ওমর খৈয়াম ছিলেন মধ্যযুগের পারসিক জ্যোতির্বিজ্ঞানী, গাণিতিক, দার্শনিক ও কবি। তবে উনিশ শতকের আগে বিদ্বৎসমাজ কবি হিসেবে তাঁর সম্বন্ধে ধারণা ছিল অতি সামান্য। কিন্তু ইংরেজ কবি ও অনুবাদক এডওয়ার্ড ফিটজেরাল্ড ওমর খৈয়ামের অমর সৃষ্টি ‘রুবাইয়াত’ বা চতুষ্পদী কবিতা অনুবাদের মাধ্যমে বিশ্বসভায় উপস্হাপন করলে একটি মানসিক জাগরণের সূত্রপাত হয়।
হাজার বছর আগে রচিত ওমর খৈয়ামের রুবাইয়াত ছিল প্রচলিত সামাজিক অনাচার ও ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে প্রথম উচ্চারিত প্রতিবাদ ও চেতনা। সেগুলো ছিল নির্যাতন ও নিপীড়নের সঙ্গে লড়াই করার ছোট্ট একটি কার্যকরী অস্ত্র – যা এ যুগেরও আদর্শ হয়ে রয়েছে।
একাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে আনুমানিক ১০৪৮ সালে পারস্যের খোরাসানের অন্তর্গত নিশাপুরে ওমর খৈয়ামের জন্ম। তাঁর পুরো নাম, ‘আবুল ফাতাহ্ গিয়াসুদ্দিন ওমর ইবনে ইব্রাহিম আল-খৈয়াম’। সাধারণ্যে তিনি ওমর খৈয়াম নামেই পরিচিত।
ওমর খৈয়ামের পিতা ইব্রাহিম খৈয়াম সেনাকর্মকর্তাদের তাঁবু নির্মাণ করতেন। তিনি আর্থিকভাবে সচ্ছল ছিলেন না। তবে সেলজুক সুলতান তুগ্রিল বেগের আনুকূল্য-উদারতা এবং স্বীয় শিল্পনৈপুণ্যের গুণে ইব্রাহিম খৈয়ামের দরিদ্র অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়েছিল। ‘খৈয়াম’ তুর্কি শব্দ। এর অর্থ তাঁবু নির্মাতা। তবে তাঁবু নির্মাতার পুত্র হলেও ওমর খৈয়াম নিজে কোনোদিন তাঁবু নির্মাণ করেন নি।
ওমরের পিতা বিদ্যা-শিক্ষার জন্য ওমরকে নিশাপুর বিদ্যালয়ের জ্ঞানীশ্রেষ্ঠ ইমাম মোয়াফিকের নিকট পাঠান। এখানে তাঁর আরও দুজন সহপাঠী ছিল – হাসান তুসী এবং হাসান সাব্বাহ। তিন সহপাঠীর একটি গল্প প্রচলিত আছে। তিন বন্ধু প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন যে, পরবর্তী জীবনে তাঁদের মধ্যে কোনো একজন প্রতিষ্ঠিত হলে অপর দু’জনকে সাহায্য করবে।
কর্মজীবনে হাসান তুসী খোরাসানের সেলজুক সুলতানের প্রধানমন্ত্রীর পদলাভ করেন এবং নিজাম-উল-মুলক উপাধিতে ভূষিত হন। নিজাম-উল-মুলক রাজদরবারে হাসান সাব্বাহকে একটি উচ্চপদ দেন। কিন্তু ষড়যন্ত্রের অভিযোগে হাসান সাব্বাহকে পদচ্যুত ও বিতাড়িত করা হয়। পরবর্তীকালে হাসান সাব্বাহ রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র ও রক্তপাতের জন্য ‘গুপ্তহত্যাকারী’ নামে ইতিহাসে পরিচিতি লাভ করেন।
হাসান তুসীর মন্ত্রিত্ব লাভ করা পর্যন্ত ওমরের কোনো খোঁজ পাওয়া যায় না। হয়তো এ সময় তিনি বিদ্যা ও কাব্যচর্চায় ব্যাপৃত ছিলেন। তিনি বিবাহিত ছিলেন নাকি সারাজীবন বিয়ে না করেই কাটিয়েছেন সে তথ্যও পাওয়া যায় না।
তবে খৈয়ামের উত্তর পরুষ ওমর আলী শাহ সাম্প্রতিককালে ওমর খৈয়ামের যে প্রমাণসই জীবনীগ্রন্হ রচনা করেছেন তাতে তিনি দাবি করেন, হালিমা বেগম ছিলেন ওমরের প্রণয়িনী। তার পিতা সালেম বেগ ছিলেন সেলজুক সুলতানের দরবারের কর্মচারী।
কিন্তু জনৈক প্রৌঢ় উজির হালিমার রূপে মুগ্ধ হয়ে ঐ কর্মচারীকে বাধ্য করেন হালিমাকে তাঁর সঙ্গে বিয়ে দিতে। ওমরের জীবনীকারের ভাষ্যে, এতে খৈয়াম যে আঘাত পান সে আঘাত তিনি সামলে উঠতে পারেন নি। তাই বাকি জীবনে আর কোনো নারীর পাণিগ্রহণ থেকে তিনি বিরত থেকেছেন। অবশ্য প্রেমিকাকে জীবনে না পেয়েও তাঁর প্রেম নিঃশেষ হয়ে যায় নি; বরং সেই প্রেমিকার রূপ ধরে হাজারো প্রেমানুভূতি ও আস্বাদনে উজ্জীবিত হয়েছে।
নিজাম-উল-মুলক পূর্ব-প্রতিজ্ঞা অনুযায়ী ওমরকে সাহায্য করতে চাইলে তিনি রাজদরবারে কোনো উচ্চপদ নয়, বরং নিভৃতে বসে কাব্য-আরাধনায় দিনয়াপন করতে চান। নিজাম-উল-মুলক তাঁকে সরকারি ভাতার ব্যবস্হা করে দেন। ফলে ওমর খৈয়াম নিশাপুরে বসেই খোরাসানের রাজসরকার হতে বার্ষিক ১২০০ মিশকাল (স্বর্ণমুদ্রা) বৃত্তি পেতেন। তাতেই কোনোমতে ওমর খৈয়ামের জীবনযাত্রা নির্বাহ হতো।
কিন্তু ওমর খৈয়াম সবসময় নিভৃতে বসে কাব্য চর্চায় নিয়োজিত হবার অবকাশ লাভ করেন নি। কেননা তাঁকে অনেক সময় গুরুদায়িত্বও পালন করতে হয়েছে। তাছাড়া কাব্যচর্চার চাইতে বিজ্ঞান ও জ্যোতির্বিদ্যার প্রতি তাঁর অধিকতর প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। জ্যোতির্বিজ্ঞানে তাঁর অসাধারণ বুৎপত্তি ছিল এবং নির্জনে বসে গ্রহ-নক্ষত্রের গতিবিধি লক্ষ্য ও পর্যালোচনা করা তাঁর অভ্যেস ছিল।
জ্যোতির্বিজ্ঞানে ওমর খৈয়ামের পাণ্ডিত্যের খবর অবগত হয়ে সেলজুক সুলতান মালিক শাহ তাঁর প্রতিষ্ঠিত রাজকীয় জ্যোতির্বিজ্ঞান গবেষণাগার পরিচালনার দায়িত্ব ওমরের ওপর ন্যস্ত করেন।
সুলতানের ইচ্ছানুযায়ী তিনি সাতজন পণ্ডিত সহযোগে প্রচলিত গণনা পদ্ধতির যাবতীয় ভ্রম সংশোধন করে চান্দ্রমাসের পরিবর্তে সৌরমাস অনুযায়ী গণনার একটি নতুন পঞ্জিকা তৈরি করেন। সুলতান মালিক শাহ জালাল-উদ-দৌলার নামানুসারে এর নামকরণ করা হয় ‘জালালী পঞ্জিকা’। ঐতিহাসিক গীবন বলেন, ইহা জুলিয়ানের পঞ্জিকা অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ এবং গ্রেগরির পঞ্জিকার নির্ভুলতার সমকক্ষতা দাবি করে।
গণিতশাস্ত্রে ওমর খৈয়ামের অসামান্য দখল ছিল। পাটিগণিত, বীজগণিত ও জ্যামিতি – গণিতশাস্ত্রের তিনটি শাখাতেই তিনি সমপারদর্শী ছিলেন। বীজগণিতের ওপর রচিত তাঁর গ্রন্থের নাম ‘মাকালাতু ফি’ল জবরি ওয়াল মুকাবিলা’। আরবি ভাষায় রচিত এ গ্রন্থটি ছিল বর্গমূল ও ঘনমূল নিষ্কাশনের ভারতীয় পদ্ধতি এবং ত্রিকোণমিতির সাহায্যে বীজগণিতের সমীকরণ সমাধান পদ্ধতি।
১৮৫১ সালে এ গ্রন্থটি বিখ্যাত অনুবাদক উপেক (Weopeke) কর্তৃক ইংরেজি ভাষায় অনূদিত ও প্রকাশিত হয় এবং ইউরোপে বিপুলভাবে সাড়া জাগায়। পরবর্তীতে ১৯১৮ সালে ভন হামারের প্রয়াসে গ্রন্হটি জার্মান ভাষায় অনূদিত হয়। ১৯৩১ সালে পুস্তকটি প্রথমবারের মতো আমেরিকায় ছাত্রদের জন্য গৃহীত হয়ে আবশ্যিকভাবে পড়ানো শুরু হয়।
ওমর খৈয়ামের গণিত-সম্বন্ধীয় মূল পুস্তকের নাম ‘মুশকিলাতুল হিসাব’। এটি গাণিতিক কতিপয় জটিল সমস্যা-সংক্রান্ত অনুশীলনী গ্রন্থ। গ্রন্হটি হল্যান্ডের লাইডেন, প্যারিস ও লন্ডনের ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিতে রক্ষিত আছে।
ওমর খৈয়াম রচিত জ্যামিতি গ্রন্থটির নাম ‘মূসাদিরাতু কিতাব-ই-উকলিদাস’। ইউক্লিডের জ্যামিতি সম্বন্ধে বহু মৌলিক ও উচ্চাঙ্গের আলোচনা আছে এতে। এ পুস্তকটির হস্তলিপি এখনও হল্যান্ডের লাইডেন গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত আছে। ওমর খৈয়ামের বিজ্ঞানবিষয়ক গ্রন্হগুলো মূলত আরবি ভাষায় রচিত।
ওমর খৈয়াম ছিলেন একজন বিজ্ঞানী। রসায়ন, পদার্থবিদ্যা ও ভূগোল বিষয়েও তিনি গবেষণা ও গ্রন্থ প্রণয়ন করেন। আলকেমী বা ধাতব পদার্থের রাসায়নিক বিশ্লেষণ ও মিশ্রণের হার-সংক্রান্ত বিষয়েও তিনি একটি পুস্তক রচনা করেন। কিন্তু পুস্তকটির নাম জানা যায় নি। এ পুস্তকটিতে ভেষজ বিজ্ঞানও স্হান পেয়েছে।
এছাড়া ভূগোল বিষয়ে তিনি ঋতু পরিবর্তনের নৈসর্গিক কারণ-সংক্রান্ত একটি পুস্তক রচনা করেন। পুস্তকটির নাম ‘লাওয়াযিমু আমকিনা’। ওমর খৈয়াম একজন বিখ্যাত দার্শনিকও ছিলেন। গ্রিক দর্শনে তাঁর অগাধ পাণ্ডিত্য ছিল। ত্রয়োদশ শতকে ‘দার্শনিকদের ইতিহাস’ গ্রন্থের লেখক আল-কুফতি ওমর খৈয়ামকে গ্রিক দর্শনে পণ্ডিত ও বিশেষজ্ঞ বলে অভিহিত করেন।
ইমাম জহীরউদ্দিন বায়হাকীর বিবরণীতে উল্লেখ আছে, খ্যাতনামা দার্শনিক ইবনে সিনার গ্রন্থগুলো তিনি মনোযোগের সাথে পাঠ করতেন। দর্শনে তাঁর জ্ঞান প্রায় ইবনে সিনার সমকক্ষ ছিল। সৃষ্টি ও মানুষের নৈতিক দায়িত্বের ওপর লেখা তাঁর বিখ্যাত বইয়ের নাম ‘কউন ওয়া তকলীফ’।
এছাড়া বাস্তব জগতের অস্তিত্ব ও স্বরূপের ওপর তিনি দুই খণ্ডের মূল্যবান যে গ্রন্হটি রচনা করেন তার নাম ‘আর-রিসাতুল উলা ফি’ল ওজুদ’। দর্শনবিষয়ক গ্রন্থগুলো তিনি আরবি ও ফারসি উভয় ভাষাতেই রচনা করেন। এছাড়া ইবনে সিনার দর্শন সম্বন্ধীয় গ্রন্থ তিনি ফারসিতে অনুবাদ করেন।
চিকিৎসাশাস্ত্রেও ওমর খৈয়াম সুপণ্ডিত ছিলেন। অথচ এ বিষয়ে তিনি কোনো গ্রন্থ রচনা করেন নি। এজন্য ইমাম বায়হাকী তাঁকে গ্রন্হ প্রণয়ন ব্যাপারে কৃপণ ছিলেন বলে আখ্যায়িত করেছেন। তবে সম্প্রতি তেহরান থেকে প্রকাশিত ও আবিষ্কৃত ওমর খৈয়ামের ‘তবিয়তনামা’ আলোচনা করতে গিয়ে মুস্তাফা মিনোভি হেকিম-ওমর খৈয়াম বিষয়ে চমকপ্রদ কিছু তথ্যের সঙ্গে দু-একটি কেস-হিস্ট্রি উল্লেখ করেন।
অবশ্য ১৩২০ সালে বদরে জাজরোমি কর্তৃক লিখিত ‘মোয়ান্নেসুল আহরার’ গ্রন্থেও এ প্রসঙ্গে উল্লেখ আছে। ওমর খৈয়ামের চিকিৎসা পদ্ধতি ছিল তৎকালিন সর্বাধুনিক ইউনানি বা হেকিমি পদ্ধতি। এটা তিনি রপ্ত করেছিলেন তাঁর মন্ত্রগুরু ইবনে সিনার চিকিৎসা-বিষয়ক গ্রন্হাদি অধ্যয়ন করে। বলাবাহুল্য ইবনে সিনা ও তাঁর অনুসারীরা ইউনানি চিকিৎসা আদর্শকে শ্রদ্ধার সঙ্গে গ্রহণ করেন এবং রক্ষা করেন।
ধর্ম সম্বন্ধে ওমর খৈয়াম স্বাধীন মত ব্যক্ত করতেন। তবে জীবনের প্রান্তে এসে তাঁর মনোভাব ও দৃষ্টিভঙ্গীর যথেষ্ট পরিবর্তন ঘটে। মৃত্যুর অনতিপূর্বে তিনি ইবনে সিনার ‘আরোগ্য তত্ত্বের’, ‘এক ও বহু’ শীর্ষক অধ্যায়টি পাঠ করতে করতে তন্ময় হয়ে প্রার্থনা করেন, ‘হে খোদা! আমি আমার সীমিত বোধশক্তির সাহায্যে তোমাকে বুঝতে চেষ্টা করেছি।
সুতরাং আমার অক্ষমতা ক্ষমা করো। কেননা, আমার যতটুকু জ্ঞান তোমাকে বুঝবার জন্য তাই আমার একমাত্র সম্বল, এছাড়া অন্য কোনো পন্হা আমার ছিল না। শেষ জীবনে তাঁর মধ্যে আধ্যত্মবোধের পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটে। পৃথিবীর যে একজন স্রষ্টা আছেন এবং তিনি দয়ালু, একথা তিনি কোনো কোনো রুবাইয়াতে বলেছেন। বিশ্বস্রষ্টাকে তিনি অন্তরে উপলব্ধি এবং তাঁর কাছে একান্তভাবে আত্ম-নিবেদন করেছেন। যেমন –
এই শক্তি, এই প্রাণ,
এ সকলই তব দান,
মোর সত্তা, আত্মা, মন,
এ তো প্রভু তব ধন।
আমার এ দেহখানি
তোমারি হে নাথ, জানি;
একান্ত তোমারি আমি,
তুমিও আমারই স্বামী;
কেহ যদি তুমি ছাড়া,
তোমাতেই আমি হারা।
ওমর খৈয়াম জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় শ্রেষ্ঠ পণ্ডিত হলেও কাব্য রচনার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন বেজায় বেখেয়াল। তাই রুবাই বা চার লাইনের কবিতা রচনা করা তাঁর পক্ষে তেমন অভিপ্রেত ছিল না। নিতান্ত খেয়ালের বসে অথবা আত্মবিস্মৃত হয়ে তিনি রুবাই রচনা করেছেন।
এছাড়া হেকিমিবিদ্যায় পারদর্শিতার কারণে নানাজন নানা মানত নিয়ে তাঁর কাছে আসতো। দাওয়া বা পথ্য হিসেবে তিনি তাদের হাতের তালুতে বা গাছের পাতায় চার লাইনের কবিতা ব্যবস্হাপত্র হিসেবে লিখে দিতেন। কাজেই কোনো ফরমায়েশী তাগিদে বা মোসাহেবিতে আক্রান্ত হয়ে তিনি রুবাই রচনা করেন নি।
রুবাই – এর প্রকৃত উচ্চারণ রুবাঈ, বহুবচনে রুবাইয়াত। এর ফারসি প্রতিশব্দ ‘তারানে’- যার অর্থ চার পঙতি বা চার লাইনের কবিতা। ইংরেজিতে রুবাই – এর অর্থ quatrain বা চতুষ্পদী শ্লোক। রুবাই-এর সাধারণ নিয়ম হলো- প্রথম লাইনের সঙ্গে দ্বিতীয় ও চতুর্থ লাইনের মিল, তৃতীয় লাইনে ছাড়। তবে তৃতীয় লাইনের সঙ্গে মিল থাকা অগ্রাহ্য নয়।
এর মানে হলো তৃতীয় লাইনকে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে। তবে সমালোচকদের ভাষায়, তৃতীয় লাইন টপকে চতুর্থ লাইনে গিয়ে ছন্দের উদ্ধত ছুরিকা যেন বুকের গভীরে প্রবেশ করতে পারে, তাই এ স্বাধীনতা। উদাহরণস্বরূপ ওমর খৈয়ামের একটি বিখ্যাত রুবাই- এর বাংলা অনুবাদ উল্লেখ করা যেতে পারে –
এক বোতল চুনিলাল মদ আর একটি কবিতার বই
জীবন বাঁচাতে চাই আর একটু রুটি-সঙ্গে তুমি সই;
যদি কোনো ছায়াচ্ছন্ন বিরান মাঠের কোণে বসে
এমন বেহেশত্ কারো ভাগ্যে জোটে না নিশ্চয়ই।
রুবাই নাম আরবি হলেও পারসিকরাই প্রথম এ ঢঙের কবিতা উদ্ভাবন ও আস্বাদন করে। পরে অবশ্য আরবরাও তা রপ্ত করে। রুবাই হলো খুব সংযত কাব্য সৃষ্টি। কম শব্দ খরচ করে বেশি কথার স্হান সংকুলান করাই হচ্ছে রুবাই রচনার উদ্দেশ্য।
ওমর খৈয়ামের রুবাইয়াতের কাব্যমূল্য কম নয়; অনেকে একে গীতিসংহিতা বলে আখ্যায়িত করেছেন। তাঁর কাব্যরূপের বিচিত্র ব্যবহার এবং বাকমূর্তি অসাধারণ শিল্পরুচিসম্পন্ন ব্যঞ্জনা বলে আমাদের মুগ্ধ করে। উদাহরণস্বরূপ একটি রুবাইয়ের উল্লেখ করা যেতে পারে –
পিয়ে নাও সুরা এই বেলা সখা,
ঘুমাবার দিন অনেক পাবে।
মৃত্তিকার নীচে, দরদী বান্ধব
প্রেয়সী যেথায় কেহ না যাবে।
বলো না কাহারে, বলো না কো
এই অতীব গোপন সত্য সার –
যে ফুল নেশায় পড়েছে ঝরিয়া
সে নাহি কখন ফুটিবে আর।
ওমর খৈয়ামের রুবাইয়াতের লক্ষ্য হচ্ছে ক্ষণস্হায়ী জীবনকে শান্তি ও মাধুর্যমণ্ডিত করে তোলা এবং এর সার্থকতার সন্ধান করা। ফলে তাঁর রুবাইয়াতে মানব জীবন সম্পর্কে সুগভীর দৃষ্টিভঙ্গী পরিস্ফুট হয়ে উঠেছে। জ্যোতির্বিজ্ঞানী ওমরকে জীবনের মূলগত সসমস্যাই পীড়িত করেছে এবং তিনি জীবনের একটা অর্থ ও তাৎপর্য নির্ণয় করতে চেয়েছেন। যেমন –
কোথায় ছিলাম, কেনই আসা –
এই কথাটা জানতে চাই,
জন্মকালে ইচ্ছাটা মোর
কেউ তো তেমন শুধায় নাই।
যাত্রা পুনঃ কোন্ লোকেতে?
প্রশ্নটা তোর মাথায় থাক –
ভগ্যদেবীর ক্রুর পরিহাস
পেয়ালা ভ’রে ভোলাই যাক্।
– অনুবাদ: কান্তি ঘোষ
ওমর খৈয়ামের রুবাইয়াতে গোঁড়া ও বকধার্মিকদের প্রতি প্রচণ্ড ঘৃণা প্রকাশ পেয়েছে। শুধু তাই নয়, রাজতন্ত্রের প্রতাপের মধ্যেও সুলতানের প্রশস্তি তাঁর রুবাইয়াতে স্থান পায় নি। দার্শনিক এবং পণ্ডিতদের বিরুদ্ধেও তিনি রুবাই রচনা করেছেন। সেখানে জ্যোতির্বিদ ওমরকেও তিনি বাদ দেন নি। যেমন –
অস্তি-নাস্তি শেষ করেছি, দার্শনিকের গভীর জ্ঞান
বীজগণিতের সূত্র-রেখা যৌবনে মোর ছিলই ধ্যান;
বিদ্যারসে যতই ডুবি, মনটা জানে মনে স্থির –
দ্রাক্ষারসের জ্ঞানটা ছাড়া রসজ্ঞানে নই গভীর।
ওমর খৈয়ামের মৃত্যু সাল নিয়েও পণ্ডিতদের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। তবে অধিকাংশ পণ্ডিতের মতে খ্রিস্টীয় ১১২৩ সালে ওমর খৈয়ামের বিদ্রোহী কণ্ঠ চিরদিনের জন্য নীরবতা লাভ করেছে। কিন্তু তাঁর বাণী মূর্তিমতী হয়ে আজ সমগ্র পৃথিবীতে বিচরণ করছে। যে উহা শুনেছে, সে মুগ্ধ হয়েছে।
বিখ্যাত ইংরেজ কবি ও অনুবাদক এডওয়ার্ড ফিটজেরাল্ড ১৮৫৯ সালে সর্বপ্রথম ওমর খৈয়ামের রুবাইয়াতের অনুবাদ করেন। তিনি প্রথমে ৭৫ টি এবং পরে ১০১ টি রুবাইয়াতের অনুবাদ প্রকাশ করেন। অন্যান্য ইংরেজ, জার্মান, ফরাসি, রুশ অনুবাদকরাও ফিটজেরাল্ডকে অনুসরণ করেন। অন্যদের মধ্যে নরওয়ের পণ্ডিত ক্রিস্টেনসন, রুশ পণ্ডিত শুকোভস্তির খৈয়াম-গবেষণাও জগৎখ্যাত।
এছাড়া অন্য যাঁরা এ যাবত অনুবাদের জন্য বিশ্বজোড়া খ্যাতি পেয়েছেন তাঁদের মধ্যে ই. এইচ. উইন ফিল্ড, এলেন ফ্রান্সিস থম্পসন এবং যুগ্মভাবে জন হিথ-স্টারস ও পিটার এভারির নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বাংলা ভাষায় যাঁরা ওমর খৈয়ামের রুবাইয়াতের অনুবাদের ওপর কাজ করেছেন তাঁদের মধ্যে কান্তি চন্দ্র ঘোষ, নরেন্দ্র দেব, কাজী নজরুল ইসলাম, শক্তি চট্টোপাধ্যায় প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য।
পরবর্তীকালে ইউরোপের প্রায় সকল ভাষায় রুবাইয়াতের অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে এবং যখন যে ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে অতি অল্প দিনের মধ্যেই লাখ লাখ সংখ্যা বিক্রয় হয়েছে। উল্লেখ্য, একবার ইংল্যান্ডে একখণ্ড রুবাইয়াত দেড় হাজার পাউন্ডে বিক্রয় হয়েছিল। একসময় ওমর খৈয়ামের গ্রন্থপাঠের জন্য ইউরোপে একটা মাদকতা এসেছিল। এর দুটি কারণ থাকতে পারে।
প্রথমত, এর ছন্দের লালিত্য ও শব্দবিন্যাসের মাধুর্য যা সকলেরই চিত্তাকর্ষণ করে। দ্বিতীয়ত, বিষয়টি সকলেরই প্রাণের জিনিস, আর তেমনি প্রাণের ভাষায় উহা গ্রথিত। এছাড়া ওমর খৈয়ামের রুবাইয়াতে আছে মানুষের পরিণাম, স্বর্গ-নরক, সৃষ্টির উদ্দেশ্য, ন্যায়ের পুরস্কার, অন্যায়ের প্রায়শ্চিত্ত- যা যুগ যুগ ধরে মানুষের চিন্তাকে বিব্রত, হৃদয়কে আলোড়িত করেছে।
সে কারণে হয়তো এ কাব্য-সংগীতের সম্রাট দুনিয়ার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি হিসেবে গ্যেটে, রবীন্দ্রনাথ প্রমুখের সঙ্গে তুলনায় এসেছেন এবং তাঁর বাণী আজ দেশকাল-জাতিভেদের ঊর্ধ্বে উঠে বিশ্বমানবের বুকে ঠাঁই পেয়েছে। একজন তাঁবু নির্মাতার পুত্র এমন দর্শনের তাঁবু দুনিয়াতে নির্মাণ করে গেছেন, যাতে প্রবেশ করা মাত্র নর্তকীর নৃত্য, কবির কণ্ঠ আর দর্শনের সূক্ষ্মদান যে কোনো মনের জন্য স্নিগ্ধ শান্তি ও মুক্তচিন্তার যথার্থ আশ্রয়স্থল হয়েছে।
Discover more from অভিযাত্রী
Subscribe to get the latest posts sent to your email.