Uncategorized

কলকাতার কফি হাউস: স্মৃতির আঁধারে

কফি হাউসের আড্ডা: সাহিত্য, সংস্কৃতি ও জীবনের আয়না

বিজ্ঞাপন

লিখতে গিয়ে সেই স্মৃতি উসকে দেওয়া মান্না দে এর গান, “কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই, কোথায় হারিয়ে গেল সোনালী বিকেলগুলো সেই!”

বেকারদের দল ও ক্যারাম বোর্ড

বলি একটু আজ কলকাতার কথা। আমার কলেজ জীবনে সেই ষাটের দশকে কলকাতায় দেখতাম, কয়েক জন তরুণ ও যুবক এক জায়গায় জড়ো হয়ে আড্ডা দিচ্ছে। সেই আড্ডা স্থল কোথায়! দেখতাম খানিকটা পথ অবরুদ্ধ করে একটা কোথা থেকে জোগাড় করে আনা ভাঙা টেবিলে ক্যারাম খেলছে কারুর সুবিধা, অসুবিধা খেয়াল না করে, আবার রাতের বেলা সুবিধেজনক আস্কারা দেওয়া কোন বাড়ী থেকে ইলেক্ট্রিক তার টেনে এনে কারেন্ট নিয়ে একটা বাল্ববের সাহায্যে ক্যারাম খেলছে।

বড্ড রাগ হতো তখন কেন এদের কি কাজকর্ম নেই! না থাকলে জোগাড় করে না কেন! পরে বুঝেছি, জেনেছি ওরা বেকার, কাজের অনুসন্ধান করে করে ব্যর্থ যারা, তারাই এমন আড্ডার ব্যবস্থাপক।

এদের ওপর রাগ নয়, করুণা হওয়া উচিত। সহানুভুতিমুলক মনোভাব রাখা উচিত এই তরুণ দলের প্রতি। এরা যে বাপে খেদানো, মায়ে তাড়ানো সন্তানের দল! রাস্তার জবরদখলীকৃত স্থানটিই ওদের কফি হাউস, আড্ডা খানা।

উত্তর কলকাতায় কফি হাউস ও ‘রক’ সংস্কৃতি

উত্তর কলকাতায় এমন কফি হাউস তুলনামূলক ভাবে বেশী দেখা যেতো দক্ষিণ কলকাতার তুলনায় বলা যায় উত্তর কলকাতার ‘রক’ সংস্কৃতি। আগে বোঝা দরকার ‘রক’ ব্যাপার টি কি! আজকালকার ফ্ল্যাট সিস্টেম বা আধুনিক স্ট্রাকচারে গঠিত ঐ উঁচু উঁচু গর্বিত, অহংকারী বাড়ীতে এই রক সিস্টেম বিলুপ্ত। বাড়ীর প্রধান প্রবেশ পথ অর্থাৎ গৃহে প্রবেশের দরজা – তার সম্মুখে বড়, চওড়া বাঁধানো বেদী, তার নিচ থেকে ক্রমশ ওপরে উঠবার তিনটি বা দুটি বা চারটি সিঁড়ি।

বিজ্ঞাপন

এই গৃহে প্রবেশিত হবার ব্যবস্থাটি ‘রক’ নামে পরিচিত ছিল। প্রতি বাড়ীর সামনে এই রক থাকতো। এই রকে দাঁড়িয়ে, বসে আড্ডা দেবার সুখ-ই আলাদা। শুধু যে বাড়ীর লোক তা নয় পথ চলতি মানুষও দিতে পারতো আড্ডা, দু’দন্ড জিরোতে। ছিলো না কোন বাঁধা।

কারুর কারুর তো কোনো কোনো বাড়ীতে নির্দিষ্ট সময় থাকতো, তারা সেই সময় একত্রিত হতো – সেই আসরে বা মীটিংয়ে। ‘রক’ এর আড্ডায় কফি, চা তো মুস্কিল ছিলো – কিন্তু সিগারেট অফুরন্ত ছিলো। আড্ডা যে শুধু নবযুবকগণ বা বয়স পেরিয়ে যাওয়া যুবকরা দিতো, তা নয় এই আসরে বয়স্কজনও সামিল থাকতেন।

কোনো ক্লাবরুমে বা কফি হাউসে চেয়ার, টেবিলে বসে চা, কফি পান করতে করতে আড্ডা দেওয়ার সুখময় অবস্থানের চাইতে যে কি মধুময়, তা বোঝা অন্যদের পক্ষে অসম্ভব।

গল্প, কথায়, উপন্যাসে কফি হাউস

কত গল্প উপন্যাসে যে এই কফি হাউস এর উল্লেখ আছে, এই মধুর আড্ডার কথা গল্পের প্লট হিসেবে লিপিবদ্ধ আছে, বিশেষ করে লীলা মজুমদার, আশাপুর্না দেবী, বিমল কর, নীহার রঞ্জন গুপ্তর রহস্য রোমাঞ্চ সিরিজ ও ডিটেকটিভ গল্পে ও আরও অনেক সাহিত্যিক গণের লেখনীতে এই আড্ডর কথা পরিস্ফুট হয়েছে।

‘কফি হাউস’ এর গঠনমূলক আড্ডা

সত্যজিত রায়ের ‘আগন্তুক’ এর মনোমোহন (উৎপল দত্ত) বলেছেন, “আড্ডা যদি গঠনমূলক হয় তো সেই আড্ডার তথ্যমূলক ভাবে প্রয়োজনীয়তা আছে।” এই প্রসঙ্গেই এসে পড়ে অবিস্মরণীয় গায়ক মান্না দের সেই বিখ্যাত স্মৃতিমেদুরতা গান!

বিজ্ঞাপন

নস্টালজিক কফি হাউস এর সেই আড্ডটা…

“নিখিলেশ প্যারিসে, মইদুল ঢাকাতে নেই তারা আজ কোন খবরে

গ্র্যান্ডের গীটারিস্ট গোয়ানিজ ডি-সুজা ঘুমিয়ে আছে যে আজ কবরে…”

বাঙালী জীবনে কফি হাউস এর এই সিগনিফিকেন্ট এই কফি হাউস এর গান!

গানটির সাতটি চরিত্র

নিখিলেশ, মইদুল, ডি-সুজা, সুজাতা, রমা রায়, অমল আর যিনি গাইছেন অর্থাত ঘটনাটি বলছেন। আর্ট কলেজের নিখিলেশ সান্যাল ফ্যশান পত্রিকায় বিজ্ঞাপনের ছবি আঁকিয়ে। ডি- সুজা বিনা কারণে গীটারটি হাতে নিয়ে নির্বাক শ্রোতা হয়ে থাকতো।

বিজ্ঞাপন

রমা রায় এমেচার থিয়েটারে অভিনেত্রি ছিলো, কাকে যেনে মন দিয়ে বঞ্চনার শিকার হয়ে আঘাতে এখন পাগল, আছে পাগলা গারদে। অমল তো ব্যর্থ কবি। এতো কবিতা তার কিন্তু কোথাও হয় নি প্রকাশিত, তার প্রতিভা অজানাই রইলো। এখন সে দুরারোগ্য ক্যন্সারে ভুগছে।

মইদুল কাগজের রিপোর্টার, রোজ এসে কি কি লিখেছে পড়ে শোনাতো। সুজাতাই শুধু সুখী, লাখোপতি স্বামী, হীরে জহরতে মোাড়া গহনা, দামী গাড়ী, বাড়ী নিয়ে। এই এক টেবিলে শুধু চারমিনার জ্বলতো সাতটি ঠোঁটে। সেই বিকেল চারটে থেকে আলোচনা চলতো বিষ্ণু দে, যামিনী রায় কে নিয়ে সন্ধে সাড়ে সাতটা পর্যন্ত।

এই আড্ডাকে কোন রোদ, ঝড়, জল বৃস্টি থামাতে পারতো না।

আজও সেই সাতজন

সাতটা টেবিল আছে আজও। আছে সাতটি পেয়ালা, সেই সাতজন নেই, আাছে নতুন সাতজন। বাগানে নতুন কুঁড়ি ফুটেছে, বদল হয়েছে শুধু মালির। কত জন এলো, গেলো কত স্বপ্ন, কত আশা এই কফি হাউসে স্বপ্ন তো মেঘে ঢেকে যায়, আবার সুর্য ওঠে। কফি হাউসও থাকবে।

কফি হাউস এর সৃষ্টি

কথিত আছে এক ট্রেনের কামরায় একটি সিগারেটের প্যাকটে লেখা হয়েছিল – লিখেছিলেন – গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার, সুরকার- সুপর্নকান্তি ঘোষ। গায়ক আমাদের অবিষ্মরণীয় গায়ক মান্না দে। এ এক চিরষ্মরণীয় গান।

বিজ্ঞাপন

গত, আজ ও আগামীকাল

প্রজন্মের পর প্রজন্ম এই গান গুনগুনোতে থাকবে। গতকাল, বর্তমান, ভবিষ্যৎ। মনে মনে, গলায় গলায় সুরে সুরে জেগে থাকবে। এই গানটি খেয়াল করলে নজরে আসবে দুটি দেশের দুটি রাজধানীর নাম উল্লেখ রয়েছে।

