ফিলিস্তিনিজম (Philistinism): শিল্প, সংস্কৃতি ও বুদ্ধিবৃত্তির বিরুদ্ধে মধ্যবিত্তের অন্ধ বিদ্বেষ
আজকের সমাজে ফিলিস্তিনিজমের প্রভাব কী?
শিল্প, সংস্কৃতি ও বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মকান্ডের প্রতি বিরুপ বা উদাসীন থাকাকে ‘ফিলিস্তিনিজম (Philistinism)’ বলা হয়। এই শব্দটির উৎস হলো জার্মান শব্দ ‘ফিলিস্টার (Philister)’। এই ধরণের মানসিকতার মানুষ শিল্প, সংস্কৃতি বা বুদ্ধিবৃত্তিক যে কোন কর্মকান্ডকে মান্যতা দেয় না। ভিন্ন অর্থে, এরা এসব বিষয়ে উদাসীন থাকে বা একধরনের বিরুপ প্রতিক্রিয়া এদের মধ্যে দেখা যায়। প্রায়শই কিছু মানুষকে বলতে দেখবেন যে, “আমি খুব সাধারণ মানুষ, সাধারণ আমার জীবিকা, আমার এত জেনে লাভ নাই।” আবার কথোপকথনে আপনার প্রসঙ্গকে চুপ করে দিয়ে বলতে পারে, “তুই কি এখন কবি-সাহিত্যিক, দার্শনিক হয়ে গেছিস!”
এরাই হচ্ছে ‘ফিলিস্তিনিজম (Philistinism)’ দর্শনে বিশ্বাসী মানুষ এবং এই দাবীটি আমার নয়। এই দাবী বা শব্দের ব্যবহার করতে দেখা যায় ১৭ শতকে জার্মানির কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের। ১৯ শতকে এসে ম্যাথিউ আর্নল্ড এই শব্দটিকে ইংরেজিতে জনপ্রিয় শব্দে উপস্থাপন করতে সক্ষম হোন। ফ্রিডরিখ নীটশে ১৮৭৩ সালে একটি বই লেখেন ‘Untimely Meditations’ নামক এবং এই বইয়ের ‘David Strauss: the Confessor and the Writer’ এই প্রবন্ধে তিনি ‘ফিলিস্তিনিজম (Philistinism)’ ব্যাখ্যা করেন। আজকের এই বিখ্যাত অস্তিত্ববাদী দার্শনিক সে সময় মানুষের কাছে তেমন গ্রহণযোগ্যতা পায়নি, কেউ কেউ তো তাকে পাগলও বলতো। আর আজকের এই ছোট্ট প্রবন্ধে আমি ফ্রিডরিখ নীটশের ফিলিস্তিনিজম নিয়েই কথা বলবো।
তিনি বড়ই অদ্ভুত লোক ছিলেন। মানে সবসময় তিনি বলে বেড়াতেন, “God is dead.”। এমন মানুষ যিনি সবসময় বলেই যাচ্ছে, “স্রষ্টা মরে গেছেন”, তাকে মানুষ পাগল ছাড়া সে সময় আর কি বলতো বা ভাবতো আমি ঠিক জানি না। কিন্তু পরবর্তীতে তিনি অস্তিত্ববাদী দার্শনিক হিসেবে বহু প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠে আসেন।
‘David Strauss: the Confessor and the Writer’ এই প্রবন্ধে সংস্কৃতির সমালোচক হিসেবে তিনি ছাপ ছাপ জানিয়ে দিয়েছেন যে, ফিলিস্টারেরা কখনোই সত্যিকারের শিল্প ও সংস্কৃতিকে এপ্রেশিয়েট করতে জানে না। এমনকি এদের তো কোন জেনুইন (প্রকৃত) আগ্রহ-ই নাই শিল্প, সংস্কৃতি ও বুদ্ধিবৃদ্ধিক কর্মকান্ডে। কেন? কারণ এরা মস্তিষ্ক ব্যবহার করার ক্ষেত্রে ভয়ানক অলস। যা কিছুই জনপ্রিয়, যা কিছুই পূর্ব বিশ্বাস বা ধারণা, যা চলছে তা গভীরে গিয়ে ভাববার এদের কোনরুপ ইচ্ছা বা অবকাশ নাই। উল্টো এসবকে কোন প্রশ্ন না করে মেনে নিয়ে একধরণের অটোপাইলট জীবন-যাপন করাতেই এরা ব্যস্ত। শুধু তাই নয়, ফ্রিডরিখ নীটশে আরো বলেন, এরা শিল্প ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে সিলেক্টিভ মানে এদের কাছে যে শিল্প ও সংস্কৃতি নিরাপদ ও রুচিতে যায় শুধুমাত্র সেটুকুই গ্রহণ করে থাকে।
ঠিকাছে, কিছু লোক যদি শিল্প ও সংস্কৃতি নাই-বা মানেন তাতে কি’বা আসে যায়! কিন্তু ফ্রিডরিখ নীটশে এটাকে শিল্প ও সংস্কৃতির প্রতি হুমকি স্বরুপ এবং ফিলিস্তিনিজমের কারণে শিল্প ও সংস্কৃতি একদিন বিলুপ্ত হয়ে যাবে বলে মনে করেন। বর্তমানের প্রেক্ষাপটে যদি চারপাশে একটু চোখ রাখেন তাহলে আমরাও দেখি, আমাদের সাথে আসলে কি হচ্ছে! (Don’t connect the dots)।
উক্ত প্রবন্ধে নিন্দা করেন বস্তুবাদ, ভোগবাদ ও সামাজিক অবস্থার প্রতি বেশি গুরুত্বারোপ করার জন্য। কারণ আমরা জীবনের উদ্দেশ্য ও সাফল্য বলতে বুঝি কার ক’টা গাড়ি আছে, কার ক’টা বাড়ি আছে, কার কত ভালো চাকুরী বা আয় আছে বা সামজিক মর্যাদা আছে বা টাকা আছে ইত্যাদি।
এখানে নীটশে ‘Self-Contradictory’ তে পড়ে যান। কারণ, একটু আগেই বলেছিলাম লোকটা পাগল, তিনি সবসময় বলেন, “স্রষ্টা মরে গেছেন।” এখন স্রষ্টা যদি মরেই যান তাহলে বস্তুবাদ বা ভোগবাদে সমস্যা কোথায়! তাই না? কারণ যিনি স্রষ্টাকে মেরে ফেলছেন তার পাশাপাশি ধর্মকেও মেরে ফেলছেন। এখন যদি ধর্ম না থাকে তাহলে আমাকে তো কেউ ধরতে বা বলতে আসছে না যে, দ্যাখো, তোমার পাঁচটা বাড়ির তো প্রয়োজন নাই! এত টাকা অপব্যয় কেন করছো? এত খাচ্ছো কেন পথে ভিখারীকে কিছু কি দিয়েছো? দশজনের সাথে বিয়ে না করেই সেক্স করছো কেন? তুমি মি. ‘ক’ কে গোপনে হত্যা করেছো এতে তোমার কোন খারাপলাগা নাই? নাই, কোন নিয়মনীতিরই বালাই নাই।
নীটশে কে এভাবে ব্যাখ্যা কিছুটা হলেও করা যায়। এই যিনি বলছেন প্রচলিত খ্রিষ্টান ধর্মের দরকার নাই এই আধুনিক দুনিয়ায়, এই ধর্মের স্রষ্টা মারা গেছেন, সে-ই তিনি আবার বলছেন, “না, নতুন সমাজের জন্য নতুন মোরাল সেট করতে হবে।” কিন্তু এই প্রবন্ধে আবার বলছেন একটি গভীর বা বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজের কথা। যে সমাজ চিন্তা করতে জানে, যে সমাজ বস্তুবাদ, ভোগবাদ ও সামাজিক মর্যাদার উপরে শিল্প, সংস্কৃতি ও দর্শন কে রাখতে পারে। সমাজে বস্তুবাদ ও ভোগবাদ থাক, কিন্তু এত থাকাও উচিত নয় যা সমাজ থেকে একেবারে শিল্প, সংস্কৃতি ও দর্শন কে উপড়ে ফেলে দেয় বা কোনরুপ পাত্তা দেয় না। আর এই প্রবণতাকে তিনি ফিলিস্তিনিজম বলেছেন।
ফ্রিডরিখ নীটশে তার বিখ্যাত উক্তি “God is dead” মূলত দুটি প্রধান গ্রন্থে ব্যবহার করেছিলেন, (১) The Gay Science (১৮৮২) এবং (২) Thus Spoke Zarathustra (১৮৮৩)। উক্ত উক্তির পরের বাক্য পড়লেই ব্যাখ্যা কিন্তু ভিন্ন হয়ে যাবে, “God is dead. God remains dead. And we have killed him.”।
মানে হচ্ছে, নীটশে কোন নতুন স্রষ্টার সূচনা করতে চাননি, না নাস্তিকতাকে বাহবা দিয়েছেন। একইসাথ তিনি বস্তুবাদ ও ভোগবাদ এত বেড়ে যাওয়া দেখে এর বিরুদ্ধে ‘Übermensch (অতিমানব)’ ধারণার প্রস্তাবনা রাখেন। বাংলা ভাষায় বিষয়টি কিছুটা এরকম, ধর্ম তো আছে কিন্তু আমরা কেউ-ই ধর্ম কে মানছি না। তাই স্বাভাবিক ভাবেই মোরাল সংকট দাঁড়িয়ে গেছে। আবার আধুনিক দুনিয়ায় ধর্মের অনেক রীতিনীতি পালন করা সম্ভব হচ্ছে না, মানে ধর্ম বেশকিছু জায়গায় ব্যর্থ, ফলে মানুষ বিপথে যাচ্ছে এবং সামনে আরো ভয়ানক অবস্থা হতে পারে। এটাকে স্বীকার করে নতুন মোরাল ব্যবস্থা নিয়ে আসতে হবে। কিন্তু আমরা এই সংকট কে স্বীকার-ই করছি না।
কিন্তু এই আলোচনা একেবারে ভিন্ন আলোচনা তাই ফিলিস্তিনিজম প্রসঙ্গে পুনরায় ফিরে যাচ্ছি। একটু রিক্যাপ হয়ে যাক, প্রথমত নীটশে ছাপ ছাপ বলছেন যে, এই যে সার্ফেস লেভেলে (উপরিভাগ স্তরে) থাকা চিন্তার বা মানসিকতার মানুষ শিল্প ও সংস্কৃতি বিলুপ্তির কারণ হতে পারে। দ্বিতীয়ত, বস্তুবাদ, ভোগবাদ ও সামজিক মর্যাদার উপরে গিয়ে আমাদেরকে শিল্প, সংস্কৃতি ও দর্শনকে বেশি মূল্যায়ন করতে হবে একটি গভীর/বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজের জন্য। কিন্তু এসবই কোনভাবেই পালন বা রক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে না কারণ ফিলিস্তিনিজম।
উক্ত প্রবন্ধে একেবারে শেষে এসে নীটশে বলছেন, এই ফিলিস্তিনিজম চর্চা করতে দেখা যায় এক ধরণের বুর্জোয়া শ্রেনীর মানুষদের। কে এই বুর্জোয়া শ্রেনীতে পড়ে? তিনি এবারে সরাসরি আক্রমণ করেছেন সমাজের মধ্যবিত্ত মানুষদের। এরাই সে-ই সব আজব প্রাণী যারা চিন্তা করতে পছন্দ করেন না, বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চাকে ভয় পায় বা এড়িয়ে চলে। এরাই আর্থিক সফলতাকে বা বৃদ্ধিকে বেশি বিশ্বাস করে বা মূল্যায়ন করে শিল্প ও সংস্কৃতির উন্নয়নের/উন্নতির চেয়ে। এরা সৃজনশীলতাকে দাম দেয় না। এরা নতুন উদ্ভাবন কে সহজে গ্রহণ করতে চায় না। এরা সার্ফেস লেভেলের আইডিয়া নিয়ে চলে যা গভীর/বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য প্রধান বাধা। এদের শিল্প, সংস্কৃতি, দর্শন, উদ্ভাবন বা যে কোন সৃজনশীলতার প্রতি কোন আগ্রহ নাই।
এই মধ্যবিত্ত সমাজ নিয়ে বহু প্রবন্ধ আজকাল লেখাও হচ্ছে। কিন্তু এরাই সেই বুর্জোয়া, যারা প্রায়শই বা কথায় কথায় বলে, “আমার তো বউ-বাচ্চা আছে, চাকুরী আছে… অনেক দায়িত্ব… এসব জ্ঞান দিয়ে আমার পেট ভরবে না।” কিন্তু একটি পরিবার, একটি কর্মস্থল/পেশা/কাজ, একটি সম্পর্ক – এ সমস্ত কিছুই বিনা প্রশ্নে এক ধরণের অটোপাইলট জীবন-যাপন কি করা সম্ভব? এসব ফাউন্ডেশন অনেক গুরুত্বপূর্ণ তাই এসব নিয়ে গভীর চিন্তারও অনেক প্রয়োজন। কিন্তু মধ্যবিত্ত আজীবন এক রুটিন জীবন পালন করতে রাজী। এরা সবসময় ঐ ট্রেনে বা বাসে উঠে থাকে যে ট্রেন বা বাস তাদের গন্তব্যস্থলে বারবার পৌঁছে দেয় এমন ‘Conformity’ বিদ্যমান।
ফিলিস্তিনিজম নিয়ে আজ এই পর্যন্তই। খোদা হাফেজ!
Discover more from অভিযাত্রী
Subscribe to get the latest posts sent to your email.