সম্পাদকীয়

বাংলা অনলাইন: লেখকদের অবমূল্যায়ন, সম্পাদকীয় সংকট, এবং ডুবন্ত ব্লগ

অনলাইন মিডিয়ায় জ্ঞানীয় পক্ষপাতের ঝুঁকি

বিজ্ঞাপন

আমি দীর্ঘসময় ধরে ওপার ও এপার বাংলার একাধিক অনলাইন নিউজ ও ব্লগিং পোর্টালে সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা সম্পাদক হিসেবে কাজ করে যাচ্ছি। সামনের সময়ে দায়িত্ব ভাগাভাগি করার কথা ভাবছি, কিন্তু এখন পর্যন্ত দায়িত্ব দিয়ে খুব একটা ভালো ফলাফল পাইনি। আমার পরিকল্পনা রয়েছে ভবিষ্যতে আরো বড় অনলাইন ব্লগিং প্ল্যাটফর্মে যুক্ত হওয়ার। এজন্য এই লেখাটি ড্রাফট হিসেবে রাখতে চাই, যাতে আমাদের টিম যখন বড় হবে, তখন আমরা আমাদের ভূমিকা যেন ভালোমতো বুঝতে এবং পালন করতে পারি।

আমার মতে, এই কাজটি বেশ জটিল। কারণ, এই কাজে যে ধরণের পিরামিড অনুযায়ী কাজ করা উচিত যা সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হতে পারে, সে পরিমাণ লোকবল নিয়োগ দেওয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। যারা বাংলা নিউজ/ব্লগিং পোর্টালে অনেকদূর এগিয়ে গেছেন তারাও প্রয়োজনীয় লোকবল নিয়োগের প্রয়োজন বোধ করেন না অথবা, এমন মানুষদের খুঁজেই পাওয়া যায় না।

বর্তমান সময়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একজন বড় গ্রুপের অ্যাডমিন এমন ভাব নিয়ে থাকেন যে, তার মতাদর্শের সাথে যদি কোন পোস্ট, ব্লগ, আর্টিকেল বা লেখা না মিলে, তাহলে তিনি সেটি খারিজ করে দেন, মুছে দেন বা সরিয়ে ফেলেন। এমনকি আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান গ্রুপেও অ্যাডমিন মহাশয়দের বায়াসনেস লক্ষ্য করা যায়।

ফেসবুক কেন্দ্রিক কিছু গ্রুপের সদস্য সংখ্যা অনেক বেশি হয়ে যাওয়ায় অ্যাডমিনরা (সবাই নয়) একরকম প্রভুত্ব দেখান। হঠাৎ করে তারা তাদের দায়িত্বকে ক্ষমতা বলে ভুল মনে করেন। এখানে বলে রাখা ভালো, আমি সব গ্রুপের সকল অ্যাডমিনদের এমন সরলীকরণ করছি না, করা উচিতও নয়। তবে কোনটা ‘ক্ষমতা’ এবং কোনটি ‘দায়িত্ব’, এই শব্দগুলোর সাথে শুধু বাহ্যিক পরিচিতি থাকলে চলবে না। এসবের জন্য বাস্তবিক প্রয়োগ প্রয়োজনীয়।

সাধারণত একটি অনলাইন নিউজ পোর্টালে ৮ স্তরের সম্পাদক থাকেন,

বিজ্ঞাপন

১. প্রধান সম্পাদক (Editor-in-Chief)

‘প্রধান’ অর্থে তার প্রভুত্ব পুরো নিউজ পোর্টাল জুড়ে বিদ্যমান থাকে। তিনি সবকিছুই প্রায় নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন। কোন নিউজ বা খবর প্রকাশিত হবে এবং কোনটি হবে না, এসবকিছুর বিচার-বিশ্লেষণ করে তত্ত্বাবধানে থাকেন তিনি। তার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত হিসেবে বিবেচিত হয়। ফলে প্রধান সম্পাদক যদি জ্ঞানীয় পক্ষপাত দুষ্ট না হোন, তবেই সেই অনলাইন পত্রিকা বেশি গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠতে পারে। কারণ তিনি ঠিক করেন ঐ অনলাইন নিউজ পোর্টালের কমিউনিটি গাইডলাইন কি হবে? তিনি ঠিক করেন ঐ অনলাইন নিউজ পোর্টালের সম্পাদকীয় নীতি কি হবে?

ফেসবুকে যেকোনো গ্রুপের অ্যাডমিন প্রধান সম্পাদকের ভূমিকায় থাকেন। অধিকাংশ ফেসবুকীয় গ্রুপে মডারেটর পর্যন্ত থাকেন না। ফলে এখানে জ্ঞানীয় পক্ষপাত দুষ্ট বেশি হতে দেখা যায়। অ্যাডমিনরা তাদের মতাদর্শের সাথে না মিললে পোস্ট, ব্লগ, আর্টিকেল বা লেখা খারিজ করে দেন, মুছে দেন বা সরিয়ে ফেলেন।

২. ব্যবস্থাপনা সম্পাদক (Managing Editor)

একজন ব্যবস্থাপনা সম্পাদক ডেডলাইন শব্দ কে বিশেষভাবে খেয়াল রাখেন। কাজ দেওয়া এবং কাজ যথাসময়ে আদায় করে নেওয়া তার প্রধান দায়িত্ব। ব্যবস্থাপনা সম্পাদককে যে কোনো সম্পাদকের চেয়ে অনেক বেশি ব্যস্ত থাকতে হয় এবং একটি অনলাইন নিউজ পোর্টালে তার কাজ নিয়মিত করতে হয়। এছাড়াও, প্রধান সম্পাদকের অনুপস্থিতিতে তিনি প্রধান সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করে থাকেন।

ফেসবুক গ্রুপে এই পদের নাম দেওয়া যেতে পারে ‘মডারেটর’। কিন্তু এখানেও ফেসবুকের কিছু ঘাটতি থেকে যায়। কারণ, প্রধান সম্পাদক বা অ্যাডমিন সংখ্যা কখনোই অনলাইন নিউজ পোর্টালে একাধিক না হলেও, ফেসবুক গ্রুপে একাধিক অ্যাডমিন ও মডারেটর থাকেন। এমনকি মডারেটরের ক্ষমতা প্রায় অনেকাংশেই এডমিনের সমান। ফলে, ফেসবুক গ্রুপ বা কোন ব্লগিং সাইট এই পিরামিড অনুসরণ করতে সক্ষম হয় না।

৩. সংবাদ সম্পাদক (News Editor)

একটি অনলাইন নিউজ পোর্টালে সংবাদ সম্পাদক একটি গুরুত্বপূর্ণ পদ। এই পদটির গুরুত্বের কারণ হলো, একটি অনলাইন নিউজ পোর্টালে শুধুমাত্র খবর প্রকাশিত হয় না। সেখানে প্রতিবেদন, লাইফস্টাইল, রুপচর্চা, স্বাস্থ্য, জীবনী, ধর্ম, দর্শন, মনোবিজ্ঞান, বিজ্ঞানসহ একাধিক বিভাগ থাকে। এসব বিষয়ে একাধিক স্কলারের লেখাও আসে। ফলে, একজন সংবাদ সম্পাদক নির্ধারণ করেন কোন সংবাদ উপস্থাপন করা উচিত, কোন বিষয় নিয়ে সংবাদ হওয়া উচিত, এবং সংবাদের বিষয়বস্তু ও মান যাচাই করেন।

বিজ্ঞাপন

ফেসবুক বা ব্লগিং সাইটে এই ধরণের কোনো ফিচার নেই। অ্যাডমিন বা মডারেটর চাইলে ফিচার পোস্ট, পিন পোস্ট বা নির্বাচিত পোস্ট কোনটি হবে তা নির্ধারণ করেন। অর্থাৎ, এক ব্যক্তি তিনজনের কাজ করেন, যা জ্ঞানীয় পক্ষপাত দুষ্ট হতে বাধ্য।

৪. ডিজিটাল সম্পাদক (Digital Editor)

ডিজিটাল সম্পাদক প্রকাশিত সব লেখা বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেন। ব্রেকিং নিউজের ক্ষেত্রে টেমপ্লেট বা টেক্সটের মাধ্যমে তিনি সার্বক্ষণিক পাঠকদের মনোযোগ ধরে রাখেন। এছাড়াও, তিনি বিভিন্ন উৎসব ও আয়োজনে শুভেচ্ছা জানান।

ফেসবুক গ্রুপেও অ্যাডমিন বা মডারেটর এই দায়িত্ব পালন করেন। তারা গ্রুপে মানুষদের ইনভাইট করেন এবং বিভিন্ন উৎসব ও আয়োজনে শুভেচ্ছা জানান। এটি এককেন্দ্রিক বিবেচনায় নেওয়া যেতে পারে। একজন অ্যাডমিন/মডারেটর একই সাথে এই সবগুলো সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন, যা উক্ত ব্লগ বা ফেসবুক গ্রুপের মান কমাতে পারে।

৫. কপি সম্পাদক (Copy Editor)

কপি সম্পাদক লেখক বা রিপোর্টারদের বানান, ব্যাকরণ এবং লেখার শৈলী খুব সুচিন্তিতভাবে খেয়াল করেন। এমনকি সামান্য যতিচিহ্নের ভুল হলেও তিনি লেখক/রিপোর্টারদের জানান বা নিজে থেকেই সংশোধন করেন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, ব্লগিং সাইট এবং ফেসবুক গ্রুপে এমন কোন পদ-ই নেই। ফলে এখানে লেখার মানের প্রতি তেমন কেউ খেয়ালও রাখেন না। খুব বেশি ভুল হলে পাঠক খোদ এসে হয়তো বলেন, “জনাব, আপনার লেখাতে বানানের অনেক সমস্যা পাচ্ছি।”

এতে করে কোন ব্লগিং সাইট বা ফেসবুক গ্রুপ লেখক/ব্লগার তৈরি করতে পারছে না। শুরুর দিকে বাংলা ব্লগগুলোতে হাতে ধরে লেখা শেখানোর বিনয়ী নিয়ম থাকলেও এখন অবহেলা বেশি দেখা যায়।

