সম্পাদকীয়

জীবনের বাস্তবতা ও সম্পর্কের গল্প: একাকীত্ব থেকে সফলতার পথে

বড়দের থেকে শেখা জীবনের মূল্যবান পাঠ এবং সমাজের বাস্তবতা নিয়ে কিছু কথা

ছোট থেকেই কিছু কিছু বিষয় বড়দের থেকে শিখেছি, জেনেছি। আমার জীবনের এক দীর্ঘ সময় বন্ধুহীন ছিলাম না; ছিলাম ঐ বড়দের সাথে। একসাথে ওঁদের সাথে নামাজ পড়তাম, চা খেতাম, গল্প করতাম আর তাঁদের জীবন অভিজ্ঞতা নিয়ে অজস্র প্রশ্ন করতাম। যদিও এরমধ্যে আমার নিজের ‘নানা’ এবং এক ‘দাদু’ এখন কবরে শুয়ে আছেন। ওপারে এঁরা কেমন আছেন তা অবশ্য জানিনা। কিন্তু এই মানুষগুলো আমাকে খুব ভালোবাসতেন।

এখনো গ্রামের রাস্তা দিয়ে হাঁটলে বয়োবৃদ্ধ কোনো দাদু ঘুরেফিরে আমার দিকে তাকান, একটু কাছে যেতেই মাথায় হাত রেখে আমার জন্য অনেক অনেক দোয়া করেন। ঠিক যেন ঐ কৃষকের মতন! যিনি চৈত্র মাসের কাঠফাটা রোদে চিড় ধরা মাঠে একটু জল চাইছেন।

আজও আমার মুঠোফোনের ‘Contact List (যোগাযোগ তালিকা)’ খুঁজলে এমন মানুষদের বেশি খুঁজে পাবেন। আমি স্বীকার করছি যে, আমি একটি আদর্শিক পরিবারের সন্তান নই; কিন্তু এই মানুষগুলো মিলেই আমার এক পরিবার। আমি এটাও জানি এই লেখাটা যখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঘুরে বেড়াবে তখন আমার আশি উর্ধ্ব দিদি (ওপার বাংলার) পোস্টের নিচে মন্তব্যের ঘরে কি যেন একটা মন্তব্য নিশ্চয় করবেন।

এই সমস্ত মানুষদের কাছে থেকে কত কি পেয়েছি! এক জীবনে তা পরিশোধ করবার মতন নয়। কিন্তু এই সমস্ত মানুষদের মধ্যে আমি একটি বিষয় খুবই ‘কমন’ পেয়েছি। সত্যি বলতে, এরা সবাই একা; ভয়াবহ রকমের একা। আমার যথেষ্ট বয়েস আছে তাই হয়তো কথা বলার জন্য বা সময় কাটানোর জন্য কেউ না কেউ মিলেই যায়। কিন্তু ওঁদের কাছে যখন যাই তখন নিজের বৃদ্ধকালের কথা ভেবে খারাপ লাগে। একসময় যাঁদের এই একটি পুরো পৃথিবী ছিলো তাঁদের আজ কেউ নেই। একসময় সমস্ত রঙের এই দুনিয়ায় কত রঙ্গ করেছেন কিন্তু আজ তাঁদের জীবন সাদাকালো আশির দশকের সিনেমা…

এই ধরুন, আমার নিজের দাদু ছোটবেলা থেকেই নাকি কি দুর্দান্ত সাহসী ছিলেন। রাজনীতি করেছেন, প্রয়োজনে দলের হয়ে ভাঙচুর করেছেন, মারামারি করেছেন, কেস খেয়েছেন, জেলে ঢুকেছেন এমনকি ‘৭১ এর কত কত লাশের সাক্ষী বলে জাহির করে বেড়ান নিজেকে… কিন্তু আমি তো দেখি এক বৃদ্ধ মানুষ, ময়লা পাঞ্জাবি আর স্ট্রোক করার পর খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হেঁটে যাওয়া এক দরিদ্র এবং বড্ড নিরুপায় মানুষ। আজও রাত ৯টা বাজলে আমার ফোনে আর কোনো ফোনকল সারাদিনে না আসলেও দাদুর ফোনকল টা পাই। রিসিভ না করা পর্যন্ত অবশ্য মুক্তি নেই।

দিদি (শ্রীমতী স্মৃতি দত্ত) কে একদিন কষ্ট দিয়ে বলেছিলাম, “দিদি, আপনি আমার অনেক সময় খেয়ে ফেলেন! আমার তো আরও কাজ আছে আর কাজ না থাকলেও বা কি? নতুন বান্ধবীকেও তো সময় দিতে হবে, নতুবা সে-ও কিন্তু হাওয়া হয়ে যাবে। তখন যাবতীয় দোষ আপনার।”

কিন্তু কে শোনে কার কথা! একের পর একেক ম্যাসেজ দিয়েই যাচ্ছেন। “কেমন কাটলো ঈদ?”, “বিয়ে কবে করছো?”, “আচ্ছা, তোমার উমুক বান্ধবী কি এখনো আছে? মেয়েটা কিন্তু ভালো।”, “তোমাকে এমনিতেও কিন্তু কেউ সহ্য করতে পারবে না, বুঝেছো?” ইত্যাদি প্রশ্নে ভরপেট যাবতীয় ইন্টারনেট জগতের সোশ্যাল মেসেঞ্জার।

এই প্রশ্নগুলো/বিষয়গুলো আমি খুব মনোযোগ দিয়ে পড়ি/ভাবি আর চিন্তা করতে থাকি এসবের “Between the lines” বুঝতে ব্যর্থ থেকে গেলাম না তো! অথচ যতবার এই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিষয়গুলো ‘Decode’ করেছি ততবার এঁদের নিঃসঙ্গতা আমাকে ছুঁয়ে গেছে, দীর্ঘদিন একা থাকার অভ্যেস আমাকে ছুঁয়ে গেছে, একা থেকেও বেঁচে থাকা যায় ব্যাপারটা আমায় ছুঁয়ে গেছে।

এঁদের এই নিঃসঙ্গতা যেমন ‘কমন’ ঠিক তেমনি এই মানুষগুলোর ‘ভালোবাসা-ও’ নিখাঁদ, ভেজালমুক্ত এবং স্বার্থের বাইরের গল্প। এঁরা বড় স্টুপিড, বোকাসোকা আর কি! কিন্তু এঁদের চোখে একবার চোখ রেখে দেখবেন, নিজের বৃদ্ধকাল স্বচ্ছ আয়নার চেয়েও স্পষ্ট দেখতে পাবেন। মনে হবে এই বন্ধুহীন, অর্থহীন (‘জীবনের মানে’ অর্থে) কতটা ভয়ানক! একা একা এই যে জীবনের বাকি সময় পার করবার সাহস আমাদেরও থাকবে তো? মনে রাখা ভালো ওঁরা কিন্তু আমাদের থেকে ভিন্ন নয়, আলাদা সত্ত্বা নয়। ওঁরা আমাদেরই আগামীকাল।

আমার নিকট পূর্বপুরুষদের সাথে আমার খুব বেশি একটা যায় না। যদিও অল্প কিছু দূর থেকে বাবা-মা আমাকে না পেয়ে যে ছটফট করেন তা অনুভূত হয়।

বয়েস পঁচিশ তাই এখন চাকুরী দরকার, বয়েস টা আরো একটু বেড়ে আঠাশ হলে বিয়ে করতেই হবে। ত্রিশ হয়ে গেলে আমাকে দিয়ে আর কিচ্ছু হবার নয়। আদতেই কি তাই? বয়সের সাথে সফলতার যে চরকি লাগানো হয়েছে তা কতটা যুক্তিযুক্ত? যদি না পারি তো? যদি বিয়েটাও না করি তো? এক জীবনে পঁচিশ পর্যন্ত পড়াশোনা এবং চাকুরী, আঠাশে বিয়ে, ত্রিশে ইয়ে, ষাটে অবসর আর ষাটোর্ধ হলে পটল তুলে ফেললেন… এর নাম তবে কি সার্থক জীবন? জানা নাই।

মাত্র এক বছর পর মাস্টার্স করতে গিয়ে আমার মনে হয়েছে, “আমি দেরি করে পাপ করে ফেলেছি।” নিজের লেখা প্রথম বই আমার এক শিক্ষকের হাতে তুলে দিতে গিয়ে শুনতে হয়েছে, “তুমি বিসিএস দিলে কি কি সুযোগ ও সুবিধা পাবে!” অল্প কিছু সময় নাট্যদলে ছিলাম তাই নাকি অধর্ম হয়ে গেছে অনেক। আর যখন প্রথম ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়েছি তো আমি কাফের হয়ে গেছি। আর ব্লগাররা নাস্তিক হয়ে থাকেন। আল্লাহ্’র কসম এই সমস্ত কথা আমায় সরাসরি বলা হয়েছে।

এসব বুঝতে ঢের সময় লাগলো… সরকারী চাকুরীর প্রয়োজনীয়তাও বুঝে আসলো… সর্বশেষ যেটা বুঝলাম, আদতে টাকা থাকাটা জরুরী, খুব করে জরুরী! বিশ্বাস করুন বা নাই করুন, যে স্যুট-কোট পরে সকালবেলা কর্পোরেট অবতার নিয়ে অফিসে যাচ্ছে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তার উক্ত কাজই পছন্দ নয়। যিনি শিক্ষক তিনি হয়তো ডাক্তার হতে চেয়েছিলেন, যিনি ডাক্তার তিনি হয়তো শিক্ষক হতে চেয়েছিলেন।

