দর্শন

বায়োপলিটিক্স: আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার ফুকোডিয়ান ব্যাখ্য (পর্ব – ০১)

জীবন, রাজনীতি এবং রাষ্ট্রের সম্পর্ক নিয়ে গভীর বিশ্লেষণ

পুরো আলোচনা জুড়ে যতটুকু সম্ভব ‘বায়োপলিটিক্স’ এবং মিশেল ফুকো’র দেখা আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থা নিয়েই আবদ্ধ থাকবো। চেষ্টা করবো সেটাকে আমাদের মত করে যতদূর সম্ভব জানবার এবং বুঝবার।

‘বায়োপলিটিক্স’ সম্পর্কে জানার পূর্বে আমাদের ‘বায়োপাওয়ার (BIOPOWER)’ সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকা উচিত মনে করছি। মিশেল ফুকো ১৯৭৬ সালে একটি বই প্রকাশ করেন, ‘The History of Sexuality’ – এই নামে।

‘দ্য হিস্টোরি অব সেক্সুয়্যালিটি’ বইয়ের প্রথম ভলিউম ‘The Will to Knowledge’ এর ৫ নং অধ্যায় বা সর্বশেষ অধ্যায় ‘RIGHT OF DEATH AND POWER OVER LIFE’ এই অংশে এসে মিশেল ফুকো ‘বায়োপাওয়ার (BIOPOWER)’ নিয়ে কথা বলেছেন।

‘জীবন’ কে ধরে রাখা, নিশ্চিত করা, মাল্টিপ্লাই করা এবং একই সাথে একটি নিয়মের মধ্যে দিয়ে যাওয়ায় রাষ্ট্রের কি পরিকল্পনা কাজ করছে – এসব-ই হলো উক্ত অধ্যায়ের আলোচিত বিষয়। মানে জীবনের সাথে রাজনীতি এবং রাষ্ট্র কীভাবে তার সম্পর্ক বজায় রেখেছে? এই প্রশ্নের উত্তর এখানেই পাওয়া যাবে মিশেল ফুকো’র লেন্সে।

‘Bio+Politics = Biopolitics’ – কে আক্ষরিকভাবে দেখলে দেখা যায় জীবনের সাথে রাজনীতির মিশ্রণ। বায়োপলিটিক্স বুঝতে গেলে আমাদের পূর্বের রাষ্ট্রব্যবস্থা সম্পর্কে কিছুটা ধারণা থাকার প্রয়োজন আছে।

রাজতন্ত্রের ‘সংবিধান’ খোদ ‘রাজা’ নিজেই। রাজা চাইলেই কাউকে ফাঁসিতে ঝুলাবেন, কাউকে হত্যা করবেন বা কাউকে নির্যাতন করবেন। এবং এটাই হলো আইন। মানে জীবন নেবার এবং জীবন ভিক্ষা দেবার সমস্ত ক্ষমতা রাজার হাতে। একজন রাজা হলেন তিনি তার রাজ্যের সর্বেসর্বা। তাকে কাউকে এজন্য কৈফিয়ত দিতে হয় না। মিশেল ফুকো এই ক্ষমতাকে চিহ্নিত করেছেন, ‘Take Live or, Let Live’ – এই কথায়।

তাহলে আধুনিক রাষ্ট্র কি ‘জীবন’ নেয় না? নিশ্চয়! কিন্তু সেটার মধ্যে ভিন্নতা আছে। আধুনিক রাষ্ট্রেও দেখবেন ‘ক্রসফায়ার’, ‘বিচার বহির্ভূত হত্যা’, ‘জেল হত্যা’, গুম ইত্যাদি হয়ে থাকে। কিন্তু আধুনিক রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর ব্যক্তি রাষ্ট্রের সর্বেসর্বা নয়। এজন্য তাকে দায়ভার নিতেও বাধ্য থাকতে হয়। এখানে আছে সংবিধান, আইন এবং বিচারব্যবস্থা। মিশেল ফুকো এটাকে চিহ্নিত করেছেন, ‘Make Live or, Let Die’ – এই কথা দিয়ে।

বায়োপলিটিক্যাল রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে কিছু কিছু বিষয় আপনাদের চোখে ধরা পড়বে,

  • ১. খুন
  • ২. ধর্ষণ
  • ৩. চিকিৎসা ব্যবস্থার অবনতি ও মৃত্যু
  • ৪. যোগাযোগ ব্যবস্থার অবনতি ও মৃত্যু
  • ৫. আতঙ্কবাদ

সাধারণত এসব বিষয় নিয়ে টক শো বা গোল টেবিল বৈঠকে বলতে শুনবেন যে, এ ব্যাপারে সরকারের আরো (কঠোর) ব্যবস্থা/দেখভাল করতে হবে। এমনকি আপনি যখন ট্রাফিক জ্যাম নিয়ে রচনা লিখছেন তখন শেষের দিকে এসে কেন লিখেন যে, এ বিষয়ে সরকারের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া জরুরী?

কিন্তু একজন আধুনিক রাষ্ট্র নায়কের পক্ষে এতকিছু সঠিক ভাবে পরিচালনা করা কি অদৌ সম্ভব? অথবা, সরকার কেন এত দায়িত্ব নেবে? অথবা, দায়িত্ব নিলেও কি এতকিছু সামলানো সম্ভব? অথবা, সরকারের তাতে লাভটা কি? মানে এত এত দায়িত্ব তো নেওয়া হলো কিন্তু এর থেকে সরকার কি পাবে?

এখানে আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, রাজা চাইলেই কাউকে হত্যা করতে পারেন। আবার চাইলেই কাউকে বাঁচিয়ে রাখতে পারেন। কারণ রাজার রাজত্ব বাড়ানো নিয়ে চিন্তা ছিলো। রাজা তার সৈন্যদের বিভিন্ন যুদ্ধে নামাতো আরো কিছু ভূখণ্ড নিজের রাজ্যের সাথে জুড়ে দিতে বা রাজ্যের সীমানা বৃদ্ধি করতে।

ইতিহাসে যারা সবল রাজা ছিলেন তাদের অধিকাংশই যুদ্ধবাজ ছিলেন। উদ্দেশ্য কি? উদ্দেশ্য হলো, যতসম্ভব রাজ্যের পরিধি বৃদ্ধি করা। এতে করে কে বা কারা মারা গেলেন এটা রাজার দেখার বিষয় ছিলো না। ক্ষমতার দিক থেকেও একজন রাজাকে মাপা হয় তার রাজ্যের মোট আয়তন অনুযায়ী।

আধুনিক রাষ্ট্র বা বায়োপলিটিক্যাল রাষ্ট্র তার আয়তন নিয়ে ভাবে না। কিন্তু তার জনবল নিয়ে সে ঠিকই ভাবে। এজন্যই বায়োপলিটিক্যাল রাষ্ট্র আয়তন বৃদ্ধিতে নয়, ‘জীবন’ -এর আয়ু বৃদ্ধিতে বেশি সজাগ। হয় ‘জীবন’ কে ‘সুনিশ্চিত (শুধু বেঁচে থাকার অধিকার দিলেই চলবে না)’ করতে হবে, নতুবা সে জীবনের কথা বাদ দিতে হবে।

১৬ শতকের দিকে যখন ইউরোপে আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থা ক্রমশ গড়ে উঠা শুরু করলো তখন জীবনের সাথে রাজনীতির একটি সম্পর্কও স্পষ্ট হতে থাকলো। কেন জীবনের সাথে রাজনীতি! খেয়াল করে দেখবেন, ইতিহাসে রাজারা বেশ কিছু উপায়ে রিসোর্চ পেয়ে থাকতেন বা টাকা পেতেন বা ধন-সম্পদ পেতেন।

উল্লেখযোগ্য,

  • ১. অত্যাচারের মাধ্যমে
  • ২. ভয়ের মাধ্যমে
  • ৩. ‘কর’ এর মাধ্যমে
  • ৪. দখলদারিত্বের মাধ্যমে

আরো অনেক ভাবে রাজা তার রাজ্যের জন্য প্রয়োজনীয় রিসোর্চ পেয়ে থাকতেন। তবে কি তারা মানুষের জীবন নিয়ে রাজনীতি করতেন না? নিশ্চয় করতেন কিন্তু তারা আধুনিক রাষ্ট্রের মত করে নয় বা আপেক্ষিকভাবে তারা কম ম্যাচিউর ছিলেন।

আধুনিক রাষ্ট্র বা বায়োপলিটিক্যাল রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য কিন্তু ভিন্ন নয়। কিন্তু এরা আরো বেশি পূর্ণবিকশিত বা ম্যাচিউরড। ফলে, আধুনিক রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে ‘জীবন’ অনেক গুরুত্বপূর্ণ। ‘জীবন’ কে যতদূর কাজে লাগানো যায় তত বেশি আধুনিক রাষ্ট্রের জন্য সুবিধার।

আরো পরিষ্কার করে বললে হয়তো বলা যায়, আধুনিক রাষ্ট্র বা বায়োপলিটিক্যাল রাষ্ট্র শুধুমাত্র পূর্ণবিকশিত-ই নয় সাথে সাথে এরা রিসোর্চের ক্ষেত্রে ‘জীবন’ থেকে আরো বেশি প্রত্যাশা রাখেন। মনে হতে পারে, হাসপাতাল, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, বিনামূল্যে টিকা প্রদান ইত্যাদি আমাদের ভালোর জন্য। কিন্তু এসবের পেছনে একটি উদ্দেশ্য জড়িত আছে, একটি রাজনীতি জড়িত আছে। আর সেটা হলো আমাদের ‘জীবন’।

এই সমস্ত নিয়ে আরো তিনটি বই আছে,

১. কৌটিলীয় অর্থশাস্ত্র

২. নিক্কোলো মাকিয়াভেল্লি – এর ‘দ্য প্রিন্স’

৩. লইস লোরি – এর ‘দ্য গিভার’