বিজ্ঞাপন

৬. প্রুফরিডার (Proofreader)

প্রুফরিডার যে কোন লেখা প্রকাশের আগে সর্বশেষ একবার চোখ বুলিয়ে দেখেন যে, কোন ভুল থাকলো কিনা। যদি তিনি কোন ভুল বা লেখার মধ্যে সমস্যা দেখতে পান, তাহলে সেটা প্রকাশের আগেই সংশোধন করেন বা বাতিল করে দেন। এই পদ এখন এতটাই বিরল যে, অনলাইন নিউজ পোর্টালেও খুব বেশি বানান ভুল হতে দেখা যায়। আর ব্লগিং সাইট বা ফেসবুক গ্রুপের অবস্থা তো আরও খারাপ।

৭. সম্পাদনা সহকারী (Editorial Assistant)

সম্পাদনা সহকারী পুরো সম্পাদকীয় প্রশাসনকে একটি সুনির্দিষ্ট কাঠামোর মধ্যে রাখেন। তিনি সম্পাদক, রিপোর্টার, লেখক, এজেন্ট এবং বিজ্ঞাপনদাতাদের সাথে কাজের সমন্বয় ঘটান। বড় বড় অনলাইন নিউজ পোর্টালে এমন পদ এখনো আছে, তবে সবাই এই পদ রাখেন না বা রাখতে পারেন না। এতে করে প্যানেল উক্ত নিউজ পোর্টালের চেয়ে অনেক বড় হয়ে যেতে পারে। ফেসবুক বা ব্লগিং সাইটেও এমন কোন পদ নেই। অ্যাডমিন বা মডারেটর এই দায়িত্বও পালন করেন।

৮. সহকারী সম্পাদক (Assistant Editor)

সহকারী সম্পাদকের কাজ হচ্ছে তার সিনিয়র সম্পাদকদের কাজে সহায়তা করা। অনেক কমিউনিটি গাইডলাইন, সম্পাদকীয় নীতি, ভুল টেমপ্লেট বা বানান হয়তো কারো চোখেই পড়ে না, তিনি এই জায়গায় এসে সে সম্পর্কে সিনিয়রদের জানান, অবগত করেন বা পরামর্শ দেন। বেশিরভাগ অনলাইন নিউজ পোর্টালে এই ধরণের পদ নেই বলা চলে। ফলে অনেক কিছুই দৃষ্টিগোচর থেকে যায়।

বাংলাদেশের অনলাইন নিউজ পোর্টালের অধিকাংশই ওয়ান ম্যান/উইমেন আর্মি বলা যেতে পারে। এখানে প্রধান সম্পাদক ও সহ-সম্পাদক সব কাজ করেন। ব্লগিং সাইট বা ফেসবুক গ্রুপের অবস্থা আরও খারাপ। সেখানে কিছু কিছু ফেসবুক গ্রুপ বা ব্লগ আছে, যেখানে নিয়মিত লেখক সংখ্যা চারজন, কিন্তু অ্যাডমিন ও মডারেটরের সংখ্যা ১৪ জন।

বাংলাদেশের বাংলা ব্লগগুলো ডুবতে বসেছে। আমার মতে, এর সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে বাংলা লেখকদের মূল্যায়ন না করা। এই সমস্ত ব্লগ (সামহোয়্যারইন ব্লগসহ) লেখকদের সম্পদ বলে মনে করা ছেড়ে দিয়েছে। এখন একজন লেখক তার সময় নষ্ট করে ফ্রি-তে একটি প্রবন্ধ উপহার দিচ্ছেন। এপ্রুভ করার ক্ষেত্রে অতিরিক্ত সেন্সরশিপ যেমন লেখনীতে বাধা হতে পারে, তেমনি লেখকদের/ব্লগারদের ব্যক্তি আক্রমণ থেকে বাঁচানো সময়ের দাবী হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বিজ্ঞাপন

মুশকিল হচ্ছে, কোন ফেসবুক গ্রুপ, ব্লগ সাইট বা নিউজ পোর্টাল যদি তাদের প্ল্যাটফর্মে কোন লেখা শুধু প্রকাশ হচ্ছে বলে লেখকদের গর্ব করা উচিত মনে করে তাহলে বেশিরভাগ লেখক লেখালেখি করাই ছেড়ে দেবে। যত বড়ই ব্লগ হোক না কেন, লেখক ছাড়া তার কোন মর্যাদা নেই। কারণ লেখকরাই সবচেয়ে বড় পাঠক।

আপনি অ্যাডমিন বা মডারেটর, এটি আপনার দায়িত্ব, ক্ষমতা নয়। যদি এমন চলতে থাকে, তাহলে সব লেখক একদিন লেখা ছেড়ে দেবে কারণ দিনশেষে এরা লেখক, অন্তত গাধা নয়।


Discover more from অভিযাত্রী

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন

মেহেদি হাসান (বিকেল)

প্রধান সম্পাদক, অভিযাত্রী

আপনার মতামত জানান?

বিজ্ঞাপন
Back to top button

Discover more from অভিযাত্রী

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading