কলম

সোশ্যাল মিডিয়ায় আমাদের নাটকীয় ভূমিকা: আত্মপ্রকাশ থেকে সক্রিয়তাবাদ পর্যন্ত

মুক্ত গণমাধ্যমের জন্য সোশ্যাল মিডিয়ায় আমাদের ভূমিকা, যেখানে আব্দুল আক্কাসের বেটা/বেটির স্টেটাসই সবকিছু নির্ধারণ করে

- Advertisement -

সোশ্যাল মিডিয়ায় কমবেশি আমরা সবাই একটি প্রোফাইল নিয়ন্ত্রণ করে থাকি। বাস্তব জীবনের সাথে সোশ্যাল মিডিয়া জগতের বিস্তর ফারাক থাকতে পারে। সুনির্দিষ্ট কারণেই সোশ্যাল মিডিয়ায় আমাদের আলাদা-আলাদা ভূমিকা থাকে। হতে পারে আমরা সোশ্যাল মিডিয়ায় যতটা সরব, বাস্তব জীবনে ঠিক ততটাই নীরব।

কেন আমরা সোশ্যাল মিডিয়ায় নির্দিষ্ট ভূমিকা পালন করি?

১. আত্মপ্রকাশ ও পরিচিতি

সোশ্যাল মিডিয়ায় আমাদের নতুন করে নিজের পরিচয় বা উপস্থিতি জানানো বর্তমান প্রেক্ষাপটে একধরণের বাধ্যবাধকতা। শুধু তাই নয়! সোশ্যাল মিডিয়ায় যেভাবে ব্যক্তি-বিজ্ঞাপন দেওয়া সম্ভব তা খুব সম্ভবত আর কোনোখানে আজকের এই অন্তর্জালের দুনিয়ায় দেওয়া সম্ভব নয়। সোশ্যাল মিডিয়ায় এই আত্মপ্রকাশের কারণে মিলে যেতে পারে বন্ধুত্ব, প্রেম, ভালোবাসা থেকে শুরু করে কর্মসংস্থান পর্যন্ত।

ব্যক্তিগত ডায়েরির পাতার মধ্যে কিছু নোট করে রাখার চেয়ে বেশিরভাগ মানুষ মনে করেন সেটা কোনো সোশ্যাল মিডিয়ায় টুকে রাখলে বেশি সুরক্ষিত থাকবে। তাই আজকের যে সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যাপকতা সেখানে নিজস্বতা, স্বকীয়তা এবং সত্যের বাইরে গিয়ে কিছু করার জায়গা বোধহয় খুব বেশি নাই।

২. সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা

আধুনিক টেকনোলজি নিয়ে কথা বলতে গেলে ‘AI’ সম্পর্কে বর্তমানে অবহিত হওয়া আবশ্যিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমন যুগে এসেও যদি খাপছাড়া সোশ্যাল মিডিয়ার বাইরের মানুষ ভেবে নিজেকে খুব স্মার্ট মনে হওয়া শুরু হয় তাহলে খুব সম্ভবত আমরা আন-স্মার্ট থেকে যাবো। সোশ্যাল মিডিয়া আমাদের বহু তথ্য রোজরোজ দিচ্ছে কিন্তু “আপনি কি দেখবেন?” এবং “আপনি কি দেখবেন না?” এসবের নিয়ন্ত্রণও আপনাকে দিচ্ছে।

- Advertisement -

সুতরাং আপনি নির্ধারণ করুন আপনি সোশ্যাল মিডিয়ায় ঠিক কেন আছেন? সোশ্যাল মিডিয়ায় কি উদ্দেশ্যে লিখছেন? বলছেন? বা, কোনো পোস্ট কেন শেয়ার দিচ্ছেন?

আরো একটি বড় কারণ হলো, ‘FOMO (Fear of Missing Out)’। ভীড়ের সাথে না থাকাটাও তো একধরণের ভয়। অথবা, সামাজিকভাবে আমরা আমাদের গ্রহণযোগ্যতার মাপ বর্তমান সময়ে সোশ্যাল মিডিয়া ছাড়া কীভাবে নেবো? খুব সম্ভবত সোশ্যাল মিডিয়ায় মিলে যাওয়া বন্ধুত্ব, লাইক, ফলোয়ার, কমেন্ট, গ্রুপ, ইভেন্ট ও যে-কোনো প্রতিক্রিয়া আমাদের আনন্দ দেয়, আবার ঈর্ষান্বিতও করে তোলে। ডোপামিন, সেরোটোনিন, অক্সিটোসিন, এন্ডোরফিন, কর্টিসল ইত্যকার কেমিক্যালের হরদম খেল-তামাশা একসাথে এই সোশ্যাল মিডিয়া জগতে পাওয়া যায়।

একটা সময় পর ফেসবুকে থাকতে আমার আর মন চাইতো না। কিন্তু অনেক অনেক খুঁজেও এর ব্যতিক্রম কিছুই পাইনি যেখানে অন্তত আমার কাছের মানুষদের সবাই আছে। সুতরাং ফেসবুকে আমার উপস্থিতি হলো একধরণের বাধ্যবাধকতা। একই সাথে ব্লগার হিসেবে ফেসবুকীয় মন্তব্যের প্রতি খুব বেশি জোর না দিলেও ফেসবুকীয় প্রভাব দেখে ঈর্ষান্বিত না হয়ে পারা যায় না। প্রায় সব দলের, মতের, ধর্মের, আদর্শের মানুষ এখানে উপস্থিত থাকায় নিজের লেখাটুকু দ্রুত ছড়িয়ে দেওয়ার পাশাপাশি একটু ঝালিয়ে নেওয়াও হয়ে যায়।

ফলে অন্তত লেখালেখি যারা করেন বা করছেন তারা নিজের লেখাটুকু এখানে সহসাই ঝালিয়ে নিতে পারবেন। আমার মতে ব্লগার’রা একটু ভদ্রলোক মত হোন, সেক্ষেত্রে কাঁচা সমালোচনা কেউ করেন না, গালিগালাজ করেন না। সোশ্যাল মিডিয়ায় এসব ফ্রি-তে পাওয়া যায় এবং একধরণের সামাজিক গ্রহণযোগ্যতাও মিলে যায়।

৩. আনন্দ ও বিনোদন

বর্তমান সময়ে সবচেয়ে বেশি আসক্তির নাম হলো, রিলস্‌। আমাদের ধৈর্য্য কমছে, আমরা কোথাও না কোথাও প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে উঠছি। দীর্ঘ আধা-ঘন্টা থেকে একঘন্টার ভিডিও দেখার সময়ও সবার হাতে থাকে না। আরো সহজ করে বললে, আমরা সময় দিতে হয়তো চাই-না। তাই ৩০ সেকেন্ডের রিলস্‌! টিকটকের মত সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যাপক জনপ্রিয়তা সহ কিছু সময় নষ্ট। আনন্দ ও বিনোদনের জন্য একটি স্মার্টফোন এবং ডাটা নিয়ে বসুন এবং একটার পর একটা রিলস্‌ দেখুন।

- Advertisement -

এই রেসিপি মস্তিষ্কের যাবতীয় কেমিক্যালের সঙ্গে খেলাধূলা করবে। ভয়, রাগ, আনন্দ, হাসি, হতাশা, আশা, আবেগ… সব একসাথে এখানেই পাবেন। সবাই তো আর ‘Activism’ করবেন না, করলে সেটা মানাবেও না, কেউ কেউ তো একটুখানি আনন্দ ও বিনোদনের উৎস হিসেবেও সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করবেন। এই নীরব দর্শক হিসেবে সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজের গভীর উপস্থিতির প্রমাণ দেওয়াও কারো কারো জন্য গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে।

৪. আত্ম-উন্নয়ন

সেদিন একটি ভিডিও দেখলাম (সংক্ষিপ্ত ভিডিও)। অজানা এক জায়গায় গাছের মগডালে উঠে হিন্দি গানে খুব সম্ভবত এক মেয়ে নাচছেন (অস্পষ্ট)। এখন ঐ ভিডিও দেখে আপনি নির্ধারণ করতে পারেন যে, আপনি কি এখন হাসবেন? কাঁদবেন? আফসোস করবেন? আপনি নিজেও কি গাছের মগডালে চড়বেন? ইত্যাদি। এসকল ভিডিও দেখার মাধ্যমে আপনি আপনার প্রতিক্রিয়া নির্ণয় করতে পারেন। যেমন আমি ঐ ভিডিওটা দেখে যেটা বুঝলাম, গাছের মগডালে উঠেও হিন্দি গানে কিন্তু নাচা যায়।

আবার ধরুন, আব্দুল আক্কাসের মেয়ে খুব ক্ষেপে গিয়ে বেশ লম্বাচওড়া একটি মস্তিষ্ক বিহীন পোস্ট লিখেছেন। আপনি আক্কাসের মেয়ের বন্ধু তালিকায় আছেন। সারাদিনের ক্লান্তি নিয়ে ফেসবুকে ঢুকতেই দেখলেন আক্কাসের মেয়ে ক্ষেপে গেছে এবং ক্ষেপে গিয়ে কি যে লিখেছে সে বিষয়ে দূরদূর পর্যন্ত আপনার কোনো ধারণা নাই। সুতরাং উক্ত পোস্টে আপনি কি মন্তব্য করবেন?

(ক) অসাধারণ (খ) দুর্দান্ত (গ) খুব বেশি খারাপ লেখো নাই (ঘ) মধু! তুমি যা লেখো না মাইরি!

৫. যোগাযোগ

চিঠির যুগ শেষ। এবার সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘন্টার পর ঘন্টা কথা চলবে। শুধু খেয়াল রাখবেন আপনাদের স্ক্রিনশট আবার ভাইরাল না হয়ে যায়। ওতে অবশ্য আমাদের কোনো আগ্রহ নাই কিন্তু আব্দুল আক্কাসের বেটা/বেটি থেকে রেহাই পাবেন না। তাই সাবধান!

- Advertisement -

৬. সক্রিয়তাবাদ (Activism)

মনে করুন, আমরা যারা গত ৮-১০ বছর ধরে লিখেই যাচ্ছি একেবারে বিনা পারিশ্রমিকে। মুক্ত গণমাধ্যমের জন্য কলামের পর কলাম, পোস্টের পর পোস্ট, ব্লগের পর ব্লগ লিখে গেছি। যে-ই না মুক্ত গণমাধ্যম আমাদের সামনে এলো প্রথমে আমরা-ই হয়ে গেলাম ‘ডাল-ভাত’।

এখন আব্দুল আক্কাসের বেটা/বেটিও এক্টিভিজম শুরু করে দিয়েছে। এখন কোনো মুসিবত সামনে এলে আমরা আর কলম থুক্কু কি-বোর্ড ধরার সময় হাতেই পাচ্ছি না ওদিকে আব্দুল আক্কাসের বেটা/বেটি তিনবেলা ভাত না খেয়ে স্টেটাস দেওয়া শুরু করে দিয়েছে ফেসবুকে। এই যে মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতা এটাকে শ্রদ্ধা জানাই। এজন্য হলেও আমাদের সোশ্যাল মিডিয়ায় থাকা জরুরী।

কবি ডগলাসের বিখ্যাত কবিতার একটি লাইন মনে পড়ে গেলো, “সবাই গায়ক যদি হতে চাও, নীরব শ্রোতাটি হবে কে তবে!”

দিনশেষে আমাদের ব্যস্ততা আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। কারণ আব্দুল আক্কাসের বেটা/বেটি জানেন না যে, কখন ঠিক কি বলা উচিত এবং কখন কি বলা উচিত নয়! হোক সেটা মুক্ত গণমাধ্যম। তাই আমরা সত্যতা যাচাই করতে করতে একাধিক ভুল পার্সেপশন মানুষের মধ্যে প্রবেশ করছে। আমাদের বুদ্ধিজীবীতার ভূমিকা বেকার অবস্থায় দাঁড়িয়েছে। এখন সবই আব্দুল আক্কাসের বেটা/বেটি জানেন। তাই আমরা সত্যতা যাচাইকরণে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছি, মানুষ আমাদের ভুল বুঝছে।

- Advertisement -

উপসংহার

আর একারণেই আমাদের সোশ্যাল মিডিয়ায় থাকা জরুরী। কারণ আমরা অন্তত আরো একটা দাঙ্গা, আরো একটা গণহত্যা চাই না। কারো সাথে আরো একবার অন্যায় হোক সেটাও চাই না। আমাদের এজন্যই সোশ্যাল মিডিয়ায় থাকতে হয়। সবার জন্য বাক-স্বাধীনতা রইলো। কিন্তু আমাদের বিনা পারিশ্রমিকের কাজে ব্যস্ততা আরো বেড়েই গেলো।

ছবি: Designed by Freepik

- Advertisement -
- Advertisement -

মেহেদি হাসান (বিকেল)

প্রধান সম্পাদক, অভিযাত্রী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

- Advertisement -
Back to top button