কোকো (Coco): একটি অ্যানিমেশন মাস্টারপিস যা হৃদয় ছুঁয়ে যায়
পরিবার, সংগীত এবং ঐতিহ্যের এক অনন্য যাত্রা
পরিচিতি
সিনেমার নাম ‘কোকো (Coco)’ যা Pixar Animation Studios ও Walt Disney Pictures এর যৌথ প্রযোজনায় ২০১৭ সালে বিশ্বব্যাপী মুক্তি পায়। সিনেমাটি অ্যানিমেশন জনরার একটি মাস্টারপিস। সিনেমাটি কতটা সফল বা এর বক্স-অফিস কালেকশন কত এসব নিয়ে নতুন করে কোনোকিছু বলার প্রয়োজন নেই।
প্রধান চরিত্র
সিনেমার প্রধান চরিত্র ‘মিগেল’ নামক এক ১২ বছর বয়সী ছেলে, যার সংগীতের প্রতি প্রচণ্ড ঝোঁক। তবে সে এমন এক পরিবারের সদস্য যারা কিনা সংগীতকে ততটাই এড়িয়ে চলে যতটা একজন ভেজিটেরিয়ান, নন-ভেজ এড়িয়ে চলে। মিগেলের পরিবার কেনো সংগীতকে এতটা অপছন্দ করে তার পেছনেও রয়েছে ছোট্ট একটি গল্প।
কোকোর গল্প
মিগেলের প্রমাতামহ অর্থাৎ দাদীর মা (যার নামে সিনেমার নাম – কোকো) ছিলেন তার বাবা-মায়ের একমাত্র কন্যা। ‘কোকো’র বাবা ছিলেন একজন সংগীতশিল্পী। একদিন এই সংগীতের টানে তার বাবা ‘হেক্টর’ তাদের ছেড়ে চলে যান, যিনি আর কখনো ফিরে আসেননি। তবে তিনি কেনো ফিরে আসেননি এটা সিনেমার সবচেয়ে বড় টুইস্ট।
মিগেলের পরিবার
মিগেলের পরিবার তার পূর্বপুরুষ ‘হেক্টর’ চলে যাওয়ার পর থেকে জুতা সেলাই করে জীবিকা নির্বাহ করে। একটি প্রত্যন্ত গ্রামের বড় পরিবার হওয়ায় বেশ হাসি-খুশি দিন পার করে তারা। মিগেলের পরিবারের প্রধান হলেন মিগেলের দাদী। তিনি পরিবারের সবাইকে কড়া শাসন ও শৃঙ্খলার মধ্যে রাখার প্রয়াস করেন। মিগেল তার দাদীর কাছে অত্যন্ত প্রিয় হলেও মিগেলের সংগীতপ্রিয়তা কে তিনি কখনোই সমর্থন করেন না। তবে মিগেলও একরোখা প্রকৃতির, সে যেকোনো মূল্যে তার সংগীত জগতের আদর্শ ‘আর্নেস্তো দে লা ক্রুজ’ এর মত বিশ্ববরেণ্য সংগীতশিল্পী হতে চায়।
মিগেলের সংগ্রাম
তাই সে তার দাদী ও পরিবারের সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে, লুকিয়েই তার সংগীত অনুশীলন চালিয়ে যায়। কিন্তু, একদিন তার এই লুকিয়ে করা সংগীত চর্চা সকলের সামনে উন্মোচিত হয় এবং তার দাদী রেগে গিয়ে তার পছন্দের গিটার ভেঙে ফেলে।
সংগীত প্রতিযোগিতা
একবার মিগেল তার গ্রামে অনুষ্ঠিত হওয়া সংগীত প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে যায়। কিন্তু প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে হলে নিজস্ব একটি গিটার থাকা বাধ্যতামূলক। মিগেলের কাছে কোনো গিটার না থাকায় সে ‘দে লা ক্রুজ’ এর স্মৃতি বিজড়িত জাদুঘরে প্রবেশ করে সংরক্ষিত সেই গিটার চুরি করতে এবং সে তা পেয়েও যায়।
রুহের জগতে যাত্রা
আবেগের বশে মিগেল গিটারের স্ট্রিংয়ে একটি আঘাত করতেই তার সাথে এক বিস্ময়কর ঘটনা ঘটে, সে পৌঁছে যায় আত্মা বা রুহের জগতে। এরপরের জার্নিটা কেমন, তার সাথে কি কি ঘটে আর সে পুনরায় ইহলোকে ফিরতে পারে কি না বা পারলেও কিভাবে ফিরে আসে এটাই সিনেমার প্রধান আকর্ষণ।
সংগীত ও ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক
সিনেমায় বেশ কিছু গান রয়েছে যা বেশ উপভোগ্য। এছাড়া নির্দিষ্ট চরিত্র ও মুহূর্তের জন্য নির্দিষ্ট কিছু ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক আপনাকে মিগেলের সাথে তার জার্নিতে শামিল করতে সক্ষম। সিনেমার সংগীত এর চলমান দৃশ্যের সাথে এক অটুট সংযোগ স্থাপন করে।
স্ক্রিনপ্লে বা চিত্রনাট্য
কোকো সিনেমার অন্যতম প্লাস পয়েন্ট এর স্ক্রিনপ্লে, এত মসৃণ আর ফ্লো-লেস চিত্রনাট্য যা দেখে অল্পসময়েই অনেকবেশি কিছু দেখে ফেলার মত অনুভূতি সৃষ্টি করে। তাছাড়াও মাত্র ১ ঘন্টা ৪৫ মিনিটের একটা সিনেমায় এত লম্বা ও রোমাঞ্চকর একটা অ্যাডভেঞ্চার, ক্যারেক্টার বিল্ড-আপ, আবেগঘন মুহূর্ত আর সামাজিক একটা বার্তা দিয়ে ‘কোকো’ সিনেমা ইতিহাসের অন্যতম সেরা চিত্রনাট্যের দাবিদার।
শিক্ষণীয় বার্তা
‘কোকো’ আমাদের শেখায় ‘পরিবার সবার আগে’। কেউ নিজের আবেগ বা একটা মোহের বশীভূত হয়ে নিজের পরিবারকে ছাড়তে পারার মত মানসিকতা রাখলে তা মোটেও বিচক্ষণতার পরিচয় নয়।
সিনেমার প্রভাব
‘কোকো’ সিনেমাটি শুধু একটি বিনোদনমূলক চলচ্চিত্র নয়, এটি একটি সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞতা। মেক্সিকোর ‘ডিয়া দে লোস মুয়ের্তোস’ (Day of the Dead) উৎসবের প্রেক্ষাপটে নির্মিত এই সিনেমা আমাদেরকে ঐতিহ্য, পরিবার এবং স্মৃতির গুরুত্ব সম্পর্কে নতুন করে ভাবতে শেখায়। সিনেমার প্রতিটি দৃশ্য, প্রতিটি চরিত্র এবং প্রতিটি গান আমাদেরকে একটি গভীর বার্তা দেয়।
অ্যানিমেশন ও ভিজ্যুয়াল এফেক্টস
সিনেমার অ্যানিমেশন এবং ভিজ্যুয়াল এফেক্টস অত্যন্ত চমৎকার। প্রতিটি চরিত্রের অভিব্যক্তি, প্রতিটি দৃশ্যের রঙ এবং আলোর ব্যবহার সিনেমাটিকে একটি জীবন্ত চিত্রকর্মে পরিণত করেছে। বিশেষ করে রুহের জগতের দৃশ্যগুলো অত্যন্ত মনোমুগ্ধকর এবং রঙিন।
সমাপ্তি
‘কোকো’ সিনেমাটি একটি সম্পূর্ণ প্যাকেজ। এটি আমাদের হাসায়, কাঁদায় এবং আমাদের হৃদয়ে একটি স্থায়ী ছাপ ফেলে। এটি একটি সিনেমা যা বারবার দেখা যায় এবং প্রতিবারই নতুন কিছু শেখা যায়।
Discover more from অভিযাত্রী
Subscribe to get the latest posts sent to your email.