মাহবুবে ইলাহী: খাজা নিজামুদ্দিন আউলিয়া (রহঃ) এর জীবন ও শিক্ষা
দিল্লীর মহান আউলিয়ার জীবন, শিক্ষা ও মানবসেবার অনন্য কাহিনী
মাহবুবে ইলাহী হযরত খাজা নিজামুদ্দিন আউলিয়া (রহঃ) হিজরি ৬৩৬ সালে দিল্লির উত্তর প্রদেশে বাদায়ুন নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন। ঈসায়ী সালের হিসাব মতে তা ছিল ১২৩৮ খ্রিস্টাব্দ।
বংশ পরিচয়
শেখ নিজামুদ্দিন আউলিয়ার দাদা ছিলেন খাজা আলী এবং নানা ছিলেন খাজা আরব। তারা দুজনে একে অন্যের ভাই ও বন্ধু ছিলেন। খাজা আরবের এক পুত্র ছিল তার নাম খাজা আব্দুল্লাহ ও এক কন্যা ছিল যার নাম বিবি জোলায়খা। খাজা আলীর ও এক পুত্র সন্তান ছিল যার নাম খাজা আহম্মদ। খাজা আহম্মদের সঙ্গে বিবি জোলায়খার বিবাহ হয়। ১২৩৮ খ্রিস্টাব্দে তাদের ঘর আলো করে এক পুত্র সন্তানের জন্ম হয়। আর এই পুত্র সন্তানই হলেন খাজা নিজামুদ্দিন আউলিয়া।
শিক্ষা গ্রহণ
নিজামুদ্দিন আউলিয়া ছোট বেলা থেকেই অন্য বাচ্চাদের থেকে আলাদা ছিলেন। ছোটকাল থেকেই তিনি তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছিলেন। শৈশব কাল থেকেই তার মনমানসিকতা দেখে তার পিতামাতা বুঝতে পেরেছিলেন যে এই ছেলে একদিন জগতের পূজনীয় ব্যক্তিরূপে পরিগণিত হবে। নিজামুদ্দিন আউলিয়ার বয়স যখন ৫ বছর তখন তার পিতা পরলোক গমন করেন।
স্বামীকে হারিয়ে বিবি জোলায়খা একা হয়ে পড়েন। সংসারের কাজকর্ম করা এবং ছেলেকে লেখাপড়া করানোর কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। তিনি ছেলেকে মক্তবে ভর্তি করিয়ে দিলেন। নিজামুদ্দিন আউলিয়া প্রথমে পবিত্র কোরআন শরীফ খতম করলেন এবং হযরত মাওলানা আলাউদ্দিন উমুলীর নিকট ফিকহ শাস্ত্রের কিতাবসমূহ অধ্যয়ন করেন। পাশাপাশি তিনি মক্তবের অন্যান্য বিষয়গুলোর জ্ঞান অর্জন করেন।
মক্তবের জ্ঞান অর্জন শেষ করে নিজামুদ্দিন আউলিয়া তার মায়ের নির্দেশে প্রখ্যাত কামিল ও শিক্ষাবিদ হযরত মাওলানা শামসুদ্দিন দামাগানী (রহঃ) এর শীষ্যত্ব গ্রহণ করেন। তিনি নিজামুদ্দিন আউলিয়াকে দেখে বুঝতে পারলেন ছেলেটি অধিক গুণ সম্পন্ন। তাই তিনি নিজামুদ্দিনকে শিক্ষা দান করে মানুষ করলেন।
হাদীস শরীফে জ্ঞান অর্জন
ধর্মীয় শাস্ত্র ফিকহ, উম্মুল আকাইদ, সাহিত্য ইত্যাদি বিষয়ে জ্ঞান লাভ করার পর নিজামুদ্দিন আউলিয়া হাদীস শরীফে শিক্ষা লাভের ইচ্ছা পোষণ করেন। তাই তিনি তৎকালীন বুজুর্গ ও হাদীস বিশারদ হযরত মাওলানা কামালুদ্দিন (রহঃ) এর সাহচার্যে হাদীস বিষয়ে জ্ঞান লাভ করেন। সে সময় হাদীস বিশারদ মাওলানা আহমদ তাবারাজি ছিলেন অতি উচ্চে। কিন্তু পরবর্তীতে নিজামুদ্দিন আউলিয়া তার চেয়ে অধিক জ্ঞানী হিসেবে প্রসিদ্ধ লাভ করেছিলেন।
অন্যান্য বিষয়ে জ্ঞানলাভ
নিজামুদ্দিন আউলিয়া হাদীস শরীফের পাশাপাশি জ্যোতির্বিদ্যা, গণিত শাস্ত্র, ফিকহ, আকাইদ, ইতিহাস সাহিত্য ইত্যাদি বিষয়ে বিভিন্ন মাশায়েখদের নিকট থেকে জ্ঞান লাভ করেছিলেন। তিনি একজন সুপন্ডিত ও শাস্ত্রকার ছিলেন। তার পান্ডিত্য সকলকে মুগ্ধ করেছিলেন।
তরিকতের জ্ঞানলাভ
নিজামুদ্দিন আউলিয়া বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করার পরেও তার মনে সন্তুষ্টি এলোনা। তিনি মনে করত জাহেরিভাবে ধর্ম পুরো সম্পন্ন হয়না। তাই তিনি বাতেনি জ্ঞান লাভের প্রতি আকৃষ্ট হয়। তিনি ভাবতেন কিভাবে ইলমে বাতেনের পরিপূর্ণতা লাভ করা যায়। তাই তিনি শায়খ নাজিমুদ্দিন মুতাওয়াকিল (রহঃ) এর দিল্লীর বিখ্যাত তাশতদার মসজিদের হুজুরখানায় অবস্থান করেন। তিনি ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ অলিয়ে কামিল হযরত বাবা ফরিদুদ্দিন গঞ্জেশকর (রহঃ) এর ছোট ভাই। তরিকতের ক্ষেত্রে তিনি ফরিদুদ্দিন গঞ্জেশকর (রহঃ) এর পথ অবলম্বন করেন।
ফরিদুদ্দিন গঞ্জেশকরের সাক্ষাত
নিজামুদ্দিন আউলিয়া হিজরি ৬৫৫ সালের ১০ই রজব শায়খ ফরিদুদ্দিন গঞ্জেশকর (রহঃ) এর সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য তার খানকায় উপস্থিত হন। তার খানকা ছিল অযোধ্যায়। সে সময় নিজামুদ্দিনের বয়স ছিল ২০ বছর। নিজামুদ্দিন আউলিয়া ফরিদুদ্দিন গঞ্জেশকরকে পরম শ্রদ্ধাভরে কদমবুসি করলেন। ফরিদুদ্দিন গঞ্জেশকরের যা কিছু ছিল তার সবই তিনি নিজামুদ্দিনকে দান করলেন।
নিজামুদ্দিন সেখানে থেকে তালিম, তারবিয়াত ও তাওয়াজ্জ্বত গ্রহণ করেন। ১০ই রজব হতে পরবর্তী সালের ২রা রবিউল আউয়াল পর্যন্ত একটি বছর তিনি তার পীর মুর্শিদ শায়খ ফরিদুদ্দিন গঞ্জেশকরের দরবারে অতিবাহিত করেছিলেন। এবং সে সময় তিনি রিয়াজত ও মোজাহাদার উন্নত স্তরে সমুন্নত হয়েছিলেন। তারপর তিনি দিল্লীতে ফিরে আসলেন।
সম্রাটদের বায়াত গ্রহণ
মাহবুবে ইলাহী নিজামুদ্দিন আউলিয়া দিল্লীতে ফেরার পর দিল্লীর সম্রাটদের অনেকেই তার মুরীদ ছিলেন। সম্রাটের পুত্র শাহাজাদা খিজির খাঁ ও নিজামুদ্দিনের নিকট বায়াত গ্রহণ করেন। নিজামুদ্দিন সম্রাটদের সাথে যেমন ব্যবহার করতেন গরিব দুঃখীদের সাথেও তেমন ব্যবহার করতেন। গরীব ধনী উচু নিচু কারোর কোন ভেদাভেদ নেই তার দরবারে। বিশ্ব বিখ্যাত সম্রাট আমীর কাশেম হাজেরের মাধ্যমে এই মহান আউলিয়ার নিকট ৫০ হাজার রৌপ্য মুদ্রা পাঠালেন। কিন্তু নিজামুদ্দিন আউলিয়া পূর্বকৃত ওয়াদার কারণে মুদ্রাগুলোর দিকে তাকালেন ও না। রৌপ্য মুদ্রার চেয়ে ওয়াদা পালন তার কাছে বেশি মূল্যবান।
ইন্তেকাল
ঐতিহাসিকদের মতে, ৭২৫ সালের ১১ রবিউল আউয়াল মাসে নিজামুদ্দিন আউলিয়া (রহঃ) মহান আল্লাহ তায়ালার সান্নিধ্য লাভে হাজির হন। দীর্ঘ ৮৯ বছর তিনি দ্বীন ইসলামের খেদমতে অতিবাহিত করেন। তার মৃত্যুতে কেমন যেন এক শোকার্ত হাহাকারে দিল্লীর আকাশ বাতাস ভারী হয়ে উঠল।
মাজার শরীফ
ভারতের দিল্লীতে নিজামুদ্দিন আউলিয়ার মাজার। মেহবুবে এলাহির ভক্ত ও আসেকানরা দূর-দুরান্ত থেকে আসে এই মাজার জিয়ারত করতে। তার মাজার দেখতে অনেক সুন্দর। এই মাজারের বর্তমান কাঠামো ১৫৬২ সালে নির্মাণ করা হয়। এর প্রত্যেকটি দেয়াল এতটাই সুন্দর যে, মনে হয় স্বর্ণের তৈরি।
উপসংহার
হযরত নিজামুদ্দিন আউলিয়া (রহঃ) শুধু একজন নির্বাচিত জীবন সন্ধানীই ছিলেন না বরং তিনি ইবাদত বন্দেগীর মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভে সক্ষম হয়েছিলেন। মানুষের সেবাই তিনি সবসময় নিয়োজিত থাকতেন। শুধু তাই নয়, তিনি জনসেবা ও ঐশী প্রেমে সবসময় একজন বিশিষ্ট মর্যাদার অধিকারি ছিলেন। তাই ভারতবাসীদের ইতিহাসে তার নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে।
Discover more from অভিযাত্রী
Subscribe to get the latest posts sent to your email.