কুইন অব টিয়ারস (Queen of Tears): নায়ক-খলনায়কের বাইরে, জটিল চরিত্র এবং জীবনের বাস্তবতা
কুইন অব টিয়ারস (Queen of Tears) সিরিজ রিভিউ
নাটক, সিনেমা ও সিরিজ দেখার সময় আমাদের মানসিক অবস্থা একটি বিশেষ চরিত্রের প্রতি বেশি আকৃষ্ট হয়। শুধু নাটক, সিনেমা বা সিরিজ নয়, যে কোন বই পড়ার সময় উক্ত বইয়ের নির্দিষ্ট একটি চরিত্র আমাদের তুলনামূলক বেশি ভালো লাগে। আমাদের সাধারণ ধারণা নায়ক ও ভিলেন (খলনায়ক) চরিত্রের উপর বেশি জোর দেয়। আর এই বাইনারি চিন্তার কারণে একজন নায়ক হয়ে ওঠেন সাধারণ জীবন বহির্ভূত একজন পারফেক্ট মানুষ। মুদ্রার অন্যপিঠে একজন খলনায়ক বা ভিলেন অর্থে ভয়ংকর এবং আমাদের ধারণা মতে আদর্শিক মানুষ নন।
নায়ক যিনি তাকে অবশ্যই আমাদের প্রত্যাশিত ‘ক্রিয়া (Action)’ আমাদেরকে উপহার দিতে হবে। অন্যদিকে একজন খলনায়ক যিনি তাকে অবশ্যই আমাদের দৃষ্টিতে ভয়ানক খারাপ হতে হবে। আবার নায়িকার কাজ থাকবে নায়কের সমস্ত ভালো কাজে উপস্থিত থাকা, সাহায্য করা, প্রেমেও পড়া।
আবার বাংলায় যেহেতু নায়িকা প্রধান চরিত্রের সিনেমা (বেদের মেয়ে জোসনা থেকে অগ্নি) সবচেয়ে বেশি ব্যবসাসফল সেহেতু এই নায়িকা সবসময় আমাদের কাছে প্রাসঙ্গিক। অবশ্য এই ধরণের নায়িকা শুধুমাত্র আমাদের ধারণা মোতাবেক তিনি বা তারা ‘প্রাসঙ্গিক’। তাদের নেয়া যে কোন ‘ক্রিয়া (Action)’ আমাদের পছন্দের। যদিও খুব শুরু থেকেই সিনেমা জগতে ‘Antagonist (প্রধান চরিত্র)’ এবং ‘Protagonist (প্রতিপক্ষ)’ বিদ্যমান ছিলো বা আছে যা বাইনারি লজিকের বাইরে।
কিন্তু চরিত্র বিশ্লেষণে আরো শব্দাংশ আছে,
১. Round Character
২. Dynamic Character
৩. Static Character
৪. Flat Character
ও ৫. Foil ইত্যাদি
দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, আমরা যারা সমালোচক তারা এতকিছু নিয়ে অদৌ ভাবি না। আমাদের চিন্তার মধ্যে, লেখনীর মধ্যে যে ভয়ানক বায়াস দেখা যায় তারই প্রভাব একজন দর্শকের মনে আটকে যেতে পারে। আর একারণেই একটি নাটক/সিনেমা/সিরিজ বা বই কেন পড়বেন? বা কেন পড়বেন না? সেটা ‘IMDB’, ‘Rotten Tomatoes’, ‘Google Reviews’ ও ‘My Drama List’ এর যুগে আরো অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক। কারণ কিছু টাকার বিনিময়ে এখন রিভিউ কিনতে পাওয়া যায়। কিছু টাকার বিনিময়ে সস্তা শিল্পকেও হাজারো আর্টিকেল দিয়ে বোঝানো হয়, এটা সস্তা নয় উচ্চমার্গীয় শিল্প। খুব সম্ভবত এজন্যই আজকালের প্রযোজকেরা যতটা গল্পে ধ্যান দিচ্ছেন তার চেয়েও বেশি ধ্যান দিচ্ছেন রিভিউ ও রেটিং -এ।
আমার সর্বশেষ দেখা কোরিয়ান সিরিজ ‘কুইন অব টিয়ারস (Queen of Tears)’ এ ‘প্রতিপক্ষ (Antagonist)’ নির্ধারণে ব্যাপক জটিলতা তৈরি করেছে। একই টাইমলাইমে একাধিক চরিত্র এবং তাদের জীবনে চলমান ঘটনা তাদেরকে হিরো বানাচ্ছে না, না তাদেরকে ভিলেন বানাচ্ছে। এমনকি ‘Antagonist/Protagonist’ ধারণাকেও চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে।
রোমান্টিক সিরিজ হিসেবে উপনীত না হয়ে হিস্ট্রিক্যাল রোমান্টিক সিরিজে রুপান্তর হয়েছে। আর প্রায় একই রকম দর্শন শুধুমাত্র ফিওদর দস্তয়েভস্কির লেন্সে দেখতে পাওয়া যায়। তবে এর ফলে সিরিজের অনেকাংশ দর্শকদের কাছে ‘অনর্থক (Absurd)’ বলে মনে হতে পারে।
‘কