপনাকে ফিল করাতে বাধ্য করবে এই সিনেমার মাধ্যমে।
অন্যান্য সিনেমা যেখানে সেইসব চরিত্রকে কেন্দ্র করে চলে যারা নির্যাতন, ঠাট্টা ও বিদ্রূপের শিকার হয় ও তারা কিভাবে এর থেকে নিজেকে বের করে ভবিষ্যৎ জীবনে সফল হয় সেটি দেখানো হয় সেখানে এই সিনেমা সম্পূর্ণ বিপরীত। এখানে বরং, সেই ঠাট্টা ও বিদ্রূপকারী চরিত্রকেই কেন্দ্রীয় বিষয় বানানো হয়েছে। আর এটাই ‘আ সাইলেন্ট ভয়েস’ সিনেমার অনন্যতা।
অবিস্মরণীয় ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর
পরিচালক এতটা সূক্ষ্মতার সাথে সিনেমাটির পরিচালনা করেছেন যা আপনাকে এক সেকেন্ডের জন্যও মনে হতে দিবে না যে, “এই সিনটা দেখানোর কি দরকার ছিলো? বা এইটা না থাকলেও চলত কিংবা এটা বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে।” কাজেই সিনেমার প্রত্যেক মুহূর্ত, প্রত্যেক দৃশ্য আপনি উপভোগ করবেন। অত্যন্ত সুন্দরভাবে প্রত্যেকটা চরিত্রে ভূমিকা, সংলাপ আর স্ক্রিনপ্লে (screenplay) সাজানো হয়েছে যা প্রশংসনীয়।
সিনেমাটি এতটা গভীরে আপনাকে নিয়ে যাবে যেখান থেকে আপনি বেরিয়ে আসতে চাইবেন না। যেন বার বার একটা আকুতি আসে মন থেকে, এটি যেন শেষ না হয়। আপনি শুধু চাইবেন এটি চলতেই থাকুক। সিনেমার প্রত্যেকটা চরিত্রের সাথে জুড়ে থাকতে চাওয়ার প্রবণতা, বিশেষ করে ইশিদা’র (Ishida) বেস্ট ফ্রেন্ড ‘তমুহিরো (Tomohiro)’ চরিত্রটি আপনাকে অবশ্যই অবশ্যই একবারের জন্য হলেও আপনার বেস্ট ফ্রেন্ডের কথা মনে করিয়ে দিবে।
সিনেমাটির ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর (background score) নিয়ে একটু না বললেই নয়। মানে, এত লো-টিউনের (low-tune) মিউজিক (music) যেভাবে মনে একটা গভীর ছাপ ফেলে আর সিন বাই সিন নিজেকে কানেক্ট করে তা সত্যি অনবদ্য। সিনেমা শেষ করার পরেও যা মস্তিষ্কে বাজতেই থাকবে। প্রত্যেকটা মিউজিক আলাদা আলাদা সব দৃশ্য মনে করিয়ে দিবে হয়তোবা চোখের সামনে ভাসিয়ে তুলবে। ‘আ সাইলেন্ট ভয়েস’ যা আপনাকে প্রত্যেক মুহূর্তে যেন অনুভব করায় “এটি তো আমারই গল্প!”