হযরত খান জাহান আলী (রহঃ): ইসলামের প্রচারক ও জনহিতকর মহাপুরুষ
বাংলাদেশের ইতিহাসে এক অনন্য ব্যক্তিত্বের জীবন ও কর্ম
হযরত খান জাহান আলী (রহঃ)
বাংলাদেশে যেসব ওলী আউলিয়াদের মাধ্যমে ইসলামের প্রচার ও প্রভাব ঘটেছে, তাদের মধ্যে হযরত খান জাহান আলী (রহঃ) অন্যতম। প্রথমে তিনি যোদ্ধা ও শাসক হিসেবে পরিচিত ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি ধর্ম চিন্তা এবং জনসেবাতেই নিয়োজিত হন। মানুষের কাছে তিনি একজন অলৌকিক ক্ষমতাবান মহাপুরুষ ছিলেন। আমরা আজকে এই মহান আউলিয়ার সম্পর্কে বিস্তারিত জানবো।
প্রাথমিক জীবন
হযরত খান জাহান আলী ১৩৬৯ খ্রিস্টাব্দে দিল্লীর এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি উলুগঘ খান নামেও পরিচিত ছিলেন। তার পিতার নাম ছিলো আকবর খাঁ এবং মাতার নাম ছিলো আম্বিয়া বিবি। ধারণা করা যায় যে তার পূর্বপুরুষগণ তুর্কির জাতিভুক্ত ছিলেন। হযরত খান জাহান আলীর প্রাথমিক শিক্ষা তার পিতার কাছ থেকেই শুরু হয়। পরবর্তীতে দিল্লীর বিখ্যাত অলীয়ে কামিল পীর শাহ নেয়ামত উল্লাহর কাছ থেকে তিনি মাধ্যমিক শিক্ষা গ্রহণ করেন। সে সময় তিনি কোরআন, হাদীস ও ফিকহ শাস্ত্রের উপর অধিক জ্ঞান অর্জন করেন।
পরিবার
খান জাহান দুইবার বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। প্রথমে তিনি তার পীর নুর কুতুবুল আলমের একমাত্র মেয়েকে বিয়ে করেন, যার নাম ছিলো সোনা বিবি। পরবর্তীতে তিনি একজন ধর্মান্তরিত মুসলমান রূপা বিবি ওরফে বিবি বাগুনিকে বিয়ে করেন। খান জাহান আলী তার দুই স্ত্রীর নাম অনুসারে সোনা মসজিদ ও বিবি বেগুনী মসজিদ নামে দুটি মসজিদ নির্মাণ করেন।
ইসলামের প্রচার
হযরত খান জাহান আলী তার শিক্ষা জীবন শেষ করে ১৩৮৯ খ্রিস্টাব্দে তুঘলক সেনাবাহিনীতে সেনাপতি পদে যোগদান করেন। তার কাজের দক্ষতার কারণে তিনি অল্প সময়ে প্রধান সেনাপতিতে উন্নীত হন। তিনি ১৩৯৪ খ্রিস্টাব্দে মাত্র ২৬-২৭ বছর বয়সে জৈনপুর প্রদেশের জাবিতান (গভর্নর) পদে যোগদান করেন। সেই সময় জৈনপুরের সুলতান ছিলেন ইব্রাহিম শর্কি। এ সময়ে গৌড়ের সামাজিক ও ধর্মীয় অবস্থা করুণ ছিলো। সে সময় গৌড় শাসন করতেন রাজা গনেশ। মুসলিমদের উপর রাজা গনেশ অনেক কঠোর ছিলেন। বাংলার ইসলাম রক্ষা ও প্রচারের জন্য সুলতান ইব্রাহিম শর্কি তখন হযরত খান জাহান আলীকে প্রধান সেনাপতির দায়িত্ব দিয়ে ৬০ হাজার সৈন্যকে নুরই কুতুবুল আলমের কাছে পাঠান। হযরত খান জাহান আলী তার ১১ জন আধ্যাত্মিক অনুসারী ও ৬০ হাজার সৈন্য নিয়ে গণেশের রাজধানী গৌড় আক্রমণ করেন। যুদ্ধে গনেশ পরাজিত হয়ে নুরই কুতুবুল আলমের কাছে প্রাণ ভিক্ষা চান। পরে তিনি তাকে ক্ষমা করে দেন। পরবর্তীতে চারদিকে ইসলাম ও মুসলিমদের দুরাবস্থা দেখে খান জাহান আলী সমাজ সেবা ও ইসলাম প্রচারের কাজে বেরিয়ে পড়েন। খান জাহান আলী গৌড় হতে পদ্মা নদী দিয়ে কুষ্টিয়ার মেহেরপুরের নিকটবর্তী ভৈরব নদীতে আসেন। সেখান থেকে ঝিনাইদহ ও চুয়াডাঙ্গা হয়ে যশোরের বারোবাজারে পৌঁছান তিনি। বারোবাজারে থাকাকালীন সময়ে খান জাহান আলী মানব কল্যাণে সেখানে দিঘী ও মসজিদ নির্মাণ করেন। তিনি ইসলামের খেদমত ও ধর্ম প্রচারের জন্য বাগেরহাটে এসে পৌঁছান। সেখানে তিনি যশোর, খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা ও বরিশালের কিছু অংশ নিয়ে খলিফাবাদ নামে একটি রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। খলিফাবাদ রাজ্যের প্রশাসনিক কেন্দ্র ছিলো বাগেরহাট জেলার ষাট গম্বুজ মসজিদ। খলিফাবাদের প্রশাসক হিসেবে তার ভূমিকা তাকে স্থানীয় জনগণের কাছে ইসলাম ধর্ম প্রচার করতে কোনো বাধা দেয়নি। বরং দিঘী খনন করে বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা করার কারণে স্থানীয় হিন্দুরা ইসলামের প্রতি বেশি আকৃষ্ট হন। হযরত খান জাহান আলী একজন যোদ্ধা হিসেবে বাংলাদেশে আসলেও তিনি জনহিতকর কাজ ও ইসলাম ধর্ম প্রচারক হিসেবে শত শত বছর ধরে মানুষের কাছে পরিচিত।
শাসনকাল
হযরত খান জাহান আলী একজন আউলিয়া, একজন ধর্ম প্রচারক, একজন যোদ্ধা এবং একজন শাসক ছিলেন। তিনি বৃহত্তর যশোর ও খুলনা জেলার অংশবিশেষ নিয়ে গঠিত এলাকার আঞ্চলিক শাসক ছিলেন। পনেরো শতকে খান জাহান আলী ওই অঞ্চলের মানুষের জীবনযাপনের মান উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখেন। তিনি মানুষের প্রয়োজনীয়তা চিহ্নিত করে কাজ করতেন। তার কাজের ধরনই ছিলো এমন যে যেখানে ঘাঁটি স্থাপন করে অবস্থান করতেন সেখানে জনহিতকর কাজও করতেন। তিনি স্থানীয় মানুষের মৌলিক সমস্যার সমাধানে বিশাল বিশাল দিঘী খনন করেন এবং প্রতিটি দিঘীর সাথে একটি করে মসজিদ নির্মাণ করেন। তিনি সবসময় সরল জীবনযাপন করতেন এবং তার অনেক শিষ্য ছিলেন। তার মধ্যে প্রধান হলেন শায়খ মুহাম্মদ তাহির যাকে খান জাহান আলীর কাছেই সমাহিত করা হয়েছে। হযরত খান জাহান আলী (রহ) এর অসাধারণ ব্যক্তিত্ব, ইবাদত, কারামত ও জনসেবা ব্যাপকভাবে লোকমুখে ছড়িয়ে পড়ে।