কেউ ইঞ্জিনিয়ার হয়ে দেশে আরো একটি পদ্মা সেতু তৈয়ার করতে চেয়েছিলেন, কেউ দার্শনিক হয়ে রাষ্ট্রের মাথায় ইত্যাদি ‘তন্ত্র-মন্ত্র’ প্রবেশ করাতে চেয়েছিলেন, কেউ হয়তো সাকিব-আল হাসান কেও ক্রিকেট মাঠে ছাড়িয়ে যেতে চেয়েছিলেন, কেউ হয়তো হাল আমলের ‘জয়া-আহসান’ হয়ে আমার মত যুবকদের হৃদয়ে থাকতে চেয়েছিলেন, কেউ তো ‘SpaceX/Y/Z’ নিয়েও ভেবেছিলেন, কেউ রবীন্দ্র-নজরুল কে ছাপিয়ে নিজের অবস্থান তুলে ধরতে চেয়েছিলেন। অথবা, অস্কার শুধু সত্যজিৎ রায় অবধি -ই বা কেন সীমাবদ্ধ থাকবে! আরো একটি ‘পথের পাঁচালী’ হলে সমস্যাটা ঠিক কোথায়? বা আরও একজন হুমায়ূন আহমেদ কে পেলে মানুষ আবার অন্তত বই হাতে তুলে নিলে নিতেও পারতেন… এই কথাগুলো সারাদিন ধরে লিখে যাওয়া যায়।

কিন্তু যে সমাজে রুটিন জীবন, রুটিন বিষয়বস্তু বা চাকুরী না থাকলে স্বীকৃতি পাওয়া যায় না সে সমাজে আর যাই হোক ‘রুচির দুর্ভিক্ষ’ থাকা খুবই স্বাভাবিক। হাতে গোনা ক’টা সরকারী চাকুরীর সিট; চাইলেও সবাইকে দেওয়া সম্ভবপর নহে। ফলে একজন মানুষের প্রকৃত সত্ত্বা বড্ড সংকটে পড়ে। তাই আশেপাশে খিস্তিখেউড় দেখলে, নোংরামি দেখলে, রুচির মানবিক দুর্ভিক্ষ দেখলে সেটাকে সামষ্টিক ব্যর্থতা হিসেবে দেখাই ভালো।

অন্তত আমার এই চোখে, এই সমাজে এমন কোন ব্যক্তি কে দেখি নাই যিনি কাজ করতে পারেন না। কিন্তু এমন বহু ব্যক্তি কে দেখেছি, যারা জানেন না ঠিক কি করতে হবে? কীভাবে করতে হবে? তবে এই টাকার পেছনে আমাদের নিরন্তর ছুটে চলা সামনেও অব্যাহত থাকবে বলে আমার মনে হয়। আমার বন্ধু পাঁচ ডিজিট উৎরাতে না পারলে ও কে আমার ছয় ডিজিট আয় দেখিয়ে খোঁচা দেবো। অন্তত সে যেহেতু সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজ আয়ের ডিজিটের আওকাদ দেখালো তাই আমিও দেখিয়ে দিলাম।

এতে করে বউ-বাচ্চা নিয়ে কেউ কেউ তো ‘ভ্লগিং’ করছে, ‘রিল’স্’ বানাচ্ছে… অবশ্য এই পর্যন্ত আমরা আবদ্ধ থাকলেও চলতো, এখন নোংরামির এবং ইতরামির চরম সীমায় আমরা চলে গেছি। এই আমি যদি ৩০ সেকেন্ডের ভিডিও বানিয়ে ৩ লাখ টাকা থেকে ৩ কোটি টাকা পর্যন্ত আয় করি তো আমি তো এতসব ভাববো না! কারণ, দিনশেষে টাকা চাই, টাকা মানে রাখে… অথবা, এর ব্যতিক্রম কোনো সমাধান অন্তত আমার কাছে নাই। আমি ছুটছি, বাকিদেরও জোর করছি। ‘ন্যায়’ নিয়ে, ‘নায্যতা’ নিয়ে, ‘ভালোবাসা’ দিয়ে ভেবে দেখা হয় নি বা কখনো প্রয়োজন পড়ে নি।

রুটিন এই জীবনে সার্ভাইভ করার পন্থা কিন্তু এই একটাই। এই সমাজ, এই অবকাঠামো, এই চিন্তা সমস্ত কিন্তু টাকায় কেনা যাচ্ছে। একদিন বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাসে আমি বারবার আমার ওয়েবসাইট চেক করছিলাম যে, বিজ্ঞাপন দেখাচ্ছে তো? ঠিক সেই মূহুর্তে আমার শ্রদ্ধেয় এক শিক্ষক প্রফেসর মমিনুল ইসলাম স্যার এর বলা একটি কথা কানে আসলো, “যেদিন থেকে তুমি টাকার পেছনে ছুটবে, সেদিন থেকে সুখ তোমার জীবনে হাওয়া হয়ে যাবে (বাংলায়)।”

মেহেদি হাসান (বিকেল)

I'm MD Mehedi Hasan, also known by my pen name Mr. Bikel. I'm the admin of the site Ovizatri - News & Magazine. I am a versatile individual with a professional life that spans various fields. I work as a writer, actor, social worker, radio jockey, web developer, web designer, editor, presenter, blood donor, audio and video editor, photo editor, YouTuber, and drama director. I am also a developer and app developer at Microsoft.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button