সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় ও বাপ্পি লাহিড়ী: সঙ্গীত জগতের দুই কিংবদন্তি
কলকাতার সঙ্গীতময় সন্ধ্যা থেকে মুম্বাইয়ের ডিস্কো রাজা পর্যন্ত: দুই শিল্পীর জীবনের গল্প ও সঙ্গীতের যাদু
কলকাতার ঢাকুরিয়ায় ১৯৩১ সালে জন্মগ্রহণ করেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। মা হেলপ্রভা এবং বাবা নরেন্দ্রনাথের ছয় সন্তানের মধ্যে তিনি অন্যতম। ছোট থেকেই দাদা রবীন্দ্রনাথ লক্ষ করেন বোনের সঙ্গীত প্রতিভা। বিশেষ কোন সুর কানে এলে বোন দাঁড়িয়ে পড়ে। তিনি বোনকে নিয়ে যান সঙ্গীতাচার্য যামিনী গাঙ্গুলির কাছে। উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের তালিমের সূত্রে বেঙ্গল মিউজিক কনফারেন্স ও অল ইন্ডিয়া মিউজিক কনফারেন্সে নজরে আসেন গুণীজনের।
সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের বেসিক গানের প্রথম রেকর্ড
মাত্র ১৪ বছর বয়সে, ১৯৪৫ সালে, বাংলা বেসিক গানের প্রথম রেকর্ড করেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। গিরীণ চক্রবর্তীর সুরে দুটি গান – “তোমার আকাশে ঝিলমিল করে” এবং “ও তুমি ফিরায়ে দিয়াছো”। ১৯৪৮ সালে ফিল্মের ডাক পান এবং অঞ্জনগড় ও সমাপিকা ছবিতে গান করেন।
শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের নিবেদিত প্রাণ
সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন সন্তোষ কুমার বসু, অ টি কানন, চিনময় লাহিড়ীর কাছে। ১৯৪৬ সালে প্রথম হলেন ‘গীতশ্রী’ পরীক্ষায়। ভজনেও পরীক্ষক ছিলেন উস্তাদ মুহাম্মদ খান এবং রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
সঙ্গীত চর্চা ও মুম্বাই যাত্রা
দাদা নিয়ে যান সন্ধ্যাকে পন্ডিত জ্ঞান প্রকাশ ঘোষের কাছে। আর্জি জানালেন যদি তিনি বড়ে গোলাম আলি খানের কাছে শেখার সুযোগ করে দেন। উস্তাদজীর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র মুনাব্বর আলী খানের কাছে শিক্ষা জারি রাখেন। ১৯৫০ সালে সন্ধ্যা চলে যান মুম্বাই। প্রথম ছবি অনিল বিশ্বাসের সুরে ‘তরানা’, যেখানে তাঁর সঙ্গে লতা মঙ্গেশকর গেয়েছিলেন।
কলকাতায় ফেরা ও প্রেমের গান
কিন্তু বছর দুয়েক পরে তিনি ফিরে আসেন কলকাতায়। ততোদিনে গাওয়া হয়েছে ১৭টি হিন্দি ছবিতে। শচীন কর্তার সুরে ‘সাজা’ ছবিতে “গুপচুপ গুপচুপ পেয়ার করে” এবং লতার সঙ্গে গাওয়া “বোল রে পাপিয়া বোল”। কলকাতায় ফিরে এলে কবিগণের সক্রিয় হয়ে ওঠা তাঁদের কলম নিয়ে।
প্রেম ও পরিণয়
“আমি এতো যে তোমায় ভালবেসেছি” -এ যে আজও একটি নিখাদ প্রেমের গান। একদিন আকাশ বাণীর স্টুডিওতে গায়ক মানবেন্দ্র ও গীতিকার শ্যমল গুপ্ত বসে আছেন একসঙ্গে। নানা ধরণের গল্প কিন্তু শ্যামল তো বলছেন শুধু সন্ধ্যার কথা। সন্ধ্যার গলার কাজ, দায়িত্ববোধ, সুচারু সাজ ইত্যাদি নিয়ে কথা বলছেন। হঠাৎ সিগারেটের প্যাকেট থেকে রাংতার কাগজ বের করে কিছু লিখে মানবেন্দ্রকে বললেন, “দেখ তো কেমন লাগছে কথা গুলো!”
গানের ধারাবাহিকতা ও পদশ্রী না নেবার কারণ
“এই পথ যদি না শেষ হয় কার দিকে তাকাবো” – গানে শিহরন জাগা প্রেমের গান। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের পদশ্রী না নেবার কারণ ছিলো তাঁর অগুণিত প্রিয় শ্রোতা। নবতিপর শিল্পীকে এভাবে অপমান করা উচিত ছিলো না। অনেক আগেই তাঁকে ‘ভারতরত্ন’ পুরস্কারে সম্মানিত করা উচিত ছিলো।
গায়িকা নন সাধিকা
সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় গায়িকা নন, সাধিকা। উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের পরে আধুনিক গানের সম বদলে ফেলতেন গায়কী। তাঁর দক্ষতা ছিলো অসাধারণ। বাংলা দেশের মুক্তিযুদ্ধে সন্ধ্যা আর এক ভূমিকায়। শরণার্থীদের পাশে দাঁড়াতে গানটি মাধ্যম করলেন। তাঁর প্রয়াসে কলকাতায় গড়ে ওঠে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র।
ডিস্কো কিং খ্যাত বাপ্পি লাহিড়ী
“ইয়াদ আ রহে তেরে পেয়ার” – বাপ্পি লাহিড়ী। টানা তিন/চার দশক ধরে চলছে এই গান। জনপ্রিয়তার তুঙ্গে এখনো। অনেক ‘কন্ঠী’ আজকাল এই গান গেয়ে তাঁদের রুজি রোজগার চালান। ১৯৭৫ এ মুক্তি পাওয়া, “চলতে চলতে মেরে ইয়ে গীত ইয়াদ রখনা”।
বাপ্পি লাহিড়ীর পিতামাতা
সুনাম খ্যাত অপরেশ ও বাঁশুরী লাহিড়ী। সব ‘কন্ঠী’ শিল্পীদের ‘শরাবী’, ডিস্কো ড্যান্সার, গুরুদক্ষিণা, অমর সঙ্গীর গান গাইতে হয়। এই জায়গায় বাপ্পি অনন্য। জনপ্রিয়তার পরতে পরতে ওতপ্রোত ভাবে তিনি জড়িত।
ডিস্কো ড্যান্সার মিথুন চক্রবর্তী ও বাপ্পি লাহিড়ী
মিথুন চক্রবর্তীর সাথে যুগল বন্দীতে ডিস্কো ড্যান্সার এক পরিশীলিত অপসংস্কৃতি ঠিকই। কিন্তু পালে হাওয়া লাগানো নৌকা মনে হয়। এই গানের জনপ্রিয়তা এখনো অটুট। যেমন বাপ্পির সুরে উষা উথুপের, “রামবা হো সামবা হো”।
বাঁধা নয় বাংলা, হিন্দির গন্ডিতে
“শরাবির”, “দে দে পেয়ার দে’র” কি থাকে না! “আল্লাহ্ মেঘ দে পানি দে ছায়া দে রে তুই” এর অনুসঙ্গ। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম বাপ্পি লাহিড়ী। ‘ডিস্কো কিং’ – চলে গেলেন ‘অবস্ট্রাকটিভ স্লিপ এপ্নিয়া’। “কভী অলবিদা ন কহনা” – তাঁরই সুরারোপিত গান। আজও জনপ্রিয়তায় অসীম। বাপ্পি লাহিড়ী চিরকাল জন মানসে বিরাজমান থাকবেন। চলতে চলতে কভী অলবিদা ন কহনা…