(এই তত্ত্ব সম্পর্কে আরো ভালো বুঝতে গেলে নিক্কোলো মাকিয়াভেল্লি – এর ‘দ্য প্রিন্স’ বইটি অবশ্য পাঠ্য।)

পুঁজিবাদ বিকাশের সাথে সাথে আধুনিক রাষ্ট্র বা বায়োপলিটিক্যাল রাষ্ট্র ‘জীবন’ এর কাছে থেকে আরো বেশি প্রত্যাশা করেন, মাক্সিমাম। আগে ছিলাম আমরা ‘প্রজা’ এখন আমরা ‘জনগণ’। এটার মেকানিজম হচ্ছে, আধুনিক রাষ্ট্র জনগণ কে বেশি বেশি সুবিধা দেন তাদের কাছ থেকে বেশি বেশি পেতে।

এজন্য দেখবেন রাষ্ট্রের কাছে আপনার জন্ম ও মৃত্যুর সমস্ত তথ্য খুব সতর্কতার সাথে সংরক্ষিত। যেমন ধরুন, রাষ্ট্র পরিবার-পরিকল্পনার কথা বলছে, স্বাস্থ্য অভিযান চালাচ্ছে। পরিবার-পরিকল্পনা কেন? কারণ রাষ্ট্র জনসংখ্যা বৃদ্ধি করতে চাইছে না। এর ওপর ভিত্তি করে সরকারের কর্মসংস্থান দেওয়া নির্ভর করছে, সেবা দেবার বিষয় নির্ভর করছে, শিক্ষা দেবার বিষয় নির্ভর করছে।

আর স্বাস্থ অভিযান দিয়ে আমাদের রোগমুক্তি রাখার চেষ্টা করছে যাতে করে আমরা আরো বেশি কাজ করতে পারি। উল্লেখ্য, এজন্যই দেখবেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বা পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় তুলনামূলক অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের চেয়ে বেশি শক্তিশালী।

এইডস নিয়ে সাধারণ রাষ্ট্র ৩টি কথা বলে,

১. যতটা সম্ভব শারীরিক সম্পর্ক থেকে দূরে থাকুন

২. আপনার পার্টনারের প্রতি বিশ্বস্ত থাকুন

৩. আপনি যদি পূর্বের দুটি না পারেন তবে, কনডম ব্যবহার করুন

খবরের পাতায়, টেলিভিশন বিজ্ঞাপনে বারবার আপনাকে জানানো হচ্ছে। আধুনিক রাষ্ট্র কিন্তু এখানে ডোমিনেট করছে না। ধূমপানে রাষ্ট্র আপনাকে নিষেধ করছে না। কিন্তু আবার সিগারেট-বিড়ি থেকে রাষ্ট্র বিশাল অঙ্কের কর পাচ্ছে। অন্যদিকে আপনি যদি পাবলিক প্লেসে ধূমপান করেন তবে রাষ্ট্র আপনাকে জরিমানা করতে পারে।

আবার পুলিশ ও আধুনিক রাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্ক কি? এলাকায় একজন সন্ত্রাসী থাকলে পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। তাহলে তো ভালোই হলো। কিন্তু এই ভালোর মধ্যে কালো টা হলো, একজন সন্ত্রাসী ১০০ জন কে হত্যা করতে পারে; যা রাষ্ট্রের ক্ষতি। তাই রাষ্ট্র ঐ একজন সন্ত্রাসী কে মেরে ফেলবে ১০০ জন কে বাঁচাতে এবং ১০০ জনের কাজ করার পরিবেশ কে স্বচ্ছ রাখতে; এতে রাষ্ট্রের লাভ।

আবার রাষ্ট্র বলছে, আপনি স্বাধীন। কিন্তু আপনি কি আত্মহত্যা করতে পারবেন? তাহলে আত্মহত্যা প্রতিরোধে আইন কেনো? কারণ, পরোক্ষভাবে আপনি রাষ্ট্রের সম্পদ। তাই রাষ্ট্র আপনাকে মরতে দেবে না।

যে সংবিধান দিয়ে একটি রাষ্ট্র পরিচালিত হচ্ছে। সেই সংবিধানে কিন্তু লেখা আছে, ইমার্জেন্সির কথা। তাহলে সংবিধানও সাংবিধানিকভাবে অসাংবিধানিক হয়ে যাচ্ছে ইমার্জেন্সি’র সময়। এবং উক্ত সময়ে রাষ্ট্র প্রধান যা ইচ্ছে করতে পারবেন। তখন আপনার স্বাধীনতা বলে কিছু থাকে না একই সাথে আধুনিক রাষ্ট্রের এই নেতা চলে যাচ্ছেন ‘রাজা’র ক্ষমতায়।

ধন্যবাদ

মেহেদি হাসান (বিকেল)

I'm MD Mehedi Hasan, also known by my pen name Mr. Bikel. I'm the admin of the site Ovizatri - News & Magazine. I am a versatile individual with a professional life that spans various fields. I work as a writer, actor, social worker, radio jockey, web developer, web designer, editor, presenter, blood donor, audio and video editor, photo editor, YouTuber, and drama director. I am also a developer and app developer at Microsoft.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button