পুরো নাম, আভুল পাকির জয়নুলাবেদিন আবদুল কালাম। তাঁর জীবনের ঘটনাক্রম পৃথিবীর বুকে এমন এক দৃষ্টান্ত যে পৃথিবীর কাউকেই অনুপ্রাণিত করবে। কারুর মনে বিশ্বাস জন্মাতে সাহায্য করবে যে সৎ, নিঃস্বার্থভাবে কাজ করার কোন বিকল্প নেই।
এ. পি. জে. আবদুল কালাম – মনে হয় যেন এক রুপকথা!
চল্লিশ বছর তিনি প্রধানত ‘রক্ষা অনুসন্ধান ও বিকাশ সংগঠন (ডি আর ডি ও)’ ও ‘ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থায় (ইসরো)’ বিজ্ঞানী ও বিজ্ঞানী প্রশাসক হিসাবে কাজ করে গেছেন। এ. পি. জে. আবদুল কালামের জন্ম তামিল নাড়ুর রামেশ্বরমে এক তামিল মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহন করেন ১৯৩১ সালের ১৫ অক্টোবর।
তখন রামেশ্বরম বৃটিশ ভারতের মাদ্রাস প্রেসিডেন্টের অন্তর্গত ছিলো। তাঁর বাবার নাম জয়নুল আবেদিন, এক নৌকা মালিক। রামেশ্বরম ও অধুনা বিলুপ্ত ধনুষ্কোডির মধ্যে হিন্দু তীর্থযাত্রীদের নৌকা পারাপার করাতেন। মাতা আশিয়ামমা ছিলেন গৃহবধু।
এ. পি. জে. আবদুল কালামের পরিবার
কালামের পরিবার ছিলেন অত্যন্ত গরীব পরিবার। অল্প বয়স থেকেই পরিবারের ভরণপোষণের জন্য তাঁকে কাজ শুরু করতে হয়। বিদ্যালয় শিক্ষা সমাপ্ত করার পর পিতাকে সাহায্য করার জন্য সংবাদপত্রে লেখালেখি করার কাজ শুরু করতে হয়।
বিদ্যালয়ে তিনি সাধারণ মানের ছাত্র হলেও তিনি ছিলেন অত্যন্ত কঠোর পরিশ্রমী ও বুদ্ধিদীপ্ত একজন ছাত্র। তাঁর শিক্ষাগ্রহণের তীব্র বাসনা ছিল। ঘন্টার পর ঘন্টা তিনি তিনি পড়াশোনা করতেন ও অংক কষতেন।
আব্দুল কালমের খুব ছোট বয়স থেকেই আকাশে ওড়ার শখ ছিলো সাগর কিনারে বড় হওয়া কিশোর কালাম যখন আকাশে পাখীদের উড়তে দেখতেন, সামুদ্রিক চিলদের কলরব করে দুর আকাশে উড়ে যেতে দেখতেন তো রোমাঞ্চিত হয়ে উঠতেন।
তাঁর লোভ হতো ঐ রকম আকাশে উড়ে বেড়াবার। ইচ্ছা জাগতো কবে ঐ দুর আকাশে তিনি উড়ে বেড়াবেন (সোর্স- Wings OF Fire by APJ Abdul Kalam) এবং উল্লেখযোগ্য যে, রামেশ্বরম থেকে আকাশে উড়তে পারা প্রথম মানুষটি হলেন যুবক বয়সের সেই কালাম।
এ. পি. জে. আবদুল কালামের শিক্ষাজীবন
এ. পি. জে. আবদুল কালাম তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু করেন রামনাথ পুরমের সোয়ার্জ ম্য্যট্রিকুলেশন বিদ্যালয়ে। সেখান থেকে সাধারণ শিক্ষা সমাপ্ত করে মাদ্রাস বিদ্যালয়ের অধীনে তিরুচিরাপল্লীর সেন্ট জোসেফ কলেজ থেকে পদার্থবিদ্যার ডিগ্রি অর্জন করেন।
তিনি তাঁর পদার্থবিদ্যার স্নাতক শেষ করে উপলব্ধি করেন যে পদার্থবিদ্যা তাঁর উপযুক্ত সাবজেক্ট ছিল না। এ. পি. জে. আবদুল কালাম ছোটবেলা থেকে যে আকাশে ওড়ার স্বপ্ন নিয়ে বেড়ে উঠেছেন সেই স্বপ্নের পথ এই সাবজেক্টের শেষ প্রান্তে পাওয়া যাবে না।
এটি তিনি উপলব্ধি করোছিলেন। তাই তিনি ১৯৫৫ সালে মাদ্রাস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (MIG) -তে ভর্তি হতে মনঃস্থির করেন। কিন্তু তখন তাঁর এম আই টি’র ভর্তি ফি দেবার যোগ্যতা ছিল না। সেই সময় তাঁর বড় বোন ‘জোহরা’ সোনার গহনা বিক্রি করে আবদুল কালাম কে ভর্তির টাকা দেন।
এ. পি. জে. আবদুল কালাম ও এম.আই.টি
