বড় পীর হযরত আব্দুল কাদের জিলানী (রহঃ): ইসলামের আলো ছড়ানো এক মহামানব
জন্ম, শিক্ষা, এবং কাদেরিয়া তরিকার প্রবর্তন থেকে শুরু করে তার অসাধারণ জীবন ও কর্মের বিবরণ
বড় পীর হযরত আব্দুল কাদের জিলানী ৪৭১ হিজরীতে ১ রমজান ইরাকের জিলান জেলার কাসপিয়ান সমুদ্র উপকূলের নাইদ নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি জিলান নামক শহরে জন্মগ্রহণ করায় তাকে জিলানী বলা হয়। তার উপাধি গাউসুল আযম, মহিউদ্দিন। তার পিতার নাম হযরত আবু সালেহ মুসা জঙ্গী (রহঃ) ও তার মাতার নাম সৈয়দা উম্মুল খায়ের ফাতেমা (রহঃ)। তারা পিতা মাতার দিক থেকে ইমাম হাসান ও হোসাইনের বংশধর ছিলেন।
প্রাথমিক শিক্ষা
হযরত আব্দুল কাদের জিলানী ছোটবেলায় তার বাবাকে হারান। তারপর থেকে তার আশ্রয় হলো নানাবাড়ি। তার নানা তাকে একটি মক্তবে ভর্তি করিয়ে দেন। প্রথমদিন মক্তবে এতোটাই শিক্ষার্থীর ভীড় ছিলো যে, আবদুল কাদের জিলানীর বসার মতো জায়গা ছিলোনা। এমতাবস্থায়, শিক্ষার্থীরা একটি গায়েবি আওয়াজ শুনতে পেলেন যে, “তোমরা আল্লাহর প্রধান অলীর জন্য জায়গা করে দাও।” তখন উপস্থিত ছাত্ররা সবাই চেপে বসে আব্দুল কাদের জিলানীকে বসার জায়গা করে দেয়। সেদিন মক্তবে আরো একটি ঘটনা ঘটে, মক্তবের ওস্তাদজি যখন তাকে আউযুবিল্লাহ ও বিসমিল্লাহর সবক দেন তখন তিনি আউযুবিল্লাহ, বিসমিল্লাহ থেকে শুরু করে একাধারে ১৮ পারা পর্যন্ত মুখস্ত বলেন। এটা দেখে ওস্তাদজিসহ সকলে অবাক হয়ে যান। ওস্তাদজি তাকে জিজ্ঞাসা করেন, “আজ তো মক্তবে তোমার প্রথম দিন তাহলে তুমি এগুলো শিখলে কোথা থেকে?” উত্তরে আব্দুল কাদের জিলানী (রহঃ) বললেন, “হুজুর, আমি যখন আমার মায়ের গর্ভে ছিলাম তখন আমার মা প্রত্যেকদিন কুরআন পাঠ করতেন, আর আমি তা শুনে শুনে মুখস্ত করেছি।”
দ্বীনি উচ্চ শিক্ষা
৪৮৮ হিজরিতে ১৮ বছর বয়সে হযরত আবদুল কাদের জিলানী দ্বীনি উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের জন্য বাগদাদে যাওয়ার ইচ্ছে পোষণ করেন। তিনি মাকে তার ইচ্ছার কথা জানালেন। তার মা তাকে অনুমতি দিলেন। যাওয়ার সময় তার মা তাকে ৪০ টি স্বর্ণ মুদ্রা জামার ভেতরে সেলাই করে দিলেন এবং বললেন, “আল্লাহর নাম নিয়ে রওয়ানা হও। সততা ও বিশ্বস্ততাকে নিজের আদর্শরূপে শক্ত হাতে ধারণ করবে।” তিনি বাগদাদে যাওয়ার সময় ডাকাতদের কবলে পড়েন। ডাকাত হযরত আব্দুল কাদের জিলানীকে জিজ্ঞাসা করলেন, “তোমার কাছে কি আছে?” তিনি বললেন, “আমার কাছে ৪০ টি স্বর্ণ মুদ্রা আছে।” ডাকাত সরদার তার কথায় অবাক হয়ে তাকে বললেন, “হে যুবক! তুমি তো মিথ্যা বলে স্বর্ণ মুদ্রাগুলো লুকাতে পারতে।” তখন আব্দুল কাদের জিলানী বললেন, “মিথ্যা কথা বলতে আমার মা আমাকে নিষেধ করেছেন।” কথাটি শুনে ডাকাত সর্দার অবাক হয়ে বললেন, “তুমি মায়ের আদেশ এভাবে পালন করো তাহলে আল্লাহর আদেশ কতইনা যত্নে পালন কর। হে যুবক! তুমি কোন সাধারণ মানুষ নয়, তুমি আমাকে কালেমা পরাও।” এই বলে ডাকাত দলের ৬০ জনই কালেমা পড়ে মুসলমান হয়ে গেলেন।
বাগদাদে শিক্ষা
বাগদাদ শহরে যাওয়ার পর তিনি শায়েখ আবু সাঈদ ইবনে মোবারক মাখযুমী হাম্বলী, ইবনে হোসাইন ইবনে মুহাম্মদ (রহঃ) এর নিকট ইলমে ফিকহ, শায়েখ আবু গালিব মুহাম্মদ ইবনে হাসান বাকিল্লানি, শায়েখ আবু সাঈদ ইবনে আবদুল কারীম ও শায়েখ আবুল গানায়েম মুহাম্মদ ইবনে মুহাম্মদ (রহঃ) এর নিকট ইলমে হাদীস এবং শায়েখ আবু যাকারিয়া তাবরেয়ী (রহঃ) এর নিকট সাহিত্যের উচ্চতর জ্ঞান লাভ করেন। তার গুরু শায়খ আবু সাঈদ মাখযুমি তার শীর্ষ আব্দুল কাদের জিলানীর যোগ্যতা ও প্রতিভা দেখে নিজের প্রতিষ্ঠিত মাদরাসার তত্ত্বাবধান ও পরিচালনার দায়িত্ব তাকে অর্পণ করে নিজে অবসর গ্রহণ করেন। আব্দুল কাদের জিলানী নিজে সেই মাদরাসায় হাদীস, ফিকহ, তাফসির ও অন্যান্য বিষয়ে শিক্ষাদান করেন। অল্প দিনের মধ্যেই মাদরাসাটির সুনাম চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লো এবং দেশ-বিদেশ হতে শিক্ষার্থীরা বিদ্যা লাভে ছুটে আসতে লাগলো।
গ্রন্থ রচনা
তিনি কাব্য, সাহিত্য, ইতিহাস, দর্শন, ভূগোল ইত্যাদি বিষয়ে পন্ডিত ছিলেন। তিনি বহু গ্রন্থ রচনা করেছেন। তার মধ্যে ফতহুল গায়েব, গুনিয়াতুত তালেবীন, ফথুর রবযানী, কালীদায়ে গাওসিয়া ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
ওয়াজ নসীহত
হযরত আব্দুল কাদের জিলানী শিক্ষা গ্রহণের উচ্চ মাকামে পৌঁছার পর তিনি নিজেকে ইসলাম প্রচারের কাজে নিয়োজিত করেন। তিনি বিভিন্ন জায়গায় মাহফিল করতেন। তার মাহফিলে মুসলমানদের পাশাপাশি অন্যান্য ধর্মের লোকেরাও সমবেত হতো। তিনি তার মাহফিলে ইসলামের আদর্শ সম্পর্কে যুক্তিসঙ্গত আলোচনা করতেন। যা শুনে অনেক অমুসলিমও ইসলাম গ্রহণ করতেন।
কাদেরিয়া তরিকার প্রবর্তক
হযরত আব্দুল কাদের জিলানী সারা বিশ্বে ইসলাম প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি মানুষদের আল্লাহ ও তার রাসূলের অভিমুখী হওয়ার জন্য বিভিন্ন আমলের শিক্ষা দিতেন। তিনি মুসলমানদের বিভিন্ন ভুল ভ্রান্তি দূর করার জন্য কোরআন ও সুন্নাহ মোতাবেক ইসলামের শিক্ষা দিতেন। তিনি কাদেরিয়া তরিকার প্রবর্তন করেন। এর শাখাগুলো দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিস্তৃত। যেমন, বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, ফিলিস্তিন, তুরস্ক, বলকান, ইন্দোনেশিয়া, রাশিয়া, চীন এবং পূর্ব ও পশ্চিম আফ্রিকায় এই তরিকার সন্ধান পাওয়া যায়। তরিকতের পদটি খুবই কষ্টকর। প্রতি পদে পদে এখানে রয়েছে প্রচুর বাধা বিপত্তি।
উল্লেখযোগ্য ঘটনা
১. হযরত আব্দুল কাদের জিলানী জন্মের পূর্বেই তার মাতৃগর্ভে থাকা অবস্থায় কোরআনের ১৮ পারা মুখস্ত করেছিলেন। ২. আব্দুল কাদের জিলানী নিজে বর্ণনা করেন, ছোটবেলায় তিনি যখন খেলতে যেতেন তখন একটি গায়েবি আওয়াজ শুনতে পেতেন, “হে বালক আমার দিকে এসো।” আবার, রাতে তিনি যখন ঘুমাতে যেতেন তখন একটি বাণী প্রতিধ্বনিত হতো, “হে আব্দুল কাদের, তোমাকে ঘুমানোর জন্য দুনিয়াতে পাঠানো হয়নি বরং অন্ধকার জগতের মানুষের মাঝে ইসলামের আলো পৌঁছানোর জন্য তোমাকে প্রেরণ করা হয়েছে।” ৩. তার জন্মের সময় রমজানের চাঁদ দেখা নিয়ে সংশয় সৃষ্টি হয়। এই সময় আব্দুল কাদের জন্মের পর সুবহে সাদিকে মায়ের দুগ্ধ পান করার পর ইফতার পর্যন্ত অনাহারে থাকতেন। যা দেখে সবাই বুঝতে পারেন যে, রমজান শুরু হয়ে গেছে। এইভাবে ৩০ টি রমজানই তিনি সুবহে সাদিক থেকে ইফতার পর্যন্ত অনাহারে থেকেছেন।
মৃত্যু
হিজরী ৫৬১ সালে ১১ রবিউসসানী, ৯১ বছর বয়সে আব্দুল কাদের জিলানী পরলোক গমন করেন। বর্তমান ইরাকের বাগদাদ শহরে তার মাজার রয়েছে। তার মৃত্যু বার্ষিকী ফাতেহা-ই-ইয়াজদাহাম হিসেবে পরিচিত। প্রতি বছর এই দিনটি অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে পালন করা হয়।
শেষ কথা
হযরত আব্দুল কাদের জিলানী (রহঃ) এর আদর্শিক জীবনধারা থেকে শিক্ষা নেওয়ার মতো অনেক কিছু রয়েছে। তার জীবনী থেকে শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হলোঃ
- আমরা বড়পীর হযরত আব্দুল কাদের জিলানী (রহঃ) এর আদর্শে আমাদের জীবন গড়ব।
- আমরা মহান আল্লাহর ইবাদত করব।
- সদা সত্য কথা বলব, কখনও মিথ্যা কথা বলব না।
- মাতা-পিতার কথা শুনব, তাদের অমান্য করব না।
- সততা ও বিশ্বস্ততাকে নিজের আদর্শরূপে গ্রহণ করব।
- ইসলামের আদর্শ প্রচার ও প্রসারে নিজেকে নিয়োজিত করব।
তথ্যবহুল টেবিল
বিষয় | তথ্য |
---|---|
জন্ম | ৪৭১ হিজরী, ১ রমজান |
জন্মস্থান | জিলান, ইরাক |
পিতার নাম | হযরত আবু সালেহ মুসা জঙ্গী (রহঃ) |
মাতার নাম | সৈয়দা উম্মুল খায়ের ফাতেমা (রহঃ) |
উপাধি | গাউসুল আযম, মহিউদ্দিন |
মৃত্যু | ৫৬১ হিজরী, ১১ রবিউসসানী |
মাজার | বাগদাদ, ইরাক |
উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ | ফতহুল গায়েব, গুনিয়াতুত তালেবীন, ফথুর রবযানী, কালীদায়ে গাওসিয়া |
উপসংহার
হযরত আব্দুল কাদের জিলানী (রহঃ) এর জীবন ও কর্ম আমাদের জন্য একটি আদর্শিক মডেল। তার জীবনের প্রতিটি অধ্যায় থেকে আমরা শিক্ষা নিতে পারি। তার সততা, বিশ্বস্ততা, এবং ইসলামের প্রতি তার অবিচল বিশ্বাস আমাদের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস। আমরা যদি তার আদর্শে আমাদের জীবন গড়ে তুলতে পারি, তাহলে আমরা একটি সুন্দর ও শান্তিপূর্ণ সমাজ গঠন করতে সক্ষম হবো।
Discover more from অভিযাত্রী
Subscribe to get the latest posts sent to your email.