দ্য প্রমিজড নেভারল্যান্ড: জাপানীজ অ্যানিমেশনের নতুন মাইলফলক
একটি এতিমখানার ভয়ংকর রহস্য ও বাচ্চাদের মুক্তির সংগ্রাম
Disney এর বাইরে যদি কোনো ইন্ড্রাস্ট্রি ভাল মানের অ্যানিমেটেড সিরিজ উপহার দিতে পারে সেটা হলো জাপানীজ অ্যানিমেশন ইন্ড্রাস্ট্রি। ডিজনি কে তাক লাগিয়ে দেবার মত ইতোমধ্যেই তারা ভয়ংকর সুন্দর সুন্দর অ্যানিমেশন ফিল্ম উপহার দিয়েছেন। হাতিয়ে নিয়েছেন অস্কার পর্যন্ত। একই কথা যায়, অ্যানিমেশন সিরিজ সৃষ্টিতে। দ্য প্রমিজড নেভারল্যান্ড (The Promised Neverland) সদ্য মুক্তি পাওয়া এই সিরিজটির সর্বশেষ পর্ব (১২তম) দেখে আমি একরকম তব্দা খেয়ে গেছি। সিরিজটি ২০১৬ থেকে ২০২০ পর্যন্ত টানা হয়েছে।
সিরিজটির প্রথমে দেখানো হয়েছে একটি কাল্পনিক ও ডিসিপ্লিনড্ এতিমখানা। সেখানে ৩৭ জন বাচ্চা থাকে। শুধু তাই নয়, এদের দেখভালের জন্য রাখা হয়েছে একজন পরম মিষ্টি এক সুন্দরী ‘ম্যাম’ কে। যিনি তার আচরণ দিয়েই সবাইকে মুগ্ধ করে রাখতে পারেন।
বাচ্চাদের জন্য এখানে প্রয়োজনীয় ভালো মানের খাবার, সুন্দর খেলাধূলার পরিবেশ, ভালো মানের শিক্ষা, ভালো মানের সবুজ পরিবার, সবার জন্য আলাদা বিছানা রাখা হয়েছে। কিন্তু এটা ভেবে আপনি প্রথমেই ধাক্কা খেতে পারেন যে, এই এতিমখানা প্রকৃত পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন কেন?
নরম্যান ও এমার কেমিস্ট্রি মন ছুঁয়ে গেছে আমার। তাদের আরো একজন বন্ধু আছে, ওর নাম ‘রে’। একটু গভীর পর্যবেক্ষণ করে দেখলে বুঝবেন, আমাদের দেশেও যেসব এতিমখানা আছে তাদের কিন্তু একটা মোটিভ আছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এই এতিমখানার তাহলে মোটিভ কী? এত এত টাকা কে ঢালছেন?
গ্রেস ফিল্ড হাউজ – নামক আদর্শবান এই এতিমখানায় ঠিক সেরকমই একটি ভয়ংকর মোটিভ আছে। মিশনারী কর্মকান্ড কে এখানে দেখানো হয়েছে এক প্রকার ডেমন আকারে। আরো ভালো করে মানে গভীর পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, এই ডেমনগুলো বাচ্চাদের মগজ খায়, শরীর নয়।
লেখক এখানেই তার কারিশমা দেখিয়েছেন এবং বাস্তব পৃথিবীর সাথে সম্পর্কিত করেছেন। সিরিজটির প্রথম দিকে দেখা যায়, বাচ্চাদের হাতে উন্নত মানের ডিভাইস আছে পরীক্ষা দেবার জন্য। এবং বিশাল লাইব্রেরি, যার সমস্ত বই প্রেসক্রাইবড্ করা।
মানে বাচ্চারা ভালো করে তাদের মস্তিষ্ক উর্বর করবে এবং ডেমনরা তাদের মগজ খেয়ে আরো বুদ্ধিমান হতে থাকবে। তাহলে ধরে নেওয়া যায়, এই সব ডেমনদের খাবার হচ্ছে বুদ্ধিদীপ্ত মগজ। হোয়াট! বলে অনুগ্রহ করে চিৎকার করবেন না।
যদি আমাদের এতিমখানার দিকে তাকাই তাহলে সেখানে রাজনীতিবিদ গণ বড় অঙ্কের টাকা ঢেলে বাচ্চাদের মাথা ধোলাই করছেন। দুই একটা ব্যতীত প্রায় সব এতিমখানা-ই এরকম। মনে হয় এই দর্শন বুঝানো গেলো।
কিন্তু লেখক এটা লিখেই শুধু সন্তুষ্ট হোননি! তিনি চেয়েছেন মুক্ত পৃথিবীতে এসে এই সব বাচ্চাদের নতুন করে স্বপ্ন দেখা উচিত। যদিও মুক্ত পৃথিবীতে সমস্যার অভাব নেই। সবাইকেই একদিন না একদিন মরতে হবে। তাই বলে প্রি-কনসিভড মৃত্যুর তারিখ নিয়ে জীবনে অনেক কিছু তো বাদই দিলাম কিছুই করা যায় না।
গিভ-আপ করার জন্য এখানে আর কোনো উপায় নেই। এই এতিমখানার চারপাশে শক্ত উঁচু দেয়াল দেওয়া। সুতরাং চাইলেও সেটা টপকানো সহজ ন নরম্যান এবং এমা সত্য জেনে যাবার পর এখান থেকে মুক্ত হবার জন্য তাদের সংগ্রাম শুরু করে। যেটা অনেকটা ডিটেনশন ক্যাম্পের ধারণা দেয়।
একই সাথে ডিস্টোপিয়ান ওয়ার্ল্ড টেকনোলজির সংকেত দেওয়া হয়েছে এই সিরিজে। অর্থ্যাৎ সবার কানের নিচে একটা ডিভাইস লুকানো আছে। কী কাজ এটার? এটার কাজ হলো, কে? কখন? কোথায় যাচ্ছে? সেসব লক্ষ্য রাখা।
সবার গতিপথ ট্র্যাকিং করার জন্য এই ডিভাইসে চোখ বুলিয়ে যাচ্ছেন সবার প্রিয় ‘ম্যাম’। কিন্তু ম্যামের জীবন গল্পেও ডারউইনের মতবাদ, Survival for the fittest – খুব সুক্ষ্মভাবে মেনে চলা হয়েছে। তাই তিনি আজ ম্যাম হতে পেরেছেন।
কিন্তু একসময় তার জীবনও ছিলো সবুজ। একজন বন্ধুও ছিলো, গিটারে গান শোনাতো। কিন্তু যখন সেই বন্ধুটিও ডেমনদের হাতে চলে যায় তখন থেকে ম্যাম একা থাকা শিখে যায়।
আমাদের পারিবারিক ও সামাজিক পাশাপাশি রাজনৈতিক যত বাধা বিপত্তি আসে এই এতিমখানায় সেটাও দেখানো হয়েছে। নরম্যান খুব বুদ্ধিমান ছেলে এবং বেশ শক্ত। কিন্তু যখন সে ঐ উঁচু দেয়াল টপকাতে গেলো তখন দেখলো, উঁচু দেয়াল টপকানোই শেষ কথা নয়, এরপরে আরো একটি বিশাল গর্ত আছে তাই গার্ডের প্রয়োজন নেই।
আর এই ফাঁদ আমাদের ব্যক্তি জীবনের সাথে কতই-না মিলে যাচ্ছে! তাই নয় কি? আপেক্ষিক ভাবে কম বুদ্ধি/শক্তি/ক্ষমতা সম্পন্ন মানুষের যেমন আমাদের সমাজে বেশি দূর্ভোগ পোহাতে হয় ঠিক তেমনি এই এতিমখানার বাচ্চাদের একই রকম দূর্ভোগে পড়ে যায়।
হ্যাঁ, সিরিজের এক পর্যায়ে ডেমনদের হাতে মরতে হয় নরম্যান কে। একই সাথে এই এতিমখানায় কিছু বাচ্চাদের স্পাই হিসেবে রাখা হয়েছে। এই মুনাফিকরা কার কি পরিকল্পনা সব বলে দেয় ম্যাম কে। আমাদের সমাজেও এমন বাচ্চা আছেন যারা কথায় কথায় ম্যাম… ম্যাম… করেন।
কিন্তু প্রত্যেকটি চরিত্র গিভ-আপ করার মতন নয়। মানসিকভাবে এরা অনেক শক্তিশালী। এমার চোখের জল দর্শকদের কাঁদাতে পারে, নরম্যানের জীবন বলিও বাচ্চাদের চিন্তার মতন মনে হয়নি।
এমা এবং রে সর্বশেষে এই এতিমখানা থেকে পালাতে পারে কিনা সেটা জানার জন্য বা অন্তত শেষটা অবধি কি হয়! তা হলেও আপনাকে সিরিজটি দেখতে হবে। যদিওবা আমার স্বাস্থ্যের জন্য এই ধরণের সিরিজ বেশ ক্ষতিকর কারণ শেষ অবধি না দেখা পর্যন্ত উঠতে পারি না।
আজ এই পর্যন্তই, ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন। ধন্যবাদ