এম.আই.টিতে পড়ার সময় আবদুল কালাম প্রায়ই অবসর সময়ে সেখানে রাখা একটি পরিত্যক্ত বিমানের পাশে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকতেন এবং নিজের আকাশে ওড়ার স্বপ্ন মজবুত করতেন। এম আই টিতে একবার তাঁর একটি প্রজেক্টে অখুশী ডীন তাঁকে প্রজেক্টটি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে শেষ করতে না পারলে স্কলারশিপ বন্ধের ভয় দেখালে তিনি সে প্রজেক্ট তিন দিনের মধ্যে শেষ করেন।
এম.আই.টি ও দুটো রাস্তা
এম.আই.টিতে শিক্ষাজীবন শেষ করার পর জীবন তাঁর সামনে দুইটি রাস্তা খুলে দেয়। এবং দুইটি রাস্তাই তাঁকে তাঁর স্বপ্ন পুরণ করতে সক্ষম ছিলো। একটি ভারতীয় বিমান বাহিনীর চাকুরী অন্যটি প্রতিরক্ষা বিভাগের অধীনে ‘Directorate of Technical Devop ment and Production- DT & p (air)’ এ।
তিনি একই সঙ্গে দুই জায়গা থেকে ইনটারভিউয়ের ডাক পেলেন। ইনটারভিউয়ের দুটি স্থান ভারতের দুটি স্থান দুটি প্রান্তে ২০০০ কি.মি. দুরে। জীবনে প্রথম বার আবদুল কালাম বিমানযাত্রা করলেন। তিনি অবাক হয়ে আকাশ থেকে নিজের জন্মভূমি দেখলেন।
দুইটি ইন্টারভিউ দিয়ে তিনি ফিরে এলেন এয়ার ফোর্সে-২৫ জন ক্যান্ডিডেটের মধ্যে হলেন নবম। চরম হতাশ হলেন তিনি।
এ. পি. জে. আবদুল কালামের উত্থানের গল্প
কয়েক দিন পর তাঁর ডিফেন্স মিনিষ্ট্রিতে ডাক পড়লো। সেখানে তিনি সিনিয়র সাইন্টিস্ট এসিসট্যান্ট হিসেবে জয়েন করেন। এখান থেকেই শুরু হয় তাঁর জীবনের উত্থানের গল্প। এখানে তাঁর মেধা ও কাজের প্রতি নিষ্ঠা দেখে তাঁকে ইন্ডিয়ান স্পেস রিসার্চ প্রোগ্রামে পদস্থ করা হলো।
এর পুর্বে যখন এয়ারফোর্সে ২৫ জনে নবম স্থান পেয়ে প্রচন্ড হতাশাগ্রস্ত হয়েছিলেন তখন তাঁর জীবনে একটি ঘটনা ঘটেছিল। হতাশাগ্রস্ত অবস্থায় ভেবেছিলেন এই ব্যর্থতার সাথেই বোধহয় শেষ হয়ে গেল তাঁর আশৈশব লালিত স্বপ্ন!
এ. পি. জে. আবদুল কালাম ও স্বামী শিবানন্দ
ভাঙা মন নিয়ে তিনি হৃষিকেশ পৌঁছন। সাক্ষাৎ করেন স্বামী শিবানন্দের সাথে। স্বামীজীর গৌতম বুদ্ধের মতো অবয়ব, শিশুর সারল্যমাখা হাসি অনেকটাই শান্ত করলো আবদুল কালাম কে। তিনি তাঁর স্বপ্নভঙ্গের কাহিনী বললেন স্বামী শিবানন্দকে।
স্মিত হেসে স্বামীজী বললেন, আকাঙ্ক্ষা যখন মনের অন্তঃস্থল থেকে আসে আর যখন তা তীব্র হয় তখন এটি শক্তিশালী বৈদ্যুতিক-চুম্বকীয় শক্তি ধারণ করে। মনের ঘুমন্ত অবস্থায় এ শক্তি ইথারের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে যা মহাজাগতিক শক্তির স্রোতধারায় প্রবাহিত হয়ে বিবর্তিত অবস্থায় আবার ফিরে আসে সচেতন মনে।
সত্যি কারের স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবেই। যেমন চিরকাল নিয়ম মেনে সূর্য ওঠে, বসন্ত আসে ঠিক তেমনি তুমি ভরসা হারিও না।
স্বমীজীর ক্ষীণ কিন্তু গভীর কণ্ঠস্বর হতে উৎসারিত বাক্যগুলি আবদুল কালামের হৃদয় আশ্চর্য রকম ভাবে প্রভাবিত করে। তিনি আবার ভরসা ফিরে পান। তিনি আবার খুঁজতে থাকেন নিজের ভিতরের আগুন পাখীকে। যেমনটি স্বামীজী বলেছিলেন আজকের ব্যর্থতা ভুলে জীবনের প্রকৃত উদ্দ্যশ্যের অনুসন্ধান করো।
এয়ার ফোর্সের পায়লট হওয়া তোমার নিয়তি নয়। নিজের সঙ্গে একাত্ম হও। আত্মসমর্পণ করো ঈশ্বরের ইচ্ছার কাছে।
মিসাইলম্যান এ. পি. জে. আবদুল কালাম
ইন্ডিয়ান স্পেস প্রগ্রামে পদস্থ হবার পর তাঁকে সেখান হতে রকেট সাইজের উপর প্রশিক্ষণ নিতে আমেরিকায় পাঠানো হলো। তাঁর হাত ধরেই ভারতের রকেট টেকনোলজির বিশাল উন্নতি সাধিত হয়। এবং তিনি ‘মিসাইলম্যান’, ‘ইন্ডিয়ান মিসাইলম্যান’ উপাধি পান।
পোখরান-২ ও কালামের পুরষ্কারের ডালি
১৯৯৮ সালে ভারতের প্রথম সফল পারমাণবিক পরীক্ষা ‘পোখরান-২’ তাঁর হাত ধরেই সফলতা পায়। তিনি ১৯৮১ সালে পদ্মভুষণ, ১৯৯০ তে পদ্মবিভুষণ এবং ১৯৯৭ সালে ভারতের সর্বোচ্চ সম্মান ভারত রত্ন সহ বিভিন্ন দেশী বিদেশী পদক সন্মানে ভূষিত হন।
২০০২ সালে ভারতীয় জনতা পার্টি ও কংগ্রেসের ভারতের দুই বৃহৎ দলের মতমতের ভিত্তিতে রাষ্ট্রপতি পদে স্থাপিত হন ও ২০০৭ পর্যন্ত রাস্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন। তিনি মানুষের মাঝে জ্ঞান ছড়িয়ে দিতে পছন্দ করতেন।
ভালো বাসতেন নিজ জীবনের শিক্ষা তরুণ প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিতে। ২০১৫ সালে ২৭ জুলাই মেঘালয়ের শিলং শহরে অবস্থিত ইন্ডিয়ান অব ম্যানেজমেন্ট নামক প্রতিস্থানে বসবাসযোগ্য পৃথিবী সম্পর্কে বক্তব্য রাখছিলেন।
মিসাইলম্যানের বিদায়বেলা
ভারতীয় সময় ৬.৩০ মিনিট সময়ে বক্তব্য রাখা অবস্থায় তাঁর কর্ডিয়াক এরেস্ট হয় এবং তাঁকে বেথানী হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে ৭.৪৫ মিনিটে মৃত্যু হয়। তাঁর মৃত্যুপরান্ত ভারতের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, দিল্লীর মুখ্যমন্ত্রী, চতুর্দশ দালাইলামা, ভুটান সরকার, ইন্দেনেশিায়া, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর প্রধান – প্রত্যেকে শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের সঙ্গে বলেন, “এ. পি. জে. আবদুল কালাম এর মৃত্যু এক অপরনীয় ক্ষতি দেশের বিজ্ঞান জগতের।”
এক উচ্চতায় পৌঁছে দেওয়া আবদুল কালাম শুধু একজন বৈজ্ঞানিক, শিক্ষাবিদ ও রাষ্ট্র নেতাই ছিলেন না, তিনি ছিলেন এক নিপাট ভদ্রলোক, অত্যন্ত সরল ও বিনয়ী। দেশ ও দেশের মানুষ-ই ছিলেন তাঁর পরিবার। এদের ছেড়ে তাঁর ঘর সংসার করা হয়ে ওঠেনি।
দ্য লাইফ ডিভাইন
রাষ্ট্রপতি ভবনের মেঝেতে বসে আছেন মিসাইলম্যান। ভারতের সর্বকালের সেরা রাষ্ট্রপতি আমাদের কালাম স্যার। তাঁর সঙ্গে থাকেন গৌতম বুদ্ধ, দেবী সরস্বতীর মুর্তি, প্রিয় বাদ্যযন্ত্র বীণা, আর একটা টেপ রেকর্ডার। আর ঋষি অরবিন্দের লেখা একটি বই- ‘দ্য লাইফ ডিভাইন’।
তাঁর রেখে যাওয়া সম্পত্তি
২০২৫ টি বই, ৬ টি প্যান্ট, ৪টি জামা, ৩টি স্যুট। আর একটি পদ্মশ্রী, একটি পদ্মভুষণ, একটি পদ্মবিভুষণ, একটি ভারত রত্ন, এবং ৪৮ টি ডক্তরেট ডিগ্রি। এই হলো তাঁর মোট সম্পত্তির পরিমাণ। ধর্ম, বর্ণ, সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে পৃথিবীর শক্তিশালী একজন মানুষ।
এ. পি. জে. আবদুল কালাম এর একটি মুল্যবান উক্তি, যা তিনি মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন – “স্বপ্নপূরণ না হওয়া পর্যন্ত স্বপ্ন দেখে যাও। স্বপ্ন সেটা নয় যা তুমি ঘুমিয়ে দেখো, স্বপ্ন হলো সেটাই যা তোমাদের ঘুমোতে দেয় না।”
Discover more from অভিযাত্রী
Subscribe to get the latest posts sent to your email.