১. বাংলাদেশের – ঢাকা

২. ফ্রান্সের – প্যারিস

আমার দেখা কলকাতার কলেজ স্ট্রীটের কফি হাউস

আমি কলকাতা বাসী হয়েও (আমি বহুদিন ভিলাই, ছত্তিশগঢ় নিবাসী) এই দীর্ঘজীবনে কফি হাউস দর্শণ হয় নি। আশ্চর্য নয় কি কফি হাউস বলতে এক নজরে ঐ কফি হাউস মনের মধ্যে ক্লিক করে ওঠে – সেটি তো এইটি।

সেখানে সাহিত্য, শিল্প, সঙ্গীত প্রত্যহ আলোচিত হয়, সৃষ্টি হয়, রচিত হয়। এক জন্মভুমিও বলা যায় কফি হাউস কে। যার জঠরে এতো মাণিক্যের জন্মগ্রহণ হয়। সম্প্রতি আমি কলকাতা ভ্রমণে কলেজ স্ট্রীট কফি হাউস বেড়াবার সৌভাগ্য অর্জন করেছিলাম। প্রবেশ দ্বার তেমন নজর কাড়লো না। দ্বিধান্বিত হয়ে এমনও ভেবেছিলাম – “ওঃ! এই না কি কফি হাউস!”

বিজ্ঞাপন

ভাবতে ভাবতে আমার ভাবনা পরিবর্তিত হলো। অন্দরে প্রবেশে করে আমার মনে হলো এ কি সমুদ্র! এ কিসের গর্জন! সেই পুরীতে সাগর তীরে দাঁড়িয়ে যে কোলাহল শুনেছিলাম! এ যে সমুদ্রের কিনারার পারভাঙা!

একটি টেবলও খালি নেই। অতো বড়ো সভাগারে। বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষজন সেখানে। তরুণ, তরুণী, যুবক, যুবতী, প্রৌঢ়, প্রৌঢ়া, সব। এ যেন এক মহাভারত! আছি দাঁড়িয়ে কখন একটি টেবিলে বসতে পারবো সেই অপক্ষায়। শুধু তো আমি ও আমার সঙ্গীই নয়, আরও অনেকে।

একটু পরে আমার সঙ্গী ছেলেটি “চলো দেখি ওপরে যাই, জায়গা পাই কি না” গেলাম সেখানে। না, সেখানেও খালি নেই একটিও টেবিল। দেখলাম এক অভুতপুর্ব দৃশ্য। সামনের টেবিলে বসে আছেন প্রায় আশি বছরের চারজন টগবগে যুবক। তাঁরা সামনে কিছু খাদ্যসামগ্রী নিয়ে উচ্ছাসে উদ্দামে, কোনো তর্ক নিয়ে মেতে আছেন।

আমি ভাবি – এমনও হয়! শুধু নবজীবন নয়, যাঁরা পদক্ষেপ নিয়েছেন বিদায় বেলার- তাঁরাও আসেন এখানে, এই কফি হাউসে!

পরিশেষ

বঙ্গীয় সাহিত্য সংস্থার আমরা মিলিত হই ভিলাই নিবাস কফি হাউসে। এক টেবিল এক কোণায় দখল করে আমরা চা, কফি ও যৎসামান্য স্বল্পাহারে সন্তুষ্ট হয়ে গল্পে মেতে থাকি। হ্যাঁ, গল্পই বটে। সাহিত্য চর্চা যতো, আড্ডা তার দশগুণ। এখানেই তো কাফি হাউস এর নাম সার্থক।

বিজ্ঞাপন

আমাদের দলে থাকেন – সমর, দুলাল, প্রকাশ, শুভেন্দু, পল্লব, দীপক, দেবনাথ (সে নির্বাক শ্রোতা) বাণী, গোবিন্দ, সোমালিস্মৃতি। আমরা করি নরক গুলজার দুই তিন ঘন্টা।

কখনো কাউকে সম্বর্ধনা দিতে গান, ও রাত্রি ভোজও হয়। কফি হাউস যেন নিজেই এক মহাকাব্য। তাই আজ এই পর্যন্তই।


Discover more from অভিযাত্রী

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন

শ্রীমতী স্মৃতি দত্ত

অ্যাডভোকেট, লেখিকা, বঙ্গীয় সাহিত্যের সদস্য, কীবোর্ড প্লেয়ার, অ্যামওয়ে ব্যবসার মালিক। আমার লেখা সর্বশেষ বইয়ের নাম, ‘কেমেষ্ট্রি প্র্যাকটিক্যাল ও টি.ভি শো’ এবং ‘লেনিন সাহেবের সাথে দেখা’ বইটি Flipkart -এ নেবার জন্য ক্লিক করুন: https://www.flipkart.com/lenin-saheber-sathe-dekha/p/itmc9bfae4c39392

Related Articles

Leave a Reply

বিজ্ঞাপন
Back to top button

Discover more from অভিযাত্রী

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading