কলম

স্বাদের স্মৃতি: বাংলার রান্নাঘরের কাহিনী

বাঙালির রান্নার ইতিহাস ও সংস্কৃতি

বিজ্ঞাপন

ঘরে স্ত্রীর হাঁড়িমুখ ভালো লাগছে না। উল্টো পাল্টা বাজার করে আনলে তো তার ঐ রকমই প্রতিক্রিয়া হবে। দেশী পারশে ও চিনে পারশের তফাৎ না করতে পারা, সজনে ডাঁটার সঙ্গে নাজনে, দার্জিলিঙ্গের কমলা লেবু- এতো দাম দিয়ে তার বদলে কিনো লেবু কিনে আনা!

শাক-সবজি, মাছ-মাংস সবার বৈশিষ্ট্য দেখে বাজার হতে কিনতে হয়। আর তা রান্নাও অনেক রকম। প্রকৃত রসিক জন জানেন নিজের হাতের রান্না হলো বিলাস আর পরের হাতের রান্না বেসন। বাজার, রান্না, কিছু স্মৃতি জোড়া লাগানো যায় কি?

সব না মনে করে শুধু কিছু আমিষ নিয়ে স্মৃতিচারণ করা যাক।

বাংলার ঐতিহ্য ইলিশ মাছ

বলা হয় কোথাও এর নাম নেই। কার নাম? কার আবার! স্বর্গে বা বেহেস্ত, কোথাও কি “ইলিশ” শুনতে পাওয়া যায়!

বর্ষাকাল। পশ্চিমে দু’খন্ড বড়ো মেঘ, মাঝে বেশ খানিক নীল আর কমলা রংয়ের রোদ্দুর। নুন গুড়ুনি বৃষ্টি তে রুপনারায়ণের (ভারত) জলে বয়ে যাচ্ছে ইলিশ মাছ।ঝুড়ঝুড়ে বৃষ্টি পড়ছে কালচে খয়েড়ী রংয়ের ছোট নৌকার মাথায়।

বিজ্ঞাপন

রুপনারায়ণের কুলে কোলাঘাট। ওই খানে ধরা যতো যুবক ও যুবতী ইলিশ মাছ চলে আসে সোজা কলকাতায়। এসে কুচো বরফের ওপর শুয়ে পড়ে।

দু’জনের চেহারা দু’রকম। পুরুষ ইলিশ সরু ও কালচে, মহিলা ইলিশ বড়োসড়ো, গোলগাল। বাজারে দোকানদার বলে- নিয়ে যান বাবু অথবা স্যর, খেয়ে দেখবেন একেবারে কবিতার মতো!

ইলিশ সমুদ্রে যতো দিন থাকে, নোনতা জলে খায় টায় না বিশেষ। ফলে তাদের স্বাস্থ্য ও স্বাদ বাড়ে না। যেই না মিষ্টি জলের নদীতে পড়ে, তাদের খাওয়া বেড়ে মন মেজাজ ভাল হয়ে শরীরে তেল চর্বি  বেড়ে স্বাদু হয়ে ওঠে।

ইলিশের তেল চর্বি বেশী ধোয়াধুই নয়, ইলিশ কিনে আগে ভালো ভাবে ধুয়ে তবে আঁশ ছাড়িয়ে টুকরো করো।

গঙ্গা, পদ্মা, গোদাবরী নিয়ে ঝগড়া না করে, এখনো ডিম আসেনি এমন একটি মহিলা ইলিশ কিনে ফেলো। পরে রাই সরষে ভাপা, অল্প গরম ভাতে মেখে থালার ওপর নিজের মাথাটি নামিয়ে এনে এক গরাস ভাত মুখে দিন দিকিনি।

বিজ্ঞাপন

মাংস

মাংস মানে খাসি বা পাঁঠা- মুরগি নয়। সেই সময় জয়েন্ট ফ্যামিলিতে মাসের দুই আর চার নং রবিবারে কাঠ কয়লার ডবল উনুনে মাংস রাঁধা হতো। গন্ধের টানে সবাই বাড়ীতে তাড়াতাড়ি ফিরতো।

বাজারে স্পেশাল দোকানদার, কতটা মাংস আর কি রান্না হবে জেনে মাংস পছন্দ করে দিতেন। কালিয়া হলে সামনের রাং বা গর্দান, কষা হলে বাঁ দিকের সিনা, কিমা করতে হলে পিছলি রাং। টলটলে ঝোল হলে বলি হওয়া পাঁঠার খোঁজ পড়তো।

বিয়ের পরই নতুন জামাই শ্বশুর বাড়ী দুপুর বেলা খেতে বসেছে। ঘরটিতে শান বাঁধানো লাল মেঝেয় ফুলকারি করা মোটা আসন। কাঁসার থালায় সরু চালের সাদা ঝরঝরে ভাত। পদ্মকাটা কাঁসার বাটিতে ঝোল থকথকে রেওয়াজি খাসির কালিয়া। তাতে চন্দ্রমুখী আলু আধখানা করে কাটা ও গলা গলা টমেটো। একটি দুটি তেজপাতা। থালার একপাশে দু’ফালি শান্ত শিষ্ট পাতিলেবু।

শাশুড়ী মা তসরের লাল পেড়ে শাড়ী পরে এক এক পিস মাংস যত্নসহকারে তুলে দিচ্ছেন। ‘আর পারবো না’ – বলতেই অল্প হেসে বললেন, ‘ভাত টুকু না খেয়ে বরং মাংস খাও, তোমাদের জন্যই তো করেছি’।

ডিম

ভোরে চোখ ফোটার পর ঘর ভর্তি আলো। দাঁত মেজে ঘরে বসে লিকার চা খেতে খেতে বেশীর ভাগ দিন ডিমের সুগন্ধ ভেসে আসে কিচেন থেকে লীলা মজুমদারের ঘরাণা ফলো করে বলা হয় ‘মামলেট’। ওমলেট বললে স্বাদ কম, স্বাদ কম লাগে।

বিজ্ঞাপন

ফ্রেঞ্চ টোস্ট, এগ-স্যান্ডুয়িচ, এগ রোল সে যাই বানানো হোক, তাতে গাওয়া ঘি বা মাখন পড়বে। হাই ফ্যাট, হাাই ক্যালোরি।

বাজারের ডিমওলা হাতে ধরা একখানি আস্ত ডিমকে ষাট ওয়াটের আলোর সামনে শার্লক হোমসের মতো ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখেন কেন? কারণ হাঁস মুরগি যাই হোক ডিমের কুসুমটি কে ভেতরে জেলির মতো অংশে একেবারে মাঝখানে ভেসে থাকতে হবে। কুসুম যদি এক পাশে সরে যায় বা কালচে দেখায় তবে তা পচতে শুরু করেছে।

পোলট্রির ডিমের রমরমা হলেও দেশী হাঁসের ডিম বেশী ফেবার করা হতো। মুরগির ডিম বা মাংস খেতে হলে উঠোনের এক পাশে স্টোভ জ্বেলে আলাদা বাসনে রান্না করা হতো। পরে গঙ্গা জল ছিটিয়ে ঘরে ঢোকা।

আজকাল বাজারে বিক্রেতারা হাঁস মুরগির ডিমের সঙ্গে দু’একটি ফিকে নীলাভ হাঁসের ডিম আনেন। এই ডিম হাফ বয়েল করে মাখন, নুন, মরিচ, পেঁয়াজ কুচি, লংকা কুচি দিয়ে গরমা গরম ভাতে মেখে খাবেন ডিমের ওপর প্রথমচাপ দিলেই লালচে কমলা কুসুম এমন ছিটকে ছড়িয়ে যাবে, মনে হবে বুঝি মাতলা নদীর বুকে সদ্য সুর্যোদয় হলো।

আজ এই পর্যন্তই। আরও বহু পদ আছে। ভেজ, ননভেজ। শুধু জানতে হবে রান্না একটি শিল্পকর্ম। আর সঙ্গে বাজার করাও। কোন জিনিসটি কোন জিনিসের সাথে ম্য্যাচ করবে এ-ও একজন দক্ষ কলাকার জানেন।

বিজ্ঞাপন

এক একদিন অসামান্য বাজার করে এনে কিছু হারিয়ে যাওয়া রান্নাকে ফিরিয়ে এনে চমকে দিন সবাইকে।

তথ্যঋণ

রজতেন্দ্র মুখোপাধ্যায়

ছবি: Image by freepik

বিজ্ঞাপন


Discover more from অভিযাত্রী

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন

শ্রীমতী স্মৃতি দত্ত

অ্যাডভোকেট, লেখিকা, বঙ্গীয় সাহিত্যের সদস্য, কীবোর্ড প্লেয়ার, অ্যামওয়ে ব্যবসার মালিক। আমার লেখা সর্বশেষ বইয়ের নাম, ‘কেমেষ্ট্রি প্র্যাকটিক্যাল ও টি.ভি শো’ এবং ‘লেনিন সাহেবের সাথে দেখা’ বইটি Flipkart -এ নেবার জন্য ক্লিক করুন: https://www.flipkart.com/lenin-saheber-sathe-dekha/p/itmc9bfae4c39392

আপনার মতামত জানান?

বিজ্ঞাপন
Back to top button

Discover more from অভিযাত্রী

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading