অমর কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়: বাংলা সাহিত্যের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র
শরৎচন্দ্রের কালজয়ী রচনাসমূহ ও তাঁর সাহিত্যিক জীবনের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য
অন্য লেখকেরা অনেকে প্রশংসা পেয়েছে, কিন্তু সার্বজনীন হৃদয়ের এমন আতিথ্য পায়নি। এ বিস্ময়ের চমক নয়, এ তো প্রীতি। অনায়াসে যে প্রচুর সফলতা তিনি পেয়েছেন তাতে তিনি আমাদের ঈর্ষাভাজন। আজ তাঁর অভিনন্দন বাংলাদেশের ঘরে ঘরে উচ্ছ্বসিত… তিনি বাঙালীর হৃদয়ে বেদনার কেন্দ্রে আপন বাণীর স্পর্শ দিয়েছেন।
যাঁর সম্পর্কে কথা গুলি বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, তিনি আর কেউ নন, তিনি অমর কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। সন্দেহ নেই একদা ‘বিস্ময়ের চমক’ নিয়েই কথা শিল্পী শরৎচন্দ্রর আবির্ভাব। কেউ ভাবতে পারেননি যখন ‘ভারতী’ পত্রিকায় এক অজানা লেখকের ‘বড়দিদি’ নামে এক উপন্যাসের দুই কিস্তি ছাপা হলো, তখন অনেকেই কল্পনা করতে পারেননি এই অসামান্য রচনা এক অখ্যাত নবীন লেখকের, যার নাম শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। এমনকি শেষ পর্বে যখন তাঁর নাম মুদ্রিত হলো তখনো কাটতে চায়নি অবিশ্বাসের ঘোর।
শরৎচন্দ্রের কয়েকটি রচনা
১. গৃহদাহ
এমন এক যুবতীর প্রেমগাথা, যে একসাথে দুই যুবকের সঙ্গে প্রেমে জড়িয়েছেন কিন্তু আলাদা মর্যাদায়। হৃদয় বিবশতার এক অদেখা, অমূল্য বর্ণন শরৎচন্দ্রের এই কাহিনী।
২. মেজদিদি
মেজদিদি কেষ্টর আপন মায়ের পেটের বোন নন কিন্তু তার চেয়ে বহু অধিক। ভালবাসতেন প্রাণের চেয়ে অধিক। এক নারীর ত্যাগ, তপ, আর মমতার এক ওতোপ্রোতো কাহিনী।
৩. বড়দিদি
১৩১৪ সালে ‘ভারতী’ পত্রিকায় নাম গোপন করে দুই কিস্তি প্রকাশ হলে কেউ ভাবতে পারেননি এর লেখক পরবর্তী কালে এক তুমুল জনপ্রিয় লেখক হয়ে উঠবেন। যা নিয়ে স্বয়ং শরৎচন্দ্র পরবর্তী কালে বলেছিলেন – ওটা আমার বাল্যকালের রচনা। ছাপানো না হলেই বোধহয় ভালো হতো। ‘বড়দিদি’ ও এক মমতাময়ী নারীর অশ্রুজলে ভেজানো শরৎচন্দ্রর এক মর্মকাহিনি।
৪. পন্ডিত মশাই
গল্পটিতে আছে দুই স্বাভিমানী নারী, পুরুষের কথা, যারা পতি-পত্নীও বটে। উভয়ে এক কারণবশত দূরে। কাছে আসতে চান অথচ এক টানাপোড়েনে তা সম্ভব হচ্ছে না। শেষ পর্যন্ত নানা নাটকীয় ঘটনা সংঘটিত হয়ে উপসংহারে তা সম্ভবপর হয়।
৫. পরিণীতা
বাংলা সাহিত্যে থেকে যদি শরৎচন্দ্রকে সরিয়ে দেওয়া যায় তাহলে যা থাকে তা না থাকার মতই। ভারতীয় তৎকালীন সমাজে ছড়ানো যত কুরীতি ও দুর্বলতা সব কিছু বর্ণিত এই উপন্যাসে। ভারতীয় নারীর বাহ্যরূপ ও তার অন্তর্নিহিত আন্তরিক সৌন্দর্য, তার মনোভাবনার চিত্রণ, যে ভাবে শরৎচন্দ্র করতে পেরেছেন ভারতীয় আর কোনো ঔপন্যাসিকরা তার ধারে কাছেও আসতে পারেননি।
৬. শ্রীকান্ত
মানা হয় বাংলা সাহিত্যের এক শ্রেষ্ঠ উপন্যাস হলো ‘শ্রীকান্ত’। এটি ফিল্ম ও টিভি সিরিয়াল হয়েছে। বলা হয় নায়ক চরিত্রটি স্বয়ং শরৎচন্দ্র। কাহিনীটি বর্ণিত হয় নায়কের নিজের মুখে তাই পাঠকের সর্বদা এক কৌতূহল থাকে পরে কি হবে!
৭. দেবদাস
সবচেয়ে জনপ্রিয় উপন্যাস। উল্লেখযোগ্য শ্রীকান্ত ও দেবদাস দুটি রচনাই একশো বছর পার করলো। যাইহোক, দেবদাস পাঠ করে কত তরুণ-তরুণী যে নিজেদের দেবদাস আর পারু ভেবেছে তার ইয়ত্তা নেই। আর বোধহয় কোনো উপন্যাস নেই, যা এমন প্রেমের নিদর্শন তৈরি করেছে! দেবদাস ও পারুর এমন মর্মিকতা আর দ্বিতীয় কোনো গল্পে নেই। কাহিনীর চলচ্চিত্র রূপায়ণেও রেকর্ড ব্রেক করেছে ও ভারতীয় বহু ভাষাতে দেবদাস চিত্রিত হয়েছে।
৮. চরিত্রহীন
শরৎচন্দ্র পাঠকের মস্তিষ্ক নয়, তার মনকে বেশী ছুঁয়ে তার হৃদয় উদ্বেলিত করেছেন। কথা কাহিনীর এমন বিস্তারিত নির্মাণ যে তার মর্মরতা যেন মনে ভিতর পর্যন্ত ছিঁড়ে খুরে ভেদ করে দিতো! তা যেন দীর্ঘকালীন সময় ধরে তার থেকে মুক্ত হতে দিতো না। সতীশ, উপেন্দ্র, দিবাকর, সুরবালা আর কিরণময়ীদের নিয়ে এক ভাব বিভোর কাহিনী বোনা হয়েছে চরিত্রহীন এ।
৯. পথের দাবী
বইটি প্রকাশ হওয়ার কিছুদিন পরেই তৎকালীন ইংরেজ সরকার বইটি রাজদ্রোহমূলক বিবেচনা করে বাজেয়াপ্ত করে। সরকার, লেখক, প্রকাশক, মুদ্রক কাউকে কিছু না বলে বইটির প্রচার বন্ধ করে দেয়। বইটি রাজরোষ হতে মুক্ত হয় শরৎচন্দ্রর মৃত্যুর পর ১৯৩৯ সালে। তখন এর দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়।
১০. শেষ প্রশ্ন
এই বইটি প্রকাশিত হলে কিছু প্রগতিপন্থী চিন্তাশীল ব্যক্তি লেখককে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন ও তেমনি কিছু হিন্দুসমাজের গোঁড়ার দল এই লেখা পড়ে শরৎচন্দ্রর প্রতি নিন্দায় মুখর হয়ে উঠেছিলেন। অত্যন্ত ক্ষিপ্ত হয়ে ছিলেন। প্রকাশকের প্রতি রুষ্ট ও ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন।
অমর কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়: গুরুত্বপূর্ণ তথ্য
১. গৃহদাহ
- যুবতীর প্রেমগাথা
- দুই যুবকের সঙ্গে প্রেম
- হৃদয় বিবশতার অমূল্য বর্ণন
২. মেজদিদি
- কেষ্টর মায়ের পেটের বোন নন
- নারীর ত্যাগ, তপ, মমতার কাহিনী
৩. বড়দিদি
- ‘ভারতী’ পত্রিকায় প্রথম প্রকাশ
- মমতাময়ী নারীর অশ্রুজলে ভেজানো কাহিনী
৪. পন্ডিত মশাই
- দুই স্বাভিমানী নারী ও পুরুষের কাহিনী
- নাটকীয় ঘটনা ও উপসংহার
৫. পরিণীতা
- ভারতীয় সমাজের কুরীতি ও দুর্বলতা
- নারীর বাহ্যরূপ ও আন্তরিক সৌন্দর্য
৬. শ্রীকান্ত
- বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ উপন্যাস
- নায়ক চরিত্রটি স্বয়ং শরৎচন্দ্র
৭. দেবদাস
- সবচেয়ে জনপ্রিয় উপন্যাস
- প্রেমের নিদর্শন ও চলচ্চিত্র রূপায়ণ
৮. চরিত্রহীন
- পাঠকের মন ও হৃদয় উদ্বেলিত
- সতীশ, উপেন্দ্র, দিবাকর, সুরবালা ও কিরণময়ীদের কাহিনী
৯. পথের দাবী
- ইংরেজ সরকারের দ্বারা বাজেয়াপ্ত
- শরৎচন্দ্রর মৃত্যুর পর মুক্তি
১০. শেষ প্রশ্ন
- প্রগতিপন্থী ও গোঁড়া হিন্দুসমাজের প্রতিক্রিয়া
- প্রকাশকের প্রতি রুষ্ট ও ক্রুদ্ধ
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের রচনাসমূহ হিন্দি তো বটেই বহু ভারতীয় ভাষাতে অনূদিত হয়েছে।
Discover more from অভিযাত্রী
Subscribe to get the latest posts sent to your email.