ইতিহাস

নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়: কে ধ্বংস করেছিল? ইতিহাসের বহুমুখী দিক

খিলজির তলোয়ার, নাকি অন্য কারণ? নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের পতনের ইতিবৃত্ত

বিজ্ঞাপন

নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়, প্রাচীন ভারতের জ্ঞানের এক উজ্জ্বল কেন্দ্র, ১২ শতকের শুরুতে ধ্বংস হয়ে যায়। কে এই ধ্বংসযজ্ঞের জন্য দায়ী ছিলেন, তা নিয়ে বিতর্ক এখনও চলমান। ঐতিহাসিকরা মুসলিম আক্রমণকারী বখতিয়ার খিলজিকে প্রধান অভিযুক্ত হিসেবে চিহ্নিত করেন, আবার কেউ কেউ হিন্দু সেন রাজাদের দায়িত্বের দিকে ইঙ্গিত করেন। প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহের মতো অন্যান্য কারণও সম্ভাব্য।

ধর্মীয় পক্ষপাত এড়িয়ে বস্তুনিষ্ঠ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ঘটনার তদন্ত করা গুরুত্বপূর্ণ। ঐতিহাসিক সত্য উন্মোচন এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সংরক্ষণ করা আমাদের কর্তব্য। নালন্দার ধ্বংস কেবল একটি ঐতিহাসিক ঘটনা নয়, বরং জ্ঞান ও শিক্ষার প্রতি হুমকির প্রতীক।

এই রহস্য সমাধানের জন্য আরও গবেষণা ও আলোচনার প্রয়োজন। ঐতিহাসিক প্রমাণগুলি পুনর্বিশ্লেষণ এবং নতুন তথ্য উন্মোচন আমাদেরকে এই জ্ঞানের কেন্দ্রের পতনের পূর্ণাঙ্গ চিত্র দিতে সাহায্য করবে।

প্রায়শই আমরা যে বিষয়গুলোতে আগ্রহ অনুভব করি না, প্রকৃতি সেই বিষয়গুলো আমাদের জানার জন্য বাধ্য করে। ইতিহাস আমার কাছে এমনই একটি বিষয়, যার প্রতি আমার কখনোই কোনো আগ্রহ ছিল না। ইতিহাসের গুরুত্ব নিয়ে আমি কখনো বিশেষ কৌতুহলী ছিলাম না, এবং আজও নই। তবে, আমি এমন কিছু বিষয় লক্ষ্য করছি যা নিয়ে লিখতে গেলে ইতিহাসের জ্ঞান ছাড়া চলবে না। এমনকি, ইতিহাস না জানার কারণে আমার গল্পের গভীরতা হ্রাস পাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে।

 

বিজ্ঞাপন

আজকের আলোচনা হলো বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয় ‘নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়’ নিয়ে। আমি ইতিহাসের পাতা ঘেঁটে এবং বহু আর্টিকেল পড়ে খুঁজে বের করেছি যে, কে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ধ্বংসের জন্য দায়ী। এখন আমার সামনে চ্যালেঞ্জ হলো এই তথ্যগুলোকে নিরপেক্ষভাবে উপস্থাপন করা।

 

নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়, যা প্রায় ৫ম শতাব্দীর শুরুতে বর্তমান ভারতের বিহারের মগধে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, একটি বিশ্বব্যাপী শিক্ষার মিলনস্থল ছিল। এখানে প্রায় ১০,০০০ শিক্ষার্থী এবং ২,০০০ শিক্ষক ছিলেন, যারা কোরিয়া, জাপান, চীন, ইন্দোনেশিয়া, ইরান, তুরস্ক এবং তিব্বত সহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগত ছিলেন। এটি বৌদ্ধ ধর্মের একটি প্রধান গবেষণা কেন্দ্র ছিল, যা অনেকে ‘মহাবিহার’ বলে অভিহিত করেন। এখানে বৌদ্ধ ধর্মশাস্ত্র, দর্শন, গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা, চিকিৎসাশাস্ত্র, সাহিত্য এবং শিল্পজ্ঞানের মতো বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষা দেওয়া হত, এবং হিন্দু এবং জৈন ধর্মের উপরও পাঠদান করা হত।

 

সম্প্রতি প্রতিষ্ঠিত ইতিহাস অনুযায়ী, মুহাম্মদ ঘুরীর সেনাপতি এবং বাংলা ও বিহার বিজেতা ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বখতিয়ার খলজি নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংস করেছিলেন। তার এই কর্মের ফলে অনেক বৌদ্ধ ভিক্ষু অত্যাচারের শিকার হন। খলজি দিল্লী সালতানাতের একজন প্রভাবশালী সেনাপতি ছিলেন এবং তার সময়ে ইসলাম ধর্মের প্রচার ও প্রসার ঘটে। তবে, তিনি কেন একটি বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংস করেছিলেন, এই প্রশ্নটি আজও বিতর্কের বিষয়। বর্তমানে ভারত ও বাংলাদেশে এই ঘটনা নিয়ে হিন্দু ও মুসলিমদের মধ্যে দ্বন্দ্ব চলছে। খলজির ইসলাম প্রচারের কাজকে মুসলিমরা প্রশংসা করলেও, যদি তিনি সত্যিই বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংস ও গণহত্যায় জড়িত থাকেন, তাহলে তা অত্যন্ত নিন্দনীয় কাজ হিসেবে বিবেচিত হওয়া উচিত। এই ঘটনার পেছনের কারণগুলো নিয়ে আজও অনেক প্রশ্ন রয়েছে।

বিজ্ঞাপন

 

নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় একাধিকবার আক্রমণের শিকার হয়েছে, যার মধ্যে তিনটি প্রধান আক্রমণ উল্লেখযোগ্য: ১. প্রথম আক্রমণ: ৫ম শতাব্দীর শেষভাগে, সম্রাট মিহিরকুল নালন্দায় আক্রমণ করেন এবং অনেক ছাত্র এবং বৌদ্ধ গুরুদের হত্যা করা হয়। ২. দ্বিতীয় আক্রমণ: সপ্তম শতাব্দীতে, বাংলার গৌরদেশ রাজবংশ নালন্দায় আক্রমণ করেছিল বলে ধারণা করা হয়। ৩. তৃতীয় বা সর্বশেষ আক্রমণ: এই আক্রমণের পর নালন্দা আর পুনর্গঠিত হয়নি। এই আক্রমণে বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় লাইব্রেরি পুড়িয়ে ফেলা হয় এবং অনেক অর্থ-সম্পদ লুন্ঠন করা হয়। অধিকাংশ ইতিহাসবিদ এই আক্রমণের দায় খিলজীকে দেন, যদিও কিছু ইতিহাসবিদ ইন্দ্রদ্যুম্ন, গৌড়ের রাজা শশাঙ্ক, বা আফগান শাসক মালিক ইয়াসুদিনের নামও উল্লেখ করেন।

 

ডি.এন. ঝাঁ এর মতামত নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের ধ্বংসের বিষয়ে একটি বিকল্প দৃষ্টিকোণ প্রদান করে। তার গবেষণা অনুযায়ী, নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের ধ্বংসের জন্য হিন্দু সেন রাজবংশকে দায়ী করা হয়। তার যুক্তিগুলি হলো:

  • ধ্বংসের সময়: ঝাঁ অনুযায়ী, নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ১২ম শতাব্দীর শেষভাগে ধ্বংস হয়েছিল, যখন ভারতে হিন্দু সেন রাজবংশ শাসন করছিল।
  • ধর্মীয় কারণ: ঝাঁ মনে করেন যে নালন্দা একটি বৌদ্ধ প্রতিষ্ঠান হিসেবে হিন্দু জাতীয়তাবাদী সেন রাজাদের দ্বারা ধ্বংস করা হয়েছিল।
  • ঐতিহাসিক প্রমাণ: ঝাঁ মুসলিম ঐতিহাসিক ইবন আহমাদের লেখা উল্লেখ করেন, যিনি বলেছিলেন যে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় এক ‘স্থানীয় রাজা’ দ্বারা ধ্বংস করা হয়েছিল, যাকে ঝাঁ সেন রাজা হিসেবে চিহ্নিত করেন।

অনির্বাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতামত নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের ধ্বংসের বিষয়ে একটি বহুমাত্রিক দৃষ্টিকোণ প্রদান করে। তিনি এই ঘটনার জন্য কোনো নির্দিষ্ট পক্ষকে সরাসরি দায়ী করেননি এবং বলেন যে এটি একক কারণ দ্বারা ব্যাখ্যা করা যাবে না। তার মতে, নালন্দার ধ্বংসের পেছনে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ এবং অন্যান্য বহুমুখী কারণ রয়েছে। তিনি আরও বলেন যে সেন রাজারা, যারা হিন্দু ছিলেন, তারা বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি শত্রুতাপূর্ণ মনোভাব অবলম্বন করেছিলেন, যা নালন্দা ধ্বংসের একটি সম্ভাব্য কারণ হতে পারে।

বিজ্ঞাপন

রমেশচন্দ্র মজুমদার এবং শশীভূষণ সেনগুপ্ত, উভয়েই বিখ্যাত ভারতীয় ঐতিহাসিক, যারা বাংলার ইতিহাস নিয়ে গভীর গবেষণা করেছেন। মজুমদারের মতে, নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংসের জন্য সেন রাজা ত্রিলোচনপাল দায়ী ছিলেন, যিনি একজন কট্টরপন্থী হিন্দু ছিলেন এবং বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি শত্রুতাপূর্ণ মনোভাব পোষণ করতেন। অন্যদিকে, সেনগুপ্ত মনে করেন যে সেন রাজা বিজয়সেন নালন্দা ধ্বংসের জন্য দায়ী ছিলেন, যিনি একজন শক্তিশালী রাজা ছিলেন এবং সম্ভবত তার শক্তি প্রমাণ করতে এই কাজ করেছিলেন।

নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের ধ্বংসের পেছনে সেন বংশের দায়িত্বের পক্ষে যুক্তিদাতা হিসেবে উল্লেখিত ঐতিহাসিকদের মতামত নিম্নরূপ:

১. আন্টোনিও টেসোরি: ইতালীয় পণ্ডিত যিনি তিব্বতের ইতিহাস ও সংস্কৃতির উপর গবেষণা করেছেন।
২. মেলভিন কাউর: আমেরিকান পণ্ডিত, তিব্বতের রাজনৈতিক ইতিহাসের উপর গবেষণা করেছেন।
৩. তিব্বতী ঐতিহাসিকরা: তিব্বতের বৌদ্ধ গ্রন্থগুলিতে নালন্দা ধ্বংসের জন্য সেন রাজাদের উল্লেখ পাওয়া যায়।
৪. যদুনাথ সরকার: মধ্যযুগীয় ভারতের ইতিহাসের উপর লেখা বইয়ের জন্য বিখ্যাত ভারতীয় ঐতিহাসিক।
৫. শরৎচন্দ্র দাশ: বাংলার ইতিহাসের উপর লেখা বইয়ের জন্য বিখ্যাত বাঙালি লেখক ও ঐতিহাসিক।
৬. লামা তারানাথ: ভারতের ইতিহাস সম্পর্কে লেখা বইয়ের জন্য বিখ্যাত তিব্বতীয় বৌদ্ধ ভিক্ষু ও ঐতিহাসিক।
৭. ড. ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত: প্রাচীন ভারতের ইতিহাসের উপর লেখা বইয়ের জন্য বিখ্যাত ভারতীয় ইতিহাসবিদ।
৮. বুদ্ধপ্রকাশ: বৌদ্ধ ধর্ম ও দর্শনের উপর লেখা বইয়ের জন্য বিখ্যাত ভারতীয় বৌদ্ধ ভিক্ষু ও পণ্ডিত।
৯. ভিক্ষু সুনীথানন্দ: বৌদ্ধ ইতিহাস ও সংস্কৃতির উপর লেখা বইয়ের জন্য বিখ্যাত ভারতীয় বৌদ্ধ ভিক্ষু ও পণ্ডিত।

এই ঐতিহাসিকদের মতামত অনুযায়ী, নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের ধ্বংসের পেছনে সেন বংশের হাত রয়েছে।

নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের ধ্বংসের বিষয়ে বিভিন্ন ঐতিহাসিকদের মতামত এবং গবেষণা রয়েছে, যা এই ঘটনার বিভিন্ন দিক তুলে ধরে। বখতিয়ার খিলজির দ্বারা ধ্বংসের পক্ষে মিনহাজ-উদ-দীন সিরাজ, আবুল ফজল, এবং H.C. Raychaudhuri এর মতামত রয়েছে। অন্যদিকে, K.A. Nilakanta Sastri এবং Ramesh Chandra Majumdar স্থানীয় আক্রমণকারীদের দ্বারা ধ্বংসের সম্ভাবনা উল্লেখ করেছেন। Bimal Churn Law এবং Ramgopal আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও দুর্নীতির কারণে ধ্বংসের পক্ষে যুক্তি দিয়েছেন, এবং D.D. Kosambi এবং Sunil Kumar Sinha প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ধ্বংসের সম্ভাবনা উল্লেখ করেছেন।

বিজ্ঞাপন

ঐতিহাসিক প্রমাণ অনুসারে, বখতিয়ার খিলজি নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংস করেছিলেন – এই ধারণাটি ব্যাপকভাবে প্রচলিত, তবে বিতর্কিতও। বর্তমানে অনলাইন মিডিয়া ও কিছু লেখায় খিলজিকে একমাত্র দায়ী করা হচ্ছে, যা হিন্দু-মুসলিম বিদ্বেষ বাড়িয়ে দিচ্ছে এবং সম্প্রীতি নষ্ট করছে।

আমি মনে করি, নালন্দা ধ্বংসের জন্য সমস্ত সম্ভাব্য কারণ ও দায়ীদের বিশ্লেষণ করা উচিত। ধর্মীয় পক্ষপাত ছাড়াই বস্তুনিষ্ঠ তথ্য উপস্থাপন করা প্রয়োজন। ইতিহাসের পুরো চিত্র উপস্থাপন করা উচিত, যাতে ভুল বোঝাবুঝি দূর হয়।

আমাদের উচিত ঐতিহাসিক তথ্যের সঠিক ও নিরপেক্ষ উপস্থাপনার মাধ্যমে ধর্মীয় বিভেদ দূর করা এবং হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ বৃদ্ধি করা।


Discover more from অভিযাত্রী

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন

মেহেদি হাসান (বিকেল)

প্রধান সম্পাদক, অভিযাত্রী

আপনার মতামত জানান?

বিজ্ঞাপন
Back to top button

Discover more from অভিযাত্রী

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading