জীবনী

অমর জ্ঞানের আলোয়: বিখ্যাত ৫ মুসলিম বিজ্ঞানীর অবদান ও আবিষ্কার

জাবির ইবনে হাইয়ান, আল খোয়ারিজমি, হাসান ইবনে হাইসাম, ইবনে সিনা এবং আল-বীরুনির অজানা কাহিনী

এইসব গবেষণার ক্ষেত্রে বিভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন বিজ্ঞানীরা অবদান রেখেছেন। তাদের মধ্যে  আলবার্ট আইন্সটাইন, স্যার আইজাক নিউটন, টমাস আলভা এডিসন, লুই পাস্তুর, জেমস ওয়াট, রবার্ট হুক আলেকজান্ডার গ্রাহামবেল সহ অনেক প্রতিভাবান আরো অনেক বিজ্ঞানী আছেন। যাদের অবদানের ফসল আমরা প্রতিনিয়ত ভোগ করছি। কিন্তু এমন কয়জন মুসলিম বিজ্ঞানীর নাম আমরা এভাবে বলতে পারব? জানি অনেকের জন্য এটি কঠিন হয়ে পড়বে। কালের পরিক্রমায় এবং আবিষ্কারের নেশায় মুসলিম বিজ্ঞানীরাও অনেক এগিয়ে ছিলেন।

তারা নিজ মেধা ও মননের দ্বারা পৃথিবীর ইতিহাসে নিজেদের শক্ত অবস্থান তৈরি করেছেন। আমরা আজ জানবো পৃথিবীর সেরা ৫ জন মুসলিম বিজ্ঞানীর আবিষ্কার এবং তাদের সাথে ঘটা মজার কিছু ঘটনা।

১. জাবির ইবনে হাইয়ান

রসায়নশাস্ত্রের জনক হিসাবে পরিচিত জাবির ইবনে হাইয়ানকে নিয়ে আজকের আলোচনা শুরু করা যাক। পূর্বে কিমিয়া, তারপর আলকেমি আর বর্তমানে রসায়নশাস্ত্র। পৃথিবীর যত বিজ্ঞানী রসায়নশাস্ত্র নিয়ে গবেষণা করেছেন তাদের অন্যতম পুরধা হলেন জাবির ইবনে হাইয়ান।

৭২০ খ্রিস্টাব্দে ইরাকের কুফা নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন জাবির ইবনে হাইয়ান। কিমিয়া তথা রসায়নকে যারা প্রকৃত বিজ্ঞান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার প্রয়াস চালিয়েছেন তাদের মধ্যে জাবির ইবনে হাইয়ান ছিল তাদের পথিকৃৎ।

তার গবেষণার পরিধি ব্যাপক হলেও নানা বিষয় নিয়ে গবেষণা করলেও রসায়নবিজ্ঞান নিয়ে তার অবদানই সর্বাধিক। তিনি রসায়ন বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ের উপর গবেষণা করে অনেক বই-পুস্তক লিখেছেন।

‘বুক অফ কম্পজিশন অব আল-কেমি’ তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য। অন্যদিকে জাবির ইবনে হাইয়ান বিভিন্ন বিষয়ের উপর প্রায় পাঁচশো’রও অধিক বই লিখেছেন রসায়নবিজ্ঞনের কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সমূহ  যেমন পরিস্রবণ, দ্রবণ, ভস্মীকরণ, বাষ্পীকরণ, প্রভৃতি তাঁরই আবিষ্কার।

তিনি তাঁর গ্রন্থে ধাতুর শোধন, তরলীকরণ, লোহা মরিচা রোধক বার্ণিশ, লেখার কালি ও কাঁচ ইত্যাদি দ্রব্য প্রস্তত প্রণালি ও বিধি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেন। তিনি ইরাকের কুফায় একটি বিজ্ঞানাগার প্রতিষ্ঠা করে মৃত্যু পূর্ব পর্যন্ত সেখানেই গবেষণা করতেন।

জাবির ইবনে হাইয়ান রসায়নশাস্থের ব্যাপক উন্নতি সাধন করেন। তাঁর এই উন্নতির অবদান স্বরূপ তাকে রসায়নশাস্ত্রের জনক বলা হয়ে থাকে। ৮১৫ খ্রিস্টাব্দে ইন্তেকাল করেন এই মহান ব্যাক্তি।

২. আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ ইবনে মুসা আল খোয়ারিজমি

মুসা আর খারিজমি তার পুরো নাম আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ ইবনে মুসা আল খোয়ারিজমি। ইরানের  খিভা প্রদেশে ৭৮০ খ্রিস্টাব্দে খোয়ারিজমি নামক জায়গাতে তিনি জন্মগ্রহন করেন। খোয়ারজমিকে  গণিতশাস্ত্রের জনক বলা হয়।

মূলত বীজগণিতের আবিষ্কারের একমাত্র দাবিদার তিনি। এ বিষয়ে তাঁর রচিত ‘হিসাব আল জাবর ওয়াল মুকাবালাহ’ গ্রন্থে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। এই বইয়ের নামানুসারে বীজগণিত শাস্ত্রকে পরবর্তীকালে ইউরোপীয়রা আল-জেবরা নাম দেন।

বিজ্ঞাপন

ঋনাত্মক রাশির চিহ্ন পরিবর্তন করে সমীকরণের একপাশ থেকে অন্যপাশে নেওয়ার পদ্ধতি প্রবর্তনের কৃতিত্ব খোয়ারিজমির। তিনি হিসাব আল জাবর ওয়াল মুকাবালাহ গ্রন্থে আট শতাধিক উদাহরণ লিপিবদ্ধ করেন।

সমীকরণ সমাধান ক্ষেত্রে ছয়টি নিয়ম তিনি আবিষ্কার করেন। গণিত বিষয়ের উপর তাঁর আরো অসংখ্য বই রয়েছে। ‘কিতাবুল হিসাব আল আদাদ আল হিন্দী’ তাঁর পাটিগণিত বিষয়ক বই। এছাড়াও জ্যামিতি বিষয়ে তার অবদান অনেক।

তাঁর গণিতশাস্ত্র দ্বারা উমর খৈয়াম, লিওনার্দো, ফিরোনাসসি এবং মাস্টার জ্যাকবসহ আরও অনেকেই প্রভাবিত হয়েছেন। আনুমানিক ৮৫০ খ্রিস্টাব্দে তিনি মৃত্যবরণ করেন।

৩. হাসান ইবনে হাইসাম

ইউক্লিড আর টলেমি যেখানে বলেছিলেন যে, আলো চোখ থেকে বস্তুতে পড়ে বলেই আমরা দেখতে পাই; সেখানে একজন চক্ষুবিজ্ঞানী তাদের থিওরি হাতে কলমে ভুল প্রমাণ করছিলেন। তার  অন্য একটি পরিচয় হলো তিনি একজন মুসলিম বিজ্ঞানী। সেই বিজ্ঞানীর পুরো নাম হলো হাসান ইবনে হাইসাম।

তিনি প্রথম প্রমাণ করেছিলেন, বাহ্যবস্তু থেকেই আলো আমাদের চোখে প্রতফলিত হয় বলে বস্তু দৃষ্টিগোচর হয়। তার জন্ম সম্পর্কে আমাদের কাছে তথ্য আছে তিনি ৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। দর্শন, জ্যোতির্বিদ্যা, চিকিৎসাশাস্ত্র, গণিত প্রভৃতি বিষয়ে পন্ডিত ছিলেন এবং তিনি শতাধিক গ্রন্থ রচনা করেন।

চক্ষুবিজ্ঞান বিষয়ক মৌলিক গ্রন্থ ‘কিতাবুল মানাযির’ তাঁকে ইতিহাসে বিখ্যাত করে রেখেছে। আধুনিক কালের বিজ্ঞানীরা গতিবিজ্ঞানকে তাদের আবিষ্কার বলে দাবি করলেও ইবনে হাইসাম এ বিষয়ে বহু পূর্বেই বিস্তারিত বর্ণনা করেছিলেন।

মাধ্যাকর্ষণ বিষয়ে তিনি তাঁর বইসমূহে বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন। স্যার আইজ্যাক নিউটনকে মাধ্যাকর্ষণ সম্পর্কিত শক্তির আবিষ্কারকের মর্যাদা পেলেও। ধারণা করা হয় ইবনে হাইসাম এ বিষয়ে প্রথম ধারণা দিয়েছিলেন বলে মনে করা হয়।

৪. ইবনে সিনা

এবার যাকে নিয়ে আমরা কথা বলবো তাকে আমরা প্রায় সবাই চিনি। তাকে আমরা ইবনে সিনা বলে চিনি। কিন্তু তার পুরো নাম আবু আলি আল হুসাইন ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে সিনা। তিনি বুখারার কাছাকাছি আফশানা নামক গ্রামে ৯৮০ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। মাত্র দশ বছর বয়সে পবিত্র কুরআন শরীফ পুরোটা মুখস্থ করেন।

তার পরিচয় দার্শনিক,চিকিৎসক, গণিতজ্ঞ, জ্যোতির্বিদ।মুসলিম বিশ্বের একজন বিখ্যাত বিজ্ঞানী ও সর্ববিদ্যায় পারদর্শী ছিলেন। আধুনিক শল্যচিকিৎসার দিশারী হিসাবে তাকে মূল্যায়ন করা হয়। চিকিৎসায় তাঁর অসাধারণ অবদানের জন্য তাঁকে আধুনিক চিকিৎসাশাস্ত্র ও চিকিৎসা প্রণালি এবং শল্যচিকিৎসার পথিকৃৎ মান্য করা হয়।

তাঁর রচিত অসংখ্য বই রয়েছে। তবে চিকিৎসাশাস্ত্রে ‘আল- কানুন ফিত-তিবব’ একটি বিখ্যাত  গ্রন্থ। ড. ওসলার নামক এক পন্ডিত এ গ্রন্থটিকে চিকিৎসাশাস্ত্রের বাইবেল বলে উল্লেখ করেছেন। মনে করা হয়, চিকিৎসাশাস্ত্রে এই বইয়ের  সমপর্যায়ের কোনো বই আজও কেউ রচনা করতে সক্ষম হয় নি।

বর্তমান বিশ্বেও তাঁর গ্রন্থটি বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ করে চিকিৎসাবিজ্ঞানে পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। চিকিৎসা সমন্ধীয় যাবতীয় তথ্যের আশ্চর্য রকম সমাবেশ থাকার কারণে গ্রন্থটিকে চিকিৎসাশাস্ত্রের বিশাল এক সংগ্রহশালা বলে আখ্যা দিয়েছেন অনেক চিকিৎসাশাস্ত্রবিদরা। ইবনে সিনা ১০৩৭ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন।

৫. জাবির ইবনে সিনান আল বাত্তানী

পৃথিবীর এক বছর সমান যে ৩৬৫ দিন, ৫ ঘণ্টা, ৪৬ মিনিট,২৪ সেকেন্ড তা প্রথম হিসাব করে বের করেন জোর্তিবিজ্ঞানের জ্যোতি জাবির ইবনে সিনান আল বাত্তানী। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো, তাঁর এই হিসাবের সাথে আজকের  আন্তর্জাতিক হিসাবের পার্থক্য মাত্র ২৭ মিনিটের।

জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ে বিশেষ জ্ঞানের অধিকারী জাবির ইবনে সিনান আল বাত্তানী। মেসোপোটেমিয়ার অধীনস্থ মিশরের বাত্তান নগরীতে নবম শতাব্দীতে জন্মগ্রহণ করেন। জ্যোতির্বিজ্ঞান এর উপর তিনি চারটি গ্রন্থ রচনা করেছেন।

যেগুলো জ্যোতির্বিদ্যার জ্ঞান লাভের জন্য বর্তমানে আলোকবর্তিকা। মুসলিম এই মনীষী ৯২৯ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যু বরণ করেন।

আবদুল্লাহ আল মাসুদ

My name is Abdullah AL Masud. I work as a content creator at ovizatri.com and am a founding member of this online news and blog publishing company, alongside admin MD Mehedi Hasan. I graduated with a degree in History from Rajshahi College, Rajshahi, Bangladesh. Additionally, I serve as a senior Rover mate representative for Bangladesh Scouts in the Rajshahi District.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button