জনহিতকর কাজ
হযরত খান জাহান আলী তার শাসনামলে ইসলাম প্রচারের পাশাপাশি মানব কল্যাণেও প্রভাব ফেলেন। তিনি সুলতান ইব্রাহিম শর্কির নিকট থেকে সুন্দরবনের কিছু অংশ গ্রহণ করেন এবং সেখানে বন জঙ্গল কেটে মানুষের বসতির উপযুক্ত করে তোলেন। লোনা পানির অঞ্চলে তিনি মিঠা পানির ব্যবস্থা করেন এবং অনেক বিশাল বিশাল দিঘী খনন করেন যা খান জালী দিঘী নামে পরিচিত। তিনি অনেক সুপ্রশস্ত রাস্তাঘাটও তৈরি করেছেন। তার নির্মিত রাস্তা খান জালীর জাঙ্গাল নামে পরিচিত। তিনি বারবাজার হতে বাগেরহাট পর্যন্ত ৭০ মাইল যে রাস্তা নির্মাণ করেছেন তা এখনো খান জালীর রাস্তা নামে পরিচিত। হযরত খান জাহান আলী ইসলামের শিক্ষা বিস্তারের জন্য বিভিন্ন জায়গায় মসজিদ ও মাদরাসা নির্মাণ করেন। তিনি বাগেরহাটে নয় গম্বুজ ও ষাট গম্বুজ মসজিদ নির্মাণ করেন। এই ষাট গম্বুজ মসজিদটি যেমন নামাজের স্থান ছিলো তেমনই এটি ছিলো সেনানিবাস। তার এরকম জনহিতকর কার্যের জন্য জনগণের কাছে তিনি প্রিয় পাত্র হয়ে উঠেন এবং খান জালালি পীর নামে পরিচিত হন।
মৃত্যু ও মাজার
হযরত খান জাহান আলী অক্টোবর ২৫, ১৪৫৯ তারিখে অর্থাৎ ৮৬৩ হিজরীর ২৬ শে জিলহাজ মাসে ইন্তেকাল করেন। তিনি তার নিজের নির্মিত ষাট গম্বুজ মসজিদে এশার নামাজরত অবস্থায় মারা যান। সে সময় তার বয়স ছিলো ৯০ বছর। তিনি নাসিরউদ্দিন মাহমুদ শাহের সময় বা তার কিছু পরে মারা যান। বাগেরহাটের খান জাহান আলী দিঘীর উত্তর পারে এক উচ্চ ভূমিতে তাকে সমাহিত করা হয়। তার সমাধি সৌধটি পরবর্তীতে খান জাহান আলীর মাজার নামে পরিচিতি লাভ করে। মাজারের উপরে একটি গম্বুজ রয়েছে। এর আয়তন চারিদিকে ৪২ ফুট করে এবং প্রাচীরের উচ্চতা ২৫ ফুট। সমাধিসৌধটির স্থাপত্যকলা খানেকটা ষাট গম্বুজ মসজিদের ন্যায়। শিলালিপিতে মৃত্যু তারিখ, দাফন তারিখসহ আল্লাহর নাম, কোরানের কয়েকটি সুরা এবং তার উপর আল্লাহর শান্তি বর্ষিত হোক ইত্যাদি লিপিবদ্ধ আছে। প্রতিদিন হাজার হাজার ভক্ত দেশ বিদেশের বিভিন্ন স্থান হতে তার রুহানী দোয়া লাভের আশায় মাজার জিয়ারত করতে আসেন। এছাড়া প্রতি বছর ২৫ শে অগ্রহায়ণ এই মাজার শরীফে বার্ষিক ওরস উদযাপন হয়। এই ওরসে দূর দূরান্ত হতে হাজার হাজার ভক্তরা শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য তার মাজারে সমবেত হন। এছাড়া চৈত্র মাসের প্রথম পূর্ণিমায় এই মাজারে বার্ষিক সম্মেলন উপলক্ষে এক বিশাল মেলা অনুষ্ঠিত হয়। বিভিন্ন দর্শনার্থীরা এখানে আসেন তাদের মানত পূরণ করতে।
খান জাহান আলী মাজারের আরেকটি আকর্ষণীয় কেন্দ্রবিন্দু হল তার দিঘীর কুমির। ২০০ একর আয়তনের এই বিশাল দিঘী খনন করার পর এর পানি যাতে কেউ নষ্ট করতে না পারে সে জন্য তিনি সেখানে এক জোড়া মিঠা পানির কুমির ছেড়ে দেন। খান জাহান আলীর কুমিরের রয়েছে দীর্ঘ কিংবদন্তি ইতিহাস। এই দিঘীর কুমির ধলা পাহার ও কালা পাহার এর ইতিহাস অনেকেরই জানা। অনেকের মতে, খান জাহান আলী দুইটি জ্বিনকে তার বশীভূত করে এই দিঘীতে ছেড়ে দেন। কালা পাহার ও ধলা পাহারের মৃত্যুর পর ২০০৫ সালে ভারতের মাদ্রাস থেকে ৬টি কুমির নিয়ে আসা হয়। এই ৬টি কুমিরের মধ্যে এখন আর দুইটি কুমির জীবিত রয়েছে। এই দুইটিই এখন কালা পাহার ও ধলা পাহার নামে খ্যাত।
পয়েন্টসমূহ
প্রাথমিক জীবন:
- জন্ম: ১৩৬৯ খ্রিস্টাব্দে দিল্লীতে
- পিতার নাম: আকবর খাঁ
- মাতার নাম: আম্বিয়া বিবি
- শিক্ষা: কোরআন, হাদীস ও ফিকহ শাস্ত্র
পরিবার:
- প্রথম স্ত্রী: সোনা বিবি
- দ্বিতীয় স্ত্রী: রূপা বিবি ওরফে বিবি বাগুনি
- মসজিদ নির্মাণ: সোনা মসজিদ ও বিবি বেগুনী মসজিদ
ইসলামের প্রচার:
- সেনাপতি পদে যোগদান: ১৩৮৯ খ্রিস্টাব্দে
- জৈনপুর প্রদেশের জাবিতান পদে যোগদান: ১৩৯৪ খ্রিস্টাব্দে
- গৌড় আক্রমণ: ৬০ হাজার সৈন্য নিয়ে
শাসনকাল:
- বৃহত্তর যশোর ও খুলনা জেলার আঞ্চলিক শাসক
- জনহিতকর কাজ: বিশাল বিশাল দিঘী খনন ও মসজিদ নির্মাণ
জনহিতকর কাজ:
- বন জঙ্গল কেটে বসতির উপযুক্ত করা
- মিঠা পানির ব্যবস্থা
- সুপ্রশস্ত রাস্তাঘাট নির্মাণ
মৃত্যু ও মাজার:
- মৃত্যু: অক্টোবর ২৫, ১৪৫৯
- সমাধি: বাগেরহাটের খান জাহান আলী দিঘীর উত্তর পারে
- মাজারের আকর্ষণ: দিঘীর কুমির
উপসংহার
রিচার্ড এম ইটন নামে একজন আমেরিকান ইতিহাসবিদের লেখা ‘দ্যা রাইজ অব ইসলাম এন্ড দ্য বেঙ্গল ফ্রন্টিয়ার’ নামে বইয়ে বলা হয়েছে, সুন্দরবনের কাছে বাগেরহাট অঞ্চলে লবনাক্ত পানির বদলে মিঠা পানির ব্যবস্থা করার জন্য দিঘী খনন করে খান জাহান আলী জনপ্রিয়তা লাভ করেন। এছাড়া বিভিন্ন জনহিতকর কাজের জন্য ও একজন সৎ ইসলাম প্রচারক হিসেবে শত শত বছর ধরে তিনি মানুষের মনে রয়েছেন।