বুদ্ধদেব বসুর ভোজন শিল্প: বাঙালি রান্নার নস্টালজিয়া
রবীন্দ্রনাথ থেকে ইলিশ মাছ: বাঙালি রন্ধনশিল্পের বৈচিত্র্য ও ঐতিহ্য
রবীন্দ্রনাথের যাঁর বাড়ীর সংযম ও প্রাচুর্যের সঙ্গম তাঁকে মোহিত করেছিলো। জীবনের বাকি ক্ষেত্রে সর্বতোভাবে তিনি উদার চেতা, স্বচ্ছ দৃষ্টি, খোলা মন, আন্তর্জাতিক, শুধু ভোজন ব্যাপারে ছিলেন বিশুদ্ধ বাঙালি।
বাঙালি খাদ্যের প্রতি ভালোবাসা
পৃথিবীর সমস্ত দেশের রান্না চাখবার পর তাঁর রসনা তৃপ্তি পেতো বাঙালি খাদ্যে। বিদেশে থাকাকালীন সময়ে কেউ এমনকি তাঁর পুত্র, কন্যা, স্ত্রী তাঁকে সর্বভোগ্য ‘পিৎজা’, ‘হ্যামবারগার’, ‘হটডগ’ খাওয়াতে পারেননি। ওসব জাঙ্ক ফুড। এখন তো বহুদিন সারা দুনিয়া এ কথা মানে। আমেরিকান রান্নাঘরে স্ত্রী বিখ্যাত প্রতিভা বসুর হাতের ভাত, ডাল, মাছ-মাংসের ঝোলে তিনি পরিতৃপ্ত হতেন। পৃথিবীর কোনো কোণাতেই তিনি ছিলেন বাঙালি ভোজন শিল্পী।
ভোজন শিল্পীর দক্ষতা
তিনি এমন এক “ভোজন শিল্পী” যিনি জানেন না কড়াইতে তেল ঢালার প্রক্রিয়া। অথচ বোঝেন রসনার মাধ্যমে ভোজ্য বস্তুর গতি প্রকৃতি নির্ধারণ করা। অপূর্ব ক্ষমতাশীল ছিলেন কেবল মাত্র মুখের স্বাদে সুক্ষ্ম ও যথাযথ রন্ধন বিশ্লেষণে।
রান্না ও শিল্পের পার্থক্য
তিনি বলতেন, তোমরা জানো না, রান্না করা আর রান্নাকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার যে গভীর তফাৎ, ততোটাই পার্থক্য প্রাকৃতিক প্রয়োজনে খাওয়া আর ভোজনকে শিল্পের, একটা আর্টে নিয়ে যাওয়া।
রন্ধন প্রক্রিয়া ও রেসিপি
তবে এটা সঠিক যে, যে রন্ধনের বিশ্লেষণ মানে কি মাল মশলায় একটি পদ তৈরী হয়েছে তা রসনার সাহায্যে ধরা গেলেও রন্ধন প্রক্রিয়ার অনুকোটি চৌষট্টি খুঁটিনাটি অর্থাৎ যাকে বলে “রেসিপি”। স্বহস্তে না রাঁধলে হয় না, সেটা বুদ্ধদেবের ক্ষেত্রেও ছিল।
বাঙালি রান্নার বিলুপ্তি
বুদ্ধদেবের মনে হয়েছিল বাঙালি, বিশেষতঃ বাঙাল রান্নার ক্ল্যাসিক ধারাটি বিলুপ্ত হতে পারে। কেননা পরিবর্তন জীবনের একটি রূপ হলেও পরিবর্তনও পরিবর্তনের অধীন, সেটা তো আজকাল ক্রমশঃ প্রমাণিত হচ্ছে।
বুদ্ধদেবের লেখনী
বুদ্ধদেব তাঁর অসামান্য লেখনিতে কলম বদ্ধ করে আমাদের ধন্য করেছেন তাঁর “তিথিডোর” উপন্যাসে স্বাতীর বিয়ের ভোজের বর্ণনা। আর তাঁর শেষ দিকের উপন্যাস “গোলাপ কেন কালো” -তেও সেই একই নস্টালজিয়া।
ভারতীয় রান্নার বৈচিত্র্য
ভারতীয় সাহিত্য বলে কিছু নেই, আছে দশ বারোটি ভাষার সমন্বয়ে তৈরী ভারতীয় ভাষা- এই বলে বিদেশে বহু বক্তৃতা শুরু করতেন বুদ্ধদেব। সেই তিনিই এটাও বলেছেন, ভারতীয় রান্না বলেও কিছু নেই। যা আছে তা হলো অনেকগুলো ভিন্ন ভিন্ন রান্না প্রণালী যুগে যুগে বিভিন্ন খাদ্য বস্তু সহ ভূগোল – ইতিহাস নির্ভরশীলতায়।
ভোজনের নস্টালজিয়া
বুদ্ধদেবের গহন বেদনা, কোথায় গেলো সেই নস্টালজিয়া রান্নাবান্না! জীবনানন্দের ভাষায় যার সুবাস যেন ঘাসের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া সবুজ বাতাসের মতো!
বাঙালি রান্নার ঐতিহ্য
বুদ্ধদেব রবীন্দ্রনাথ শরৎচন্দ্রে চলে এসেছেন। রবীন্দ্রনাথের ‘যোগাযোগ’ এ মধুসূদন (যে ধন বিষয়ে অহংকৃত) খায় রপোর থালা, গেলাসে কিন্তু খায় কি! কলাইয়ের ডাল, কাঁটাচচ্চড়ি তেঁতুলের অম্বল। এমনকি রবীন্দ্রনাথ ‘বিথিকা’য় “নিমন্ত্রণ” কবিতায় সাধারণ কুমড়ো ফুলের মতো জিনিস কেও কবিতায় টেনে এনেছেন। এবারে বুদ্ধদেব বড় রসিয়ে বলছেন, আমার মাতৃভাষা অসামান্য পটিয়সী। তার খাদ্য নামকরণ!
বাঙালি রান্নার বৈচিত্র্য
‘দম’ জিনিসটা আলুর এক্তিয়ারে কিন্তু কুমড়োর সঙ্গে জুড়লেই তিনি ‘দমত্ব’ হারিয়ে ‘ছকা’য় আর ফুলকপির সঙ্গে জুড়লেই ‘ডালনা’য় রুপান্তরিত হন। ‘চচ্চড়ি’, ‘ছেঁচকি’, ‘ছেঁচরা’, ‘ঘন্ট’, ‘লাবড়া’ সবই যে সামান্য মশলা সহযোগে এপিঠ-ওপিঠ তা কাউকে জিজ্ঞাসা করলে মাথা চুলকোবেন তফাৎ বলতে না পেরে।
কারি ও অন্যান্য রান্না
অত্যন্ত রস সহযোগে জানাচ্ছেন বুদ্ধদেব, ‘কারি’ কি! প্রত্যেক ভাষাই যে যার ধরণে সীমাবদ্ধ। ইউরোপীয় কারি আর আমাদের ডাল, সঙ্গে তার চাটনি অম্বল এ যে ‘কারি’ তে মিলেছে এ যে নামেতে কি হবে হাসিতে তোমার পরিচয়, এই রোমান্টিক প্রেম কথা রন্ধনবিজ্ঞানীর নিকট অর্থহীন।
ইলিশ মাছের রান্না
বড় দীর্ঘ হয়ে যাচ্ছে তাই অন্যান্য মৎস ছেড়ে সেই মহান রজত মনোহর দর্শন ইলিশ এ আসি বলছেন উৎসুক হয়ে অধীরতার সঙ্গে বুদ্ধদেব, ইলিশ এমন একটি মাছ কাঁচা খেলেও চলে এর বিশিষ্ট গন্ধেই এ একটা পদ হয়ে ওঠে। কিনবেন কেমন ইলিশ! বড় আকারের চেপটা তেলালো একটি যুবতী ইলিশ।
ইলিশের বিভিন্ন পদ
এমন মাছ যে পঞ্চপদী নানা স্বাদ রান্না হয়ে যাবে শুরুতে মুড়োর সঙ্গে স্নিগ্ধ লাউ, ঝড়তি পরতি কাঁটা দিয়ে ঘন মুগ ডাল, কালচে ব্রাউন কড়কড়ে ভাজা গল কাঁটা, মাছের টুকরো দিয়ে কুমড়ো যোগে কালো জিরে ছেটানো পাতলা ঝোল, আর সরষে দিয়ে কলাপাতায় পাতুরি ও ওঁচা অংশের ল্যাজার একটি চিনি মেশানো পাতিলপবুর ঠাণ্ডা অম্বল।
ইলিশ রান্নার সতর্কতা
মনে রাখবে প্রথমে তেলে ইলিশ মাছ ভেজে সেই তেল দিয়ে কড়কড়ে মাছ ভাজা দিয়ে ভাত খাবেন। বুদ্ধদেব সাবধান করছেন, এই মীনের কাছে যেন পেঁয়াজ রসুন না আসে। পেঁয়াজ হীন কালিয়ার মতো পেঁয়াজ যুক্ত ইলিশও অচিন্তনীয়। আর যদি আলুর মতো কোন জিনিসের সংযোগ ঘটান তাহলে হবে মহাপাতক।
ভোজন ও রন্ধন তত্ত্ব
বুদ্ধদেব বলছেন, ব্যঞ্জন কথাটি থেকেই ভারত বর্ষীয় রন্ধন তত্ত্বটি বোঝা যায়। শার্ল বোদলেয়ার এক কবিকে বলেছিলেন রন্ধন কারীর সহধর্মী। বিশেষ ভাবে বুদ্ধদেবের মত, মাছ মাংসের ‘ঠান্ডা’ পদ। শ্রী পঞ্চমীর দিনে তরুণ ইলিশ যাতে স্রেফ একটু হলুদ, দুর্গাপুজার অজ মাংসে দুটি তেজপাতা, ফালা কাঁচাকলার সঙ্গে আদা জিরের মাগুর, শীতের পাবদায় ধনেপাতা!
রান্নার পরিবর্তন
অত্যন্ত দুঃখে নিরাশ স্বরে বলা বুদ্ধদেবের, দ্বিতীয় যুদ্ধের ধাক্কায় স্বাধীনতার বাংলাদেশের ভূগোল বিপ্লবের পর সব কেটে গিয়েছিলো। ক্ষুদ্রাকার ফ্ল্যাটে স্বামী স্ত্রীর সংসার দু’জনে ই কাজে বেরোন সেই সরঞ্জাম সময় কোথায়! এখন তারা কিনে আনেন চাও মিন বা রুটি মাংস বা খেয়েই আসেন।
রান্নার নস্টালজিয়া
বুদ্ধদেবের গহন বেদনা, কোথায় গেলো সেই নস্টালজিয়া রান্নাবান্না! জীবনানন্দের ভাষায় যার সুবাস যেন ঘাসের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া সবুজ বাতাসের মতো!
Discover more from অভিযাত্রী
Subscribe to get the latest posts sent to your email.