মোস্তফা কামাল: একজন ধনী ব্যক্তির অদ্ভুত জীবনকাহিনী
বাংলাদেশের অত্যন্ত সফল উদ্যোক্তা মোস্তফা কামালের জীবন ও কার্যক্রম
মোস্তফা কামাল, আজ তিনি হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক। তার প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে হাজার হাজার মানুষ তাদের জীবিকা নির্বাহ করে। বর্তমানে তার সম্পদের পরিমাণ কত এই প্রশ্ন করলে হয়তো চট করে সঠিক উত্তরটাও দিতে পারবেন না। অথচ একসময় তার নিজের দিন কেটেছে না খেয়ে। বাড়ি থেকে ১১ কিলোমিটার দূরের কলেজে যেতে বাবার কাছে সাইকেল কিনে চেয়েও পাননি।
পরে রাগ করে চলে আসেন রাজধানী ঢাকায়। নাম মাত্র বেতনে কাজ নেন পুরান ঢাকার মৌলভীবাজারের একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে। আজ তার শিল্প কারখানার সংখ্যা ৪৮ টি। বেশিরভাগই নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ে। মেঘনার তীরে গড়ে ওঠা তাঁর সব প্রতিষ্ঠানের নাম রেখেছেন সেই নদীর নামে। তবে তাঁর ব্র্যান্ডের নাম ‘ফ্রেশ’।
তেল, চিনি, দুধ, চা পাতা, বিস্কিট, পানি ফ্রেশ আপ নামের একটি কার্বনেটেড বেভারেজ, মসলার ব্যবসা, সহ বিভিন্ন ভোগ্য পণ্য। সিমেন্ট স্টিল সিরামিক কাগজ টিস্যু জাহাজ নির্মাণ এলপিজি স্টেশনারি সামগ্রী কেমিকাল টিভি চ্যানেল প্রাইভেট এয়ারপ্লেন কি নেই তাদের! এমনকি তাদের কয়েকটি অর্থনৈতিক অঞ্চলও আছে।
দেশের শীর্ষস্থানীয় সেই শিল্পগোষ্ঠী মেঘনা গ্রুপের ফাউন্ডার মোস্তফা কামালের বাবা লঞ্চে চাকরি করেছেন। অথচ তারই ছেলে এখন ১০০টি বড় জাহাজের মালিক। টাকার অভাবে পরিবার কিনতো কালো কেরোসিন সেই কেরোসিনে হারকিনের কাঁচ কালো হয়ে যেত অল্প সময়ে। অথচ সেই মানুষটির সন্তানেরা উচ্চ শিক্ষা নিয়েছেন ইউরোপ আমেরিকায়।
১১ কিলোমিটার হেঁটে কলেজ যাবেন না বলে পড়াশোনা ছেড়ে দেওয়া মানুষটির প্রতিষ্ঠানে এখন কয়েক হাজার গাড়ি চলে। তার বাবা নূর মিয়া ছিলেন পুলিশের একটি লঞ্চের কর্মচারী। ভরসা করে তার কাছে টাকা আমানত রাখত মানুষ। হঠাৎ একদিন টাকা চুরি হয়ে যায়। সংসারের খরচ অর্ধেকে নামিয়ে আনলেন। ছয় মাসে পরিশোধ করলেন সবার দেনা।
এই সময়ে কোনদিন খাবার জুটতো আবার কোনদিন জুটতো না। মোস্তফা কামালের জন্ম ১৯৫৫ সালে। তার জন্মস্থান কুমিল্লা জেলায়। অগ্রহায়ণ মাস থেকে পৌষ মাস পর্যন্ত তার পরিবারে চলতো তীব্র অভাব। মা-বাবা নিজেরা না খেয়ে খাবার দিতেন সন্তানকে। সকালে জুটতো এক মুঠো চাল ভাজা। এরপর সারাদিন অভুক্ত। বিকেলে ফেরার পথে কলের পানিই সম্বল।
১৯৭৩ সালে ঢাকায় আসেন তিনি। পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের সদস্য এক পরিচিত ভাইয়ের ব্যারাকে আশ্রয় নেন। এরপর যাত্রাবাড়ীতে একটি বাসায় কয়েক মাস লজিং। লজিং মাস্টারি শেষে পুরান ঢাকার একটি দোকানে ১৭৫ টাকা বেতনে চাকরি শুরু করেন। খরচ বাঁচাতে থাকা শুরু করেন লঞ্চে। লঞ্চের মেঝেতে মাদুর বিছিয়ে ঘুমাতেন।
সকালে কেরোসিনের চুলায় রান্না করতেন। একটা ডিমের অর্ধেকটা সকালে খেতেন আর বাকিটা থাকতো রাতের জন্য। এক সময় ছেড়ে দিলেন দোকানের সেই চাকরি। নামলেন পরিবহন ব্যবসায়। পুরনো গাড়ি কিনে চালাতেন গুলিস্তান থেকে ফার্মগেটে। রুট পারমিট ছিল না বলে বারবার পুলিশ গাড়ি ধরতো। ত্যাক্ত ও বিরক্ত হয়ে তারপর বাদি দিলেন এই কর্ম।
এরপরেই করলেন ট্রেড লাইসেন্স। প্রতিষ্ঠানের নাম দিলেন কামাল ট্রেডিং ঠিকানা দেওয়া হলো পরিচিত একটি টঙের দোকান এর। চাকরি করার সময় মহাজন প্রায়ই তাকে ঢাকা ভেজিটেবলে পাঠাতেন। ঢাকা ভেজিটেবলের সে পরিচয় কে কাজে লাগালেন তিনি। এক কর্মকর্তাকে তিনি অনুরোধ করেন সাব ডিলার করে দেওয়ার। সেই টং দোকানকে ঠিকানা দেখিয়ে ট্রেড লাইসেন্স লিখে দিলেন তিনি।
তার এই ব্যবসাটাই ঘুরিয়ে দেয় তার জীবনের মোড়। আগে তার মাস শেষে আয় হতো ১৭৫ টাকা। এই ব্যবসা শুরু করার পর তার সেই আয় বেড়ে দাঁড়ালো দুই থেকে তিন হাজার টাকা। সেই আমলে এটি প্রায় পাহাড়সম অংক। আশির দশকের শুরুতে কসকো সাবানকে পণ্য সরবরাহ করা শুরু করেন।
চিন্তা করলেন পণ্য আমদানি পড়া শুরু করবেন কিন্তু প্রথম রাতের পামওয়েল আসলো নিম্নমানের। সেই তেল খরচের তিনভাগের একভাগ দামে বেচতে বাধ্য হলেন। ব্যাংকের টাকা শোধ করবেন কিভাবে কোন কূলকিনারা খুঁজে পাচ্ছিলেন না তিনি। পরে অনেক অনুরোধের পর সুদ মাপ করে কিস্তির ব্যবস্থা করল ব্যাংক। ধীরে ধীরে শোধ করলেন সেই টাকা।
১৯৮৭ সালে মেঘনা নদীর তীরে ১৫০০০ টাকা বিঘায় জমি কেনেন। দুই বছর পর কয়েকজন মিলে মেঘনা ঘাটে শুরু করেন ভেজিটেবল ওয়েল ইন্ডাস্ট্রিজ এর। বিনিয়োগ প্রায় ৩০ কোটি টাকা।
এরপর গুঁড়া দুধ প্যাকিং কারখানা ও সিমেন্ট কারখানা গড়ে তুললেন। এক সময় আরো বাড়লো কারখানার সংখ্যা। বাড়তে থাকলো কারখানাগুলোতে কর্মচারীর সংখ্যা। আজ প্রায় ৩৫ হাজার পরিবারের জীবিকার উৎস মেঘনা গ্রুপ অফ ইন্ডাস্ট্রিজ বা এমজিআই। অর্থবৃত্ত হয়েছে বলে মোস্তফা কামাল পাল্টাননি। এখনো তার প্রিয় খাদ্য মাছ, ভাত, শাকসবজি এবং ডাল।
খাওয়া দাওয়া করেন অত্যন্ত সীমিত পরিমাণে। দেশে-বিদেশে ঘুরাঘুরি করা তার শখ। কারখানা দেখতে এক দেশ থেকে আরেক দেশে ছুটে বেড়ান। জীবনের শুরুর দিকের কষ্টের কথা ভুলেননি তিনি। নিজের জন্মস্থানে শিক্ষার জন্য দান করেছেন অকাতরে। কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম এ গড়ে তুলেছেন স্কুল কলেজ এমনকি ইউনিভার্সিটিও। আসলেই মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল একজন বড় হৃদয়ের মানুষ।
যারা নিজেদের সফলতার সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছার পরেও নিজের শিকড় কে ভুলে না তাদেরকে সত্যিই মহৎ বলতেই হয়, তাদের প্রশংসা না করলে নিজের বিবেকের কাছে দায়বদ্ধতা থেকে যাবে। আর বিশিষ্ট শিল্পপতি মোস্তফা কামাল নিজের জন্মস্থানের জন্য যা কিছু করেছেন সত্যিই তা প্রশংসার দাবিদার। আর মোস্তফা কামালের জীবনী থেকে আমাদের তরুণ প্রজন্মের শিক্ষা নিতে হবে যে, “জন্ম হোক যথা তথা কর্ম হোক ভালো”।
Discover more from অভিযাত্রী
Subscribe to get the latest posts sent to your email.