প্রহসন: হাস্যরসাত্মক নাটকের এক অনন্য ধারা
বাংলা সাহিত্যে প্রহসনের উৎপত্তি, বিকাশ ও বৈশিষ্ট্য
প্রহসন অর্থাৎ উৎকৃষ্ট প্রভূত হাসির বিষয় যে দৃশ্য কাব্যে থাকে তাকে প্রহসন বলে। এর প্রধান রস হল হাস্য এবং চরিত্রগুলি নিম্নশ্রেণির ভন্ড, পাষন্ড, নাস্তিক, অধঃপতিত সন্ন্যাসী, পতিত ব্রাহ্মণ, ধূর্ত, চেট, ক্লীব, গনিকা, কুট্রনী, ভট প্রভৃতি।
প্রহসন কি?
হাস্যরসাত্মক নাটককে প্রহসন বলা হয়। এর উদ্দেশ্য হল হাস্যরস ও ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের আড়ালে অতিরঞ্জিত, অসংযত ও অভাবনীয় অবস্থা সৃষ্টির মাধ্যমে দর্শকদের বিনোদন প্রদান করা। এর মাধ্যমে বিভিন্ন সামাজিক বিষয়াদি যেমন: সমাজের অনৈতিকতা, বিভিন্ন অনাচার, ধর্মীয় গোঁড়ামি বা রক্ষণশীলতা এবং প্রাত্যহিক জীবনের ত্রুটি-বিচ্যুতিসমূহ ইত্যাদি বিষয়াদি চিত্রিত হয়ে থাকে।
প্রহসন শব্দের অর্থ
প্রহসনের ইংরেজি প্রতিশব্দ হলো ‘Farce (ফার্স)’। ফার্স শব্দটি এসেছে লাতিন শব্দ ‘ফোরাসিয়ার’ থেকে যার অর্থ ‘ভরাট’। বাংলায় প্রহসনের প্রতিশব্দ হলো হাস্যকর অভিনয় বা হাস্যরসোদ্দীপক নাটিকা।
প্রহসনের উদ্দেশ্য
সমাজের নানা অনিয়ম, অনাচার, অন্যায়, অনৈতিকতা, ভন্ডামি, কুসংস্কার, ধর্মীয় গোঁড়ামি, অজ্ঞতা ইত্যাদি বিষয়াদি হাস্যরস, পরিহাস, ব্যঙ্গ বিদ্রুপের মাধ্যমে তুলে ধরায় হলো প্রহসনের উদ্দেশ্য। অর্থাৎ অভিনয়ের মাধ্যমে সমাজের সকল অজাচারকে কটাক্ষ করা।
প্রহসনের বিকাশ
প্রহসনের বিকাশ ঘটেছে মধ্যযুগীয় গ্রীক সাহিত্যে। সেই সময়কার গ্রীক থিয়েটারগুলোতে প্রহসনের মতো নাটিকা মঞ্চস্থ হতো। যদিও তখনকার বিষয়বস্তু ও উপস্থাপনা বর্তমান সময়ের চেয়ে ভিন্ন ছিলো। তবে উদ্দেশ্য ছিলো একই অর্থাৎ হাস্যরসাত্মক ভাবে সমাজের অজাচার, অনিয়মগুলো বিনোদনের মাধ্যমে তুলে ধরা এবং মানুষের মনের কথা প্রকাশ করা।
ফলে এটি ক্রমেই মানুষের নিকট জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। পরবর্তী কালে মোটামুটি সব ভাষার সাহিত্যে প্রহসনের চর্চা শুরু হয়। ফ্রান্সে প্রথম সং, মূকাভিনয়, হাস্যরসাত্মক নাটকের জন্য ফার্স শব্দটি ব্যবহার করা হয়। ফরাসি প্রহসন ‘ল্য গাসো এ লাভোল্গ (১২৬৬)’ কে সবচেয়ে বেশি পুরানো প্রহসন মনে করা হয়।
‘ল্য ফার্স দ্য মাইত্র পাতেলা (১৪৭০)’ – ছিলো মধ্যযুগের একটি বিখ্যাত ফরাসি প্রহসন। এছাড়াও আছে ‘দ্য লায়ার (১৬৪৪)’, ‘দ্য মাইজার (১৬৬৮)’ ইত্যাদি। ষোড়শ শতাব্দীতে ইংল্যান্ডের জন হেইডের দুই অংকের নাটকে প্রহসনের বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। উইলিয়াম শেকসপিয়রের ছোট নাটকেও প্রহসনের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়।
১৯৭০ সালে ৫ ডিসেম্বর ইতালিতে প্রথমবার মঞ্চায়িত করা হয় দারিও ফো এর ‘মোর্তে আক্সিদেন্তালে দি উন অনার্চিকো’। ভারতবর্ষে প্রহসনের শুরু রামনারায়ণ তর্করত্নের ‘কুলীনকুলসর্নস্বকর্ম (১৮৫৪)’ এর মাধ্যমে। যদিও মাইকেল মধুসূদন দত্ত এর ‘একেই কি বলে সভ্যতা (১৯৬০)’ সার্থক বাংলা প্রহসন হিসেবে গণ্য করা হয়।
বাংলায় প্রহসনের উৎপত্তি
বাংলা ভাষায় প্রহসনের উদ্ভব হয় সংস্কৃত থেকে। উনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে বাংলা প্রহসন বিকশিত হতে শুরু করে। এই সময়ে সংস্কৃত প্রহসনের আদলে প্রহসন রচনা করেন রামনারায়ণ তর্করত্ন। মাইকেল মধুসূদন দত্ত যে প্রহসন রচনা করেছেন তা পাশ্চাত্য ধারার প্রহসনের আদলে বাংলা ভাষায় সার্থক প্রহসন বলে বিবেচিত।
যেমন, মধুসূদন দত্তের এই ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ’ প্রহসনটি একটি নিখুঁত প্রহসন। তবে এর নামকরণ করেন ঈশ্বরচন্দ্র। বিষয়বস্তুর বিস্ময়করতা দেখেই সম্ভবত এই নামকরণ করা হয়। এটিই মধুসূদনের প্রথম প্রহসন নয়। তাঁর প্রথম প্রহসন হলো ‘একেই কি বলে সভ্যতা’।
প্রহসনের ব্যঙ্গের লক্ষ্য ছিল ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত যুবা সম্প্রদায়। তবে বর্তমান প্রহসনে ব্যঙ্গের লক্ষ্য হলো ভণ্ড, অত্যাচারী, কুপমণ্ডুক প্রাচীন সমাজ। ‘একেই কি বলে সভ্যতা’ প্রহসনের পরিবেশ নাগরিক জীবন।
আর ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ’ প্রহসনের পরিবেশ গ্রাম জীবন। ব্যঙ্গের প্রধান লক্ষ্য ভক্তপ্রসাদ। গ্রাম্য জমিদার, নির্মম একটি চরিত্র এই ভক্তপ্রসাদ। যে প্রজাদের খাজনা এক পয়সা মাফ করে না, কাউকে সাহায্য দেয় না।
কিন্তু পরকীয়ায় সিদ্ধহস্ত, রূপসী পরস্ত্রী দর্শনে ভারতচন্দ্র আবৃত্তি করে। হানিফের স্ত্রী ফাতেমার রূপ ব্যাখ্যান শুনে ভক্তপ্রসাদ তার কাছে কুটিনী পাঠিয়েছে। আর নিজ মনোবাসনা সিদ্ধি সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েই ভক্তপ্রসাদ যুবার বেশে অভিসারে বেরিয়েছে।
প্রধানত দুটি কারণে ভক্তপ্রসাদ মধুসূদনের ব্যঙ্গের পাত্র হয়েছেন:
১. ভক্তপ্রসাদ নিজে সকল প্রকার কুকর্মে রত হয়েও তার পুত্রের ধর্মাচরণের প্রতি সতর্ক দৃষ্টি এবং হিন্দুধর্মের রক্ষার জন্য তিনি ছিলেন উদ্গ্রীব।
২. তিনি হিন্দুধর্মের রক্ষার জন্য উদ্গ্রীব হওয়া সত্ত্বেও মুসলমান রমণীর সঙ্গে যৌন সম্পর্কে তার আপত্তি নেই। তার সকল বাধা মুসলমান সংস্পর্শজাত কোনো খাদ্যগ্রহণ করার মধ্যে।
তবে এই প্রহসনে মাত্রাতিরিক্ততা এবং অস্বাভাবিকতার জন্য প্রথম প্রহসন অপেক্ষা কিছুটা নিকৃষ্ট। কিন্তু ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ’ প্রহসনে মধুসূদন দত্ত চরিত্রগুলির পরিবেশ বেশ চিন্তা করে তাদের মুখে যে কথ্য ভাষার সংলাপ দিয়েছেন তা ছিলো অপূর্ব।
বাংলা সাহিত্যে উল্লেখযোগ্য কিছু প্রহসন
লেখক | প্রহসন |
---|---|
মাইকেল মধুসূদন দত্ত | বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ, একেই কি বলে সভ্যতা |
গিরিশ চন্দ্র ঘোষ | সপ্তমীতে বিসর্জন, বড় দিনের বক্শিস, সভ্যতার পান্ডা, পাঁচ কনে, বেল্লিক বাজার |
অমৃতলাল বসু | বিবাহ বিভ্রাট, সম্মতি সঙ্কট, কালা পানি, বাবু, একাকার, বৌমা, গ্রাম্য বিভ্রাট, বাহবা বাতিক, খাস দখল, চোরের উপর বাটপারি, ডিসমিস, চাটুয্যে ও বাঁডুয্যে, তাজ্জব ব্যাপার, কৃপনের ধন, অবতার, ব্যাপিকা বিদায়, রাজা বাহাদুর, তিলতর্পণ |
দ্বিজেন্দ্রলাল রায় | কল্কি অবতার, পুনর্জন্ম, বিরহ, এ্যহস্পর্শ, প্রায়শ্চিত |
মীর মোশারফ হোসেন | এর উপায় কি, ভাই ভাই এইতো চাই, ফাঁস কাগজ, একি |
দীনবন্ধু মিত্র | সধবার একাদশী, বিয়ে পাগলা বুড়, জামাই বারিক |
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর | গোরায় গলদ, বৈকুণ্ঠের খাতা, চিরকুমার সভা, শেষ রক্ষা, ব্যঙ্গ কৌতুক, হাস্য কৌতুক |
রাম নারায়ন তর্করত্ন | উভয় সঙ্কট, চক্ষুদান, যেমন কর্ম তেমন ফল |
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর | কিঞ্চিত জলযোগ, হিতে বিপরীত, দায়ে পরে দায়গ্রহ, এমন কর্ম আর করব না, হঠাৎ নবাব |
প্রহসনের বৈশিষ্ট্য
১. প্রহসন সাধারণত খুবই সংক্ষিপ্ত। ২. প্রহসন একটি বা দুটি অংশেই শেষ করা হয়। ৩. প্রহসন নাটকের মতো দীর্ঘ নয়। ৪. সামাজিক অসঙ্গতি বিষয়গুলোকে হাস্যরসাত্মকভাবে প্রকাশ করা। ৫. সহজ এবং সাবলীল সংলাপ। ৬. হাস্যরসাত্মক হলেও এর ভাবার্থ হয় গুরুগম্ভীর এবং অর্থপূর্ণ। ৭. প্রহসনের চরিত্রগুলো স্বতন্ত্র্য কিন্তু সামাজিক নিষ্পেষণের প্রতীক।
নাটক ও প্রহসনের মধ্যে পার্থক্য
নাটক ও প্রহসন এই দুটিরই উদ্দেশ্য মানুষকে বিনোদন দেয়। কিন্তু নাটক ও প্রহসনের মধ্যে কিছু পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়।
১. নাটকের আয়তন নির্দিষ্ট না হলেও প্রহসনের মতো এতো ক্ষুদ্র পরিসরের হয় না। অপর দিকে প্রহসন সবসময়ই ক্ষুদ্র পরিসরের হয়ে থাকে। ২. নাটক এবং প্রহসন বিনোদন দিলেও নাটকের মধ্যে গুরুভাব থাকতেও পারে, আবার নাও থাকতে পারে। কিন্তু প্রহসনের মধ্যে গুরুভাব সবসময়ই থাকে। ৩. নাটকের সংলাপ সবসময় যে হাস্যপরিহাস পূর্ণ থাকে তা কিন্তু না। অপর দিকে প্রহসন সবসময়ই হাস্যপরিহাস পূর্ণ হয়ে থাকে। আর প্রহসনের সংলাপ কিছুটা কদার্য। ৪. নাটকের কাহিনীতে সবসময়ই সমাজের বাস্তবতাকে তুলে ধরে না। কিন্তু প্রহসনে সবসময়ই সমাজের তিক্ত বাস্তবতাকে তুলে ধরে। এটা মনে রাখা জরুরি যে, প্রহসন কমেডি ধরনের হলেও এটি কিন্তু কমেডি নয়।
প্রহসন তিন প্রকার
১. শুদ্ধ ২. সংকীর্ণ ৩. বিকৃত ভেদে
পরিশেষ
বর্তমানে বাংলা সাহিত্য প্রহসনের তেমন চর্চা দেখা যায় না। যদিও এখন বাংলা সাহিত্য অনেক দূর এগিয়ে গেছে তবুও এটির চর্চা খুব একটা দেখা যায় না। তবে এই ভিন্নমাত্রার বিনোদনের মাধ্যমে সমাজের অসঙ্গতিগুলোকে তুলে ধরার অন্যতম মাধ্যম হলো প্রহসন।
Discover more from অভিযাত্রী
Subscribe to get the latest posts sent to your email.