হযরত শাহ সুলতান কমরুদ্দিন রুমি (রাহঃ): বাংলার প্রথম সুফী সাধক
প্রাথমিক জীবন, ইসলাম প্রচার ও আধ্যাত্মিক শক্তির গল্প
প্রাথমিক জীবন
শাহ সুলতান কমরুদ্দিন রুমি ছিলেন একাদশ শতাব্দীর একজন সুফী মুসলিম সাধক। বাংলায় ইসলাম প্রচারের জন্য যেসকল সুফী সাধকদের আগমন ঘটে তার মধ্যে তিনিই ছিলেন সর্বপ্রথম। তিনি বাংলাদেশের নেত্রকোনাতে ইসলাম প্রচার করেন। হযরত শাহ সুলতান কমরুদ্দিন রুমী (রাহঃ) কত সালে জন্মগ্রহণ করেন তা জানা যায়নি। তবে তিনি একটি রাজবংশে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনি পশ্চিম এশিয়ার সেলজুক রাজবংশের তুরস্ক সুলতানের কনিষ্ঠভ্রাতা ছিলেন। বিজয়ী তুরস্ক রাজ্যকেই অন্য নামে রোম সাম্রাজ্য বলা হতো এবং এর শাসকদের রুমী বলা হতো। তাই সুলতানের সহোদর হওয়ায় হযরত শাহ সুলতানকেও রুমী উপাধিতে অভিহিত করা হয়।
ইসলামের প্রচার ও প্রভাব
হযরত শাহ সুলতান রুমী ১০৫৩ খ্রিস্টাব্দের কিছু পূর্বে ৪৪৫ হিজরীতে পশ্চিম এশিয়ার তুরস্কের সেলজুক রাজ্য থেকে বাংলায় আগমন করেন। প্রথমে তিনি ১২০ জন সুফী সাধকের একটি দল নিয়ে বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূল চট্টগ্রাম অঞ্চলে আসেন। সেখান থেকে তারা পুণ্ড্রর রাজধানী মহাস্থান গড়ে ধর্ম প্রচারের জন্য যাত্রা শুরু করেন। ইতোপূর্বে ১২০ জন সুফী সাধকের একাংশ নিয়ে শাহ সুলতান সৈয়দ মাহমুদ মাহীসাওয়ার বলখী মহাস্থান গড়ের শাসক পরশুরামকে ইসলামের দাওয়াত দেন। এতে রাজা পরশুরাম ক্ষিপ্ত হয়ে শাহ সুলতান মাহীসাওয়ারের দলকে আক্রমণ করেন। এই আক্রমণের ফলে শাহ সুলতান মাহীসাওয়ারসহ সাত জন সঙ্গী শহীদ হন। হযরত শাহ সুলতান কমরউদ্দিন এই সংবাদ পেয়ে তার কায়কাউয়ার নামক সুফীদের সংঘবদ্ধ একটি দল নিয়ে মহাস্থানে পৌঁছান। সেখানে পৌঁছে তিনি রাজা পরশুরামের সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধে লিপ্ত না হয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণের প্রস্তাব দেন। এই প্রস্তাবে রাজা পরশুরাম পুনরায় ক্ষিপ্ত হন। ফলে শাহ সুলতান কমরুদ্দিন তাকে আক্রমণ করেন এবং এই আক্রমণে রাজা পরশুরাম নিহত হন। এরপর তিনি সেখানে কিছুদিন ইসলাম প্রচার করেন।
সেখান থেকে তিনি দুর্মুট নামক স্থানে গমন করেন এবং সেখানে আস্তানা গড়ে ইসলাম প্রচার করেন। সেখান থেকে ব্রহ্মপুত্র নদী অতিক্রম করে বোকাইনগরে পৌঁছে বোকাই কোচকে ইসলামের দীক্ষায় দীক্ষিত করেন। তারপর তিনি বোকাইনগরের পূর্বদিকে মদন কোচের রাজ্য মদনপুরে গিয়ে পৌঁছান। সেখানে গিয়ে তিনি জনগণের মাঝে ইসলামের দাওয়াত দিলে অনেকেই ইসলাম গ্রহণ করেন। রাজা মদনকোচের নিকট এই সংবাদ পৌঁছলে তিনি শাহ সুলতান রুমীকে তার রাজ দরবারে তলব করেন। শাহ সুলতান রুমী তখন তার ৪০ জন সঙ্গীদের নিয়ে রাজা মদনকোচের দরবারে গমন করে সকলকে ইসলামের দাওয়াত দেন এবং আসরের নামাজের জায়নামাজ বিছানোর অনুমতি চান। এই প্রস্তাবে রাজ দরবারের সবাই ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। রাজা মদনকোচ শান্ত মাথায় তাদেরকে হত্যার পরিকল্পনা করেন। বিচক্ষণ রাজা শাহ সুলতান কমরুদ্দিনকে বললেন যে, আমাদের রীতি অনুযায়ী মেহমানদের সর্বপ্রথম শরবত পান করানো হয়। শরবত পান করার পর আপনাদের সকল প্রস্তাব মানা হবে। এই বলে কোচ রাজা তাদেরকে বিষ মেশানো শরবত পান করতে দিলেন।
শাহ কমরুদ্দিন রুমি আধ্যাত্মিক শক্তিসম্পন্ন একজন সাধক ছিলেন। তিনি বিসমিল্লাহ বলে শরবত পান করলেন এবং বাকিরাও বিসমিল্লাহ বলে শরবত পান করলেন। ফলে তাদের কারোরই কিছুই হলো না। যে বিষ পানে মানুষ নিমিষের মধ্যে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে অথচ তাদের কিছুই হলো না, এটা দেখে সবাই আশ্চর্য হয়ে গেলেন এবং শর্তানুযায়ী নামাজের জন্য জায়নামাজ বিছানোর অনুমতি দিলেন। জায়নামাজটি বিছানোর সাথে সাথে তা প্রসারিত হয়ে পুরো রাজ দরবার ছড়িয়ে পড়লো। সুলতান কমরুদ্দিন তার সঙ্গীদের নিয়ে সেখানে নামাজ আদায় করলেন এবং ইসলাম প্রচারের জন্য আল্লাহর নিকট সাহায্য চাইলেন। এই আশ্চর্যজনক ঘটনা দেখে কোচ রাজাসহ সকলের মনোবল ভেঙে যায়। অনেকেই ভয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। কোচ রাজা শেষ পর্যন্ত তার রাজ্য ত্যাগ করে উত্তরে গারো পাহাড়ের দিকে চলে যান। সেখানে যাওয়ার সময় ৫০ মন সোনা সুলতান রুমিকে দিতে চাইলেন। সুলতান কমরুদ্দিন রুমি সোনাগুলো না নেওয়ায় তা পাশের পুকুরে ডুবিয়ে কোচ রাজা তার পরিবার নিয়ে দ্রুত চলে যান।
মৃত্যু
শাহ সুলতান কমরুদ্দিন রুমি একজন রাজ পরিবারের সন্তান হলেও সংসার জীবনে তার কোন টান ছিল না। তিনি সবকিছু ত্যাগ করে আল্লাহর প্রেমে দেওয়ানা হয়ে ইসলাম প্রচারের জন্য বেড়িয়ে আসেন। তিনি কখনও বিয়েও করেননি। ধারণা করা যায় যে, তিনি ১০৭৫ খ্রিস্টাব্দে (৪৭৫ হিজরি) নেত্রকোনার মদনপুরে মৃত্যুবরণ করেন।
মাজার শরীফ
শাহ সুলতান কমরুদ্দিনের মৃত্যুর পর মদনপুরে একটি মাজার নির্মাণ করা হয়েছে। প্রতি বছর তার এই মাজারে ওরস মোবারক অনুষ্ঠিত হয়। এই ওরসে লাখো লাখো মানুষ দূর-দূরান্ত থেকে আসে এবং তার অছিলায় আল্লাহর নিকট দোয়া প্রার্থনা করেন।
রুমীর নামানুসারে কিছু জিনিসের নামকরণ করা হয়েছে:
- শাহ সুলতান জামে মসজিদ, মদনপুর
- শাহ সুলতান ডিগ্রী কলেজ
- শাহ সুলতান উচ্চ বিদ্যালয়, মদনপুর
- শাহ সুলতান ডিজিটাল ইনস্টিটিউট
- শাহ সুলতান ডায়াগনস্টিক সেন্টার
এই সব কিছুর মাধ্যমেই শাহ সুলতান কমরউদ্দিন রুমী মারা গিয়েও এখনো মানুষের মাঝে জীবিত আছেন।
তথ্যবহুল টেবিল
বিষয় | বিবরণ |
---|---|
জন্মস্থান | তুরস্ক, সেলজুক রাজ্য |
আগমন | ১০৫৩ খ্রিস্টাব্দের কিছু পূর্বে |
আগমনের স্থান | চট্টগ্রাম, বাংলাদেশ |
প্রধান কার্যক্রম | ইসলাম প্রচার |
মৃত্যু | ১০৭৫ খ্রিস্টাব্দ, মদনপুর, নেত্রকোনা |
মাজার | মদনপুর, নেত্রকোনা |
অতিরিক্ত তথ্য
শাহ সুলতান কমরুদ্দিনের আধ্যাত্মিক শক্তি
শাহ সুলতান কমরুদ্দিন রুমি ছিলেন একজন আধ্যাত্মিক শক্তিসম্পন্ন সাধক। তার আধ্যাত্মিক শক্তির কারণে তিনি বিভিন্ন অলৌকিক ঘটনা ঘটাতে সক্ষম ছিলেন। যেমন, বিষ মেশানো শরবত পান করার পরও তার এবং তার সঙ্গীদের কিছুই হয়নি। এই ধরনের ঘটনা তার আধ্যাত্মিক শক্তির প্রমাণ বহন করে।
শাহ সুলতান কমরুদ্দিনের বুদ্ধিমত্তা
শাহ সুলতান কমরুদ্দিন রুমি ছিলেন অত্যন্ত বুদ্ধিমান এবং বিচক্ষণ। তিনি যুদ্ধের পরিবর্তে শান্তিপূর্ণভাবে ইসলাম প্রচারের চেষ্টা করতেন। তার বুদ্ধিমত্তার কারণে তিনি অনেক কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে সক্ষম হন এবং সফলভাবে ইসলাম প্রচার করতে পেরেছেন।
শাহ সুলতান কমরুদ্দিনের প্রভাব
শাহ সুলতান কমরুদ্দিন রুমীর প্রভাব আজও বাংলার মানুষের মধ্যে বিদ্যমান। তার নামানুসারে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং স্থাপনার নামকরণ করা হয়েছে। তার মাজারে প্রতি বছর লাখো মানুষ ওরস মোবারকে অংশগ্রহণ করে এবং তার অছিলায় আল্লাহর নিকট দোয়া প্রার্থনা করে।
উপসংহার
হযরত শাহ সুলতান কমরুদ্দিন হযরত শাহ জালালেরও পূর্বে বাংলায় ইসলাম প্রচারের জন্য আসেন। তিনি যখন নেত্রকোনায় এসে পৌঁছান তখন সেখানে কোন মুসলিম জনসংখ্যা ছিল না। তবে তার আধ্যাত্মিক শক্তি এবং অধিক বুদ্ধিমত্তার ফলে তিনি বাংলার মানুষের কাছে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছাতে পেরেছেন।
Discover more from অভিযাত্রী
Subscribe to get the latest posts sent to your email.