মনের ময়দানে যুদ্ধ: চিন্তার শক্তি ও তার নিয়ন্ত্রণ
প্রাচীন দর্শন থেকে আধুনিক বিজ্ঞান পর্যন্ত, চিন্তার শক্তির অন্বেষণ
প্রাচীন রোমান দার্শনিক লুসিয়ার অ্যানি উস সিনিকা দা আঙ্গার সেই ২০০০ বছর আগে বলেছিলেন, “উই সাফার মোর ইন ইমেজিনেশন দেন ইন রিয়েলিটি।” অর্থাৎ আমরা বাস্তবের চেয়ে কল্পনায় বেশি কষ্ট পায়। এখন কথা হচ্ছে ২০০০ বছর পরে একটি আধুনিক এবং একই সাথে অনিশ্চিত বিশ্বে যখন আমাদের নেতিবাচক চিন্তাভাবনা আরও অপ্রতিরোধ্য মনে হচ্ছে তখন এই বক্তব্য কতটুকু প্রাসঙ্গিক।
মানুষের প্রাসঙ্গিক চিন্তা নিয়ন্ত্রণের জন্য কি কোন আইন করা হয়েছে?
১৯৫৪ সালের আগ পর্যন্ত চার মিনিটের কম সময়ে কোন মানুষ এক মাইল দূরত্ব অতিক্রম করতে পারতো না। এমনকি বিশেষজ্ঞরাও মনে করতেন যে ৪ মিনিটে এক মাইল দৌড়ানোর কোন মানুষের পক্ষে কখনোই সম্ভব নয়। তারা বিশ্বাস করতেন এক্ষেত্রে প্রধান কারণ হচ্ছে মানুষের পায়ের পেশী শক্তি এবং ফুসফুসের সামর্থ। কেউ এটা করার চেষ্টা করলে মারা যেতে পারে। হাজার বছর ধরে এই ধারণাটি মিথ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে দৌড়বিদদের মনে।
কিন্তু ব্রিটিশ দৌড়বিদ রজার গিলবার ব্যানিস্টার তা মানতে নারাজ। তিনি ১৯৪৬ সালে ১৭ বছর বয়সে অক্সফোর্ডে তার রানিং ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন। ১৯৫৪ সালের ৬ই মে তিনি অক্সফোর্ডে ব্রিটিশ আমিচার অ্যাথলেটিক অ্যাসোসিয়েশনের হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সুযোগ পেলেন। দৌড় শেষ করে লাউড স্পীকার এ যখন ঘোষণা এসেছিল “দ্য টাইম ওয়াস থ্রি”, তার পরের কথাটুকু চাপা পড়ে গিয়েছিল হাজারো জনতার বিজয়ের উল্লাসে। রচিত হলো রানিং দুনিয়ার এক নতুন ইতিহাস।
রজারের সময় লেগেছিল ৩ মিনিট ৫৯.৪ সেকেন্ড। জানা গেল রজারের প্রবল ইচ্ছা শক্তি তাকে দৌড়ের এমন অসম সাহস যুগিয়েছে। ফলাফল সাধিত হয়েছে অসাধ্য। ইচ্ছা শক্তি যে কত বড় একটা শক্তি তার স্বপক্ষে রোজার ব্যারিস্টার এ কেস স্টাডি নিয়ে এখনো নিয়মিত আলোচনা হয়। তিনি অবশ্যই চিন্তা করেছিলেন তিনি পারবেন।
একজন স্বাভাবিক প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের মাথায় নাকি প্রতিদিন ৬০ হাজার থেকে ৮০ হাজার চিন্তা আসে। আইরিশ লেখক মারফি তার ‘পাওয়ার অব সাব কন্সাস মাইন্ড’ বইয়ে বিভিন্ন তথ্য দিয়ে দেখিয়েছিলেন, মানুষ প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে বিচিত্র সব চিন্তাভাবনা করে এবং সেগুলো নিজের ইচ্ছায় করে।
চিন্তা তৈরি হয় মস্তিষ্কে। ৮৬ বিলিয়ন সেল আর সিন্যাপসের যোগফলে এই যে মস্তিষ্ক সেই মস্তিষ্কের মধ্যে যেই নিউরাল নেটওয়ার্ক আছে সেই নেটওয়ার্ক থেকে আসে নানাবিদ চিন্তা। আসে ভালো চিন্তা, খারাপ চিন্তা এবং সেগুলা ক্রমশ প্রভাবিত করতে থাকে আমাদের দেহ কে।
গোটা লাইফস্টাইল ও নিজের ভবিষ্যৎ নির্ভর করে এর ওপরে। ভিন্ন ভিন্ন চিন্তা মানুষের শরীরে ভিন্ন ভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ থেকে উত্তেজিত হয়। পজেটিভ চিন্তা যেমন ডোপামিন ও সেরাটানিন ক্ষরণ বাড়িয়ে দেয় তেমনি নেগেটিভ চিন্তা বা স্ট্রেস বাড়ায় অ্যড্রোনালিন নামক হরমোন। শরীরের এই অভ্যন্তরীণ রাসায়নিক ক্রিয়া-বিক্রিয়া অনুযায়ী রেসপন্স করে আমাদের শরীর। বলা যায়, আমাদের অভ্যন্তরীণ যে প্রাণশক্তি তার অনেকটুকু নিয়ন্ত্রিত হয় এই চিন্তার মাধ্যমে। এই প্রসঙ্গে বেশ মোক্ষম এক উদাহরণ হলো ‘দ্য শিব ইফেক্ট’।
‘দ্য শিব ইফেক্ট’ হলো মূলত কোন একটি প্রক্রিয়া যেখানে একজন মানুষ যা বিশ্বাস করে এই বিশ্বাস অনুযায়ী তার শরীরে রেসপন্স করে। মানে পুরো বিষয়টাই থার্ড প্রসেসকে কন্ট্রোল করার খেলা। ধরুন আপনার শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। আপনি চাইলেই কি মেডিসিন বাদে কমিয়ে দেওয়া সম্ভব।
‘দ্য শিব ইফেক্ট’ বলে সম্ভব হতেও পারে। রোগীকে না জানিয়ে শ্বাসকষ্টের মেডিসিনের বদলে যদি ডাক্তার প্যাসিভ পিল যেমন সুগার পিল রোগীকে খাইয়ে দিলে শুধু তাতেও কিন্তু কমে যেতে পারে শ্বাসকষ্ট। অর্থাৎ আপনার চিন্তা কে এখানে ফিগার করা হচ্ছে। এমনকি গবেষণা বলে পাওয়ার অব ফোরসের মাধ্যমে পেসির শক্তি ও নাড়ানো যায়।
সেক্ষেত্রে বলা যায় চিন্তা শক্তিকে চাইলেই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়। কিন্তু মানুষের অধিকাংশ চিন্তায় আসে অবচেতনে। অবচেতনে আসা চিন্তাকে নিয়ন্ত্রণ করাও থাকে না কোনরকম ব্যবস্থা। ‘ইট দা ফ্রগ’ বই এর সুবাদে প্রোকাশটিনেশন কথাটাও অনেকেই আমরা জানি।
শেষ মুহূর্তের জন্য কোন কাজকে ফেলে রাখা। এর কারণ হলো আমাদের ব্রেনের সিস্টেম। যেটা কিনা সবচেয়ে বেশি নিয়ন্ত্রণকারী। সোজা কথা আমাদের ব্রেন আমাদেরকে কষ্টের চিন্তা থেকে রক্ষা করতে পারে। যার ফলে যে কাজটা কঠিন করতে ভয় সে কাজ এর জন্য ব্রেন নেগেটিভ প্রতিক্রিয়া দেয়।
আর আমাদের ব্রেন নেগেটিভ চিন্তা করতেই পারে। আমাদের চিন্তাশক্তি অনেক কিছুর উপর নির্ভর করে। ১৯৭৮ সালে মনোবিজ্ঞানী এলিজাবেথ মানুষের স্মৃতির উপর বেশ বিখ্যাত একটা পরীক্ষা চালিয়েছিলেন। সেখানে অংশগ্রহণকারী কে একটি সড়ক দূর্ঘটনার ভিডিও দেখানো হয়েছে। এর পরে ভিডিওর ব্যাপারে তাদেরকে দুই ভাগে বেশ কিছু প্রশ্ন করেছিলেন।
সেখানে এক ভাগে প্রশ্ন করা হয়, গাড়িগুলো যখন একে অপরকে আঘাত করে তখন তারা কেমন বেগে যাচ্ছিল? অপর ভাগে একই প্রশ্ন সামান্য ভিন্নভাবে করা হয়। গাড়িগুলো যখন একে অপরকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দেয় তখন তারা কেমন বেগে যাচ্ছিল? গবেষকরা বিষয় নিয়ে আবিষ্কার করেন যে আঘাত শব্দের পরিবর্তে চূর্ণ-বিচূর্ণ শব্দ ব্যবহারের ফলে অংশগ্রহণকারীদের স্মৃতিতে এই দূর্ঘটনার চিত্র ভিন্নভাবে বিশ্লেষিত হয়েছে।
এই একটি শব্দই তাদের স্মৃতিতে দুর্ঘটনার সম্পূর্ণ চিত্র সেটা পরিবর্তন ঘটেছে। আবার পার্থক্য নির্ভর করে অনেকটা আপনার চিন্তাশক্তির উপর। ঠিক এই প্রসঙ্গে বেশ মজার একটি এক্সপেরিমেন্ট করেছিলেন আমেরিকার সাইকোলজিস্ট অ্যালেন। যে এক্সপেরিমেন্টের নাম কাউন্টার ক্লক ওয়াইজ।
এই এক্সপেরিমেন্টের অংশ হিসেবে ১৯৭৯ সালে ৮ জন বয়স্ক মানুষকে তিনি নিয়ে যান প্রাচীন এক নার্সিংহোমে। এই মালিকদের সবারই বয়স ৮০ বা এর বেশি। হোমের সব কিছুকে ২০ বছরের পূর্বের ন্যায় অর্থাৎ ১৯৫৯ সালের সময়ের আদলে সাজানো হয়। টিভি সেটের প্রোগ্রাম থেকে শুরু করে রেডিওতে বাজানো গান, টিভিতে ছবি, টেলিফোন বইপত্র কিংবা আসবাব সবকিছুকে ১৯৫৯ এর সময় সাজানো হয়। তাদের বলা হয় এমন ভাবে জীবন যাপন করতে যেন তারা ২০ বছরের আগের সময় রয়েছে।
এক সপ্তাহ পর দেখা গেল আশ্চর্য কিছু পরিবর্তন। এ বয়স্ক লোক গুলোর মধ্যে দুইজন তাদের লাঠি ব্যবহার করা ছেড়ে দিল। তাদের শ্রবণ দৃষ্টিশক্তি স্মৃতিশক্তি ইত্যাদি বাড়লো দারুন ভাবে এবং তারা আগের চেয়ে অনেকটুক শক্তপোক্ত হয়ে উঠলো।
যেহেতু পজিটিভ চিন্তার ফলাফলে মানুষের জীবনী শক্তি বাড়ি এবং যেহেতু মানুষের পক্ষে সব সময় ভালো চিন্তা করা কঠিন তাহলে কৃত্রিম কোন যন্ত্র ব্যবহার করে মানুষের এই থার্ড প্রসেসকে কন্ট্রোল করা যাবে?
মিগুয়েল নিকোলোসিস নামে এক নিউরোসায়েন্টিস্ট ইঁদুরের ব্রেনে ইলেকট্রড ঢুকিয়ে এরপর ইঁদুরের মস্তিষ্কে ইলেকট্রনিক সিগন্যাল অবজার্ভ করা শুরু করেছিলেন এবং সেই এক্সপেরিমেন্ট থেকে তিনি পান দুর্দান্ত এক ফলাফল। সেটি হচ্ছে ইঁদুরের মস্তিষ্কের ইলেকট্রিক্যাল সিগন্যাল কে কোন মেশিনে যুক্ত করে দিলে মেশিনটি ইঁদুরের মতন করে কাজ করা শুরু করে। যাকে বলা হয় ব্রেন মেশিন ইন্টারফেস।
পরবর্তীতে বানরের ক্ষেত্রেও এই এক্সপেরিমেন্ট করা হয় আর সাফল্য আসে সেখানেও এবং সেখান থেকে ফারদার ডেভেলপমেন্ট প্যারালাইস মানুষের নাড়াচাড়ার ক্ষেত্রেও এই ব্রেন মেশিন ইন্টারফেস ব্যবহার করা হয়। ২০২১ সালের চিলি বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে নিউরো রাইটস কে স্বীকৃতি দেয়।
নিউরাইটস মূলত এমন এক বিষয় যা চিন্তাকে অঙ্গ পতঙ্গের সমান মর্যাদা দেয়। এবং এই মর্যাদা কেউ লঙ্ঘন করলে তার জন্য শাস্তির ব্যবস্থা করা হয় এই আইন অনুযায়ী। ফ্রান্সে মস্তিষ্ককে প্রবাহিত করে এমন কোন টেকনোলজির ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
জার্মানিতে সাইবার এজেন্সি দিয়ে কাজ করছে ২০২১ সাল থেকে। যেখানে তাদের একটি কাজ যাতে কেউ মস্তিষ্ককে অ্যাটাক করতে না পারে সে বিষয়ে নজরদারি করা হয় অর্থাৎ চিন্তা শক্তিকে প্রভাবিত করার জন্য যান্ত্রিক উপায় উদ্ভাবন এবং নিয়ন্ত্রণে তোরজোর শুরু হয়েছে এর মধ্যে।
সামনে সময় প্রযুক্তি আরো উন্নত হবে। সেই উন্নতিতে কতটুকু প্রবাভিত করবে মানুষের চিন্তাভাবনা সেটাই কিন্তু এখন প্রশ্ন। তবে এসব প্রশ্ন ভবিষ্যতের হাতে থাকলেও আমরা বরং নিয়ন্ত্রণ নিয়েই বর্তমান পরিস্থিতির বিষয়ে থাকি চিয়ারফুল। বলি, লাইফ ইজ বিউটিফুল।
ছবি: Image by asierromero on Freepik