বাংলাদেশের সড়ক দুর্ঘটনা: মৃত্যুর মিছিল থামানোর উপায়
সড়ক দুর্ঘটনা রোধে কার্যকরী পদক্ষেপ ও সচেতনতার প্রয়োজনীয়তা
প্রথম প্রকাশ: ১৩ জুন, ২০২৩
বাংলাদেশের প্রতিটি সড়ক হলো মৃত্যুর ফাঁদ। সংবাদপত্র খুললেই দেখা যায় দেশের কোনো না কোনো জায়গার সড়ক রক্তাক্ত হয়েছে। কেউ তার বাবা, মা, ভাই অথবা বোনকে হারিয়েছে। এই পথে হারানোর যেনো কোনো বিচার বা প্রতিকার নেই। প্রতিনিয়ত এমন ঘটনা ঘটে যাচ্ছে আমাদের সামনে কিন্তু কেউ কিছু করতে পারছে না।
সড়ক নিরাপত্তার জন্য আন্দোলন
সর্বশেষ দেশের জনপ্রিয় অভিনেতা ইলিয়াস কাঞ্চন তার স্ত্রীকে হারানোর পর থেকে সড়কের নিরাপত্তার বিষয়ে কথা বলে আসছেন কিন্তু সেভাবে শুরুর দিকে কেউ গুরুত্ব দেয়নি। তবে দেশের গুণীজন তারেক মাসুদ ও মিশুক মনির সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাওয়ার পর আরো শক্তিশালী হয় এই আন্দোলন। তবুও দেশের সড়কে মৃত্যুর মিছিল থামেনি।
শিক্ষার্থীদের আন্দোলন
সর্বশেষ রাজধানীতে শিক্ষার্থী মৃত্যুর ঘটনায় দেশজুড়ে শুরু হয় আন্দোলন। পুরো ট্রাফিক সিস্টেম পরিবর্তন করে সাধারণ শিক্ষার্থীরা। তারা বিভিন্ন পরামর্শ দেয় সড়কের নিরাপত্তার জন্য কিন্তু শুরুতে তাদের কথার গুরুত্ব দিলেও পরবর্তীতে আবার আগের অবস্থায় ফিরে আসে আমাদের সড়কের সিস্টেম। আসলে এই সড়কে মৃত্যুর মিছিল কীভাবে বন্ধ করা যায় সেটি নিয়ে আজকের আলোচনা।
সড়কে মৃত্যুর কারণ
সড়ক দুর্ঘটনার ঘটনা ঘটে সবচেয়ে বেশি আঞ্চলিক ও মহাসড়কে। যাত্রীবাহী বাসের চেয়ে ট্রাক ও পণ্যবাহী গাড়ি বেশি দুর্ঘটনার শিকার। এছাড়া মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার হারও ইদানিং বৃদ্ধি পেয়েছে। বিগত বছরে বাস দুর্ঘটনা ঘটেছে ৯৬৫টি, ট্রাক-কভার্ড ভ্যানে দুর্ঘটনা ঘটেছে ১ হাজার ৩১৫টি। আর মোটর সাইকেল দুর্ঘটনা ঘটেছে ৯৬১টি।
অতিরিক্ত গতি
অতিরিক্ত গতির ফলে দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনার শিকার হয়। দেশের রাস্তার সাধারণ গতিসীমা হলো ৪০ কিলোমিটার প্রতি ঘন্টায়। কিন্তু বেশির ভাগ গাড়ি এই গতির চেয়ে দ্বিগুণ গতিতে গাড়ি চালায়। এতে প্রতিনিয়ত নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বা গতির কারণে অন্য গাড়ির সঙ্গে সংঘর্ষ বেধে যায়।
চালকের চেয়ে গাড়ি বেশি
বাংলাদেশের আরেকটা সংকটের জায়গা হলো গাড়ি ও চালকের অনুপাত অসমান। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে নিবন্ধিত গাড়ির সংখ্যা ৪৫ লাখ ২৩ হাজার ৬০০টি। তার মধ্যে বাসের সংখ্যা ৫১ হাজার ৬৬৮টি। এসব গাড়ির বিপরীতে চালকের লাইসেন্স প্রায় ২৪ লাখ। এতে দেখা যাচ্ছে বিশাল সংখ্যক অদক্ষ চালকরাও গাড়ি চালায় রাস্তায়।
সড়কের অবস্থা
সড়কের মৃত্যুর মিছিল কমাতে ২০১৫ সালে জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিলের এক বৈঠকে মহাসড়কে সর্বোচ্চ গতি ৮০ কিলোমিটার করা হয়। অটোরিকশা চলাচল নিষিদ্ধের সুপারিশ করা হলেও এসব কিছু বাস্তবায়নের জন্য সেভাবে কার্যক্রম চোখে পড়েনি। এছাড়া অধিকাংশ রাস্তায় সংকেত নেই। এটির কারণে অনেক দুর্ঘটনা ঘটে কিন্তু এটি মেরামতের কোনো উদ্যোগ নেই।
গত কয়েক বছরের মৃত্যুর হিসেব
বছর | সড়ক দুর্ঘটনা | নিহত |
---|---|---|
২০১৬ | ২,৫৬৬ | ২,৪৬৩ |
২০১৭ | ২,৫১৩ | ২,৫১৩ |
২০১৮ | ২,৬৩৫ | ২,৬৩৫ |
২০২০ | ৩,৯১৮ | ৩,৯১৮ |
২০২২ | ৫,০০০ | ৫,০০০ |
সড়ক দুর্ঘটনা রোধে করণীয়
সড়কে হয়তো মৃত্যুর কোটা শূন্য করা সম্ভব নয়। তবে এই মৃত্যুর মিছিল অনেক বেশি কমিয়ে নিয়ে আসা সম্ভব। সেটির জন্য কিছু কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ প্রয়োজন।
১. সবার আগে জরুরি হলো বিআরটিএ অফিসের সব ধরনের দুর্নীতি প্রতিরোধ ও লাইসেন্স গ্রহণের পথ সহজ করা। ২. চালকদের নানা ধরনের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। ৩. সড়কের শতভাগ সংকেত দেওয়া। ৪. সড়কে কোনো ধরনের ফিটনেসবিহীন গাড়ি চলাচল করতে পারবে না বলে আইন করা। ৫. ট্রাফিক আইনগুলো কার্যকর করা। ট্রাফিক আইনের ব্যাপারে ক্যাম্পেইন করা। ৬. সড়কে আরো বেশি পুলিশ ও নিরাপত্তাকর্মী নিয়োগ দেওয়া। ৭. মহাসড়কে প্রতি ১০০ কিলোমিটার পর পর স্পিড ও চালকের ফিটনেস চেকার থাকা প্রয়োজন। ৮. সাধারণ মানুষ ও চালকদের নিয়ে সড়কের সাবধানতার বিষয়ে ক্যাম্পেইন, কর্মসূচি, প্রোগ্রাম করা।
উপসংহার
সড়ক দুর্ঘটনা রোধে শুধু আইন নয়, আমাদের সকলের আরো বেশি সচেতন হওয়া প্রয়োজন। সকলের সচেতনতা আমাদের সড়কের মৃত্যুর মিছিল অনেকাংশে কমিয়ে নিয়ে আসতে পারবে। এছাড়া পরিবার থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের কর্তা ব্যক্তিদেরও ট্রাফিক আইনের ব্যাপারে অনেক বেশি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। সকলের আন্তরিক প্রচেষ্টায় আমরা খুব অল্প সময়েই সড়কগুলো অনেক বেশি নিরাপদ করা সম্ভব। এতে আমাদের সবার চলাচল আরো বেশি নিরাপদ ও স্বাস্থ্যকর হবে। আমাদের সকলের চেষ্টায় সেই দিন অতি দ্রুত আসুক।
Discover more from অভিযাত্রী
Subscribe to get the latest posts sent to your email.