ফ্রানজ কাফকা (Franz Kafka): অসীমতার অন্বেষায় এক বিচরণ
কাফকার জীবন ও সাহিত্যের মধ্যকার সম্পর্ক
ফ্রানজ কাফকা (Franz Kafka) পাঠ সব সময়ই পাঠকের কাছে চ্যালেঞ্জ। কাফকা কে যারা মুকুটহীন সম্রাট মনে করেন এবং যারা কাফকা দ্বারা ভীষণভাবে প্রভাবিত – ডাবলু.এইচ.অডেন, কামু, মার্কস, বোরহেস, ইয়োজেন, আয়ানেস্কো, জে এম কোয়েটেজ, শলোকভ এবং সার্ত্রে।
লেখকের দায়টি কি বা কোথায়? সত্যি কথা এটাই যে, এ ব্যাপারে লেখকের কোন রকম দায় নেই। পাঠকের কেমন লাগবে লেখনী এ ব্যাপারে লেখার সময় লেখকের কোনো খেয়াল থাকার কথা নয়। অধিকাংশ লেখা লেখকের চেতনা প্রকাশের অংশ নয়। লেখকের ব্যক্তিগত অনুভুতি, রাগ দুঃখ, ঘৃণা, তাঁর পছন্দ, অপছন্দ, যত তাঁর লেখার মধ্যে কালজয়ী হবার সম্ভাবনা কমে যায়।
এ প্রসঙ্গে বলা যায় এক কালজয়ী লেখার লেখকের হয়তো একটাই ‘মাস্টারপিস’ বেরোতে পারে! যেমন গ্যাব্রিয়েলা গর্সিয়া মার্কেসের ‘ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ারস অব সলিটিউড’, হেমিংওয়ের ‘ওল্ড ম্য্যান এন্ড দ্য সী’, জয়েসের ‘ইয়োলিসিস’, বা কামুর ‘আউট-সাইডার’।
কিন্তু আমরা এমন কোনো লেখকের সন্ধান পাই, যার সব লেখাই প্রকৃতপক্ষে ‘মাস্টারপিস’ তবে তিনি নিশ্চিত রুপে বিশ্ব সাহিত্যের মুকুটহীন সম্রাট ফ্রানৎস কাফকা। ভাষা ব্যবহার, নির্মাণ, লেখন শৈলী, ট্রিটমেন্ট, সংকট, বিশ্লেষণ, পরাবাস্তব, যাদু বাস্তব, কল্পনা ও প্রহেলিকায় তিনি অন্য সবার থেকে আলাদা।
এই শতাব্দীর সবচেয়ে সাড়া জাগানো লেখক আলবেয়ার কামু বলেছিলেন, কোনদিন যদি সম্পুর্ণ রুপে বিশ্বসাহিত্য ধ্বংস থেকে রক্ষা পেয়ে যায়, তবে নিশ্চিত ভাবে বাইবেল, শেকসপিয়ার ও কাফকার লেখা সেই লেখা দিয়ে বিশ্বসাহিত্য পুনঃনির্মাণ করা য়ায়।
ফ্রানৎস কাফকা তাঁর ‘মেটামরফোসিস’ গল্পেই বদলে দিতে পেরেছেন বিশ্বসাহিত্যের মানচিত্র এবং খুব নিঃশব্দে ও নিশ্চিতভাবে। গল্পের নায়ক গ্রেগর সামসা রাতের বিদঘুটে সব স্বপ্ন থেকে জেগে ওঠে ও হঠাৎ দেখে যে, সে একটা দৈত্যাকার পোকায় রুপান্তরিত হয়ে গেছে।
শুরুতেই পাঠকের হোঁচট এক আকষ্মিক ক্লাইম্য্যক্সে। এরপর গল্প যতো গড়াতে থাকে এই ক্লাইম্যাক্সের চূড়া থেকে সমস্ত বন্ধন কেটে এক সুদীর্ঘ শ্বাসের মতো গড়িয়ে পড়তে থাকে মৃত্যুর শীতল উপত্যকায় সমস্ত বন্ধন বর্জন করে।
মানুষের এই পোকা জন্ম তাঁর বহু লেখাতে এসেছে। ‘ওয়েডিং প্রিপারেশন ইন দ্য কান্ট্রি’ এর এডওয়ার্ড রাবানও একদিন কল্পনা করে সে এখন একা শুয়ে এক গুবড়ে পোকা হয়ে গেছে। আর দীর্ঘ শীত ঘুমে সে তার খুদে পা গুলোকে চেপে ধরেছে ফুলে ওঠা পেটের ওপর।
‘লেটার টু ফাদার’ এ বাবা ছেলেকে কল্পনা করেছে এক বিষাক্ত পোকার সঙ্গে। গ্রেগর সামসার পোকা জন্ম এক সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করে যে সামাজিক অসাম্য্য অবিশ্বাসের কাঠামো। এ কথা অনস্বীকার্য ‘মেটামরফোসিস’ কাফকার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি।
এই লেখাতেই কাফকা তাঁর মগজাস্ত্রের সব ক’টিকে একই দিকে একই শক্তিতে এক লক্ষে চালনা করেছেন। বিষয়ে, রুপকে, ফ্যান্টাসিতে মানবতার তীব্র আর্তি গল্প বলার কৌশল পাঠক কে নিয়ে যায় এক যন্ত্রনার রুপ কে। অথচ শেষে গল্পটির উত্তরণ হয় এক প্রবল ‘Existensialism’ এ। যেখানে মৃত্যু ও মানুষ পরিণত হয় এক ‘Conception’ এ। ‘এ মেসেজ ফ্রম দ্য এমপেরর’ গল্পে যেমন দেখা যায় মরণাপন্ন সম্রাটের বার্তা দিয়ে ছুটতে শুরু করে এক বিশেষ দূত।
সে পেরিয়ে যায় বছরের পর বছর, মহলের পর মহল সিঁড়ি, বারান্দা ঢুকে পড়ে আর এক প্রাসাদে আর পেরিয়েও যায় আর একটি মহল, সিঁড়ি, বাারান্দা। কিন্তু গন্তব্যে পৌঁছনো তার হয় না এই গন্তব্যহীন পরিক্রমাই যেন তার নিয়তি।
এ দিকে জোসেসাইন ‘দ্য সিঙ্গার অব মাউস ফোক’ গল্পে দেখি জোসেসাইন তার গান হঠাৎ থামিয়ে দিয়ে উধাও হয়ে যায় পাহাড়ের ঢাল বেয়ে। সে আর গান গাইবে না। তার গানের রেশ মিলিয়ে যায় নৈঃশব্দের অতলে। ওইখান থেকে ফের হতে পারে গল্পটির পুনঃপাঠ।
সম্ভবত ‘মেটামরফোসিস’ লেখার পর কাফকা এক সম্যক ধারণা করে নেন – তিনি কি লিখবেন? কীভাবে লিখবেন? কি লক্ষে লিখবেন? এবং কেন লিখবেন! সমালোচকদের মতে, ‘কাসল’ কাফকার সবচেয়ে কুয়াশাচ্ছন্ন উপন্যাস, একই সঙ্গে জটিল ও রহস্যময়।
‘কাসল’ উপন্যাসে ‘কে’ একজন জমি জরিপকারী। সে এক জমি মাপার কাজ নিয়ে তার আগমন। কাহিনী এগোতে থাকে এক প্রগাঢ় রহস্যময় কুয়াশাচ্ছনতার দিকে। কাহিনীর টার্নিং পয়েন্টে ম্য্যজিক টাচ এ ‘কে’র ভবঘুরে জীবনের সঙ্গে পাঠকের একাত্মতা সৃস্টি। পাঠকের যাবতীয় সহানুভুতি, মনোযোগ ও কৌতুহল ‘কে’ আদায় করে নেয় পাঠকের কাছ থেকে।
তাঁর আর একটি অসাধারণ উপন্যাস ‘দ্য ট্রায়াল’। জোসেফ কে – ‘কে’ গ্রেফতার হলে সে জানতে চায় তার অপরাধ কি? কেন গ্রেফতার! ইত্যাদি। পাঠককে সাবধান করা – পাঠক সাবধান, স্থান, কাল, পাত্র নির্বিশেষে এই একুশে আইন হয়তো আপনার জন্যও অপেক্ষা করে আছে!
তাঁর অন্য গল্পগুলিতেও ‘পেনাল কলোনি’, ‘আ কান্ট্রি উইং’, ‘আ হাঙ্গার অরবিট’, ‘দ্য হান্টার গ্রাচুটেস’ এ দেখা যায় নিজের ওপর নামিয়ে আনা পাপবোধ ও দণ্ড। কাফকা মাঝে মাঝে তাঁর চরিত্রদের এক গহীন আঁধারে আবর্তিত করেন। যা কোনো ভাবে ঈশ্বরবোধের ধারণা দিলেও নাশকতার পাঠে ঈশ্বর নাকচ হয়ে যান।
কাফকা মূলত আমাদের আত্মহননের মুখোমুখি দাঁড় করান, যা এখন পরিচিত ‘কাফকায়েস্ক’ নামে। কাফকাকে বলা যেতে পারে এক ‘অবসেসিভ ড্রিমার’। সিগমন্ড ফ্রয়েডের ভেতর দিয়ে কাফকাকে নিয়ে ডুবে যাই অবচেতনের গহীনতায়! এক রোমাঞ্চকর অভিযানে, কাফকার নিজস্ব ভুবনে।
কাফকাকে বলা হয়েছে, এক্সপেরিমেন্টাল পোস্টমর্ডানিস্ট। টাইম এন্ড স্পেস তাঁর লেখায় খুব দ্রুত সঞ্চারমান। যৌবনে ঘটে যাওয়া নভেম্বর বিপ্লব (রাশিয়া ১৯১৭) তাঁকে আগ্রহী করেছিলো সমাজতন্ত্রে ও মার্কসিজমে। তবে তাঁর আগ্রহ ছিলো মানুষের মনোজগতে চেতন ও অবচেতন স্তরে ‘এলিয়েনেশন’ নিয়ে।
কাফকার পাঠে আমরা যদি ক্রমশ অভ্যস্ত হয়ে যাই তাহলে আমরা পেতে পারি এক বিরল স্বাধীনতা! বুঝতে পারি তাঁর গল্প বলার রীতি, ইমেজারি। কাফকা পাঠ অমোঘ ও অনতিক্রম্য। সে সাধারাণ পাঠক, প্রখ্যাত লেখক বা দার্শনিক যে কেউ হোক!
ফ্রানজ কাফকার সাহিত্য এক বিরামহীন পরিক্রমা ও অনুভবী আবিস্কার বিচরণ পথ।
মূল তথ্য
তুহিন বন্দোপাধ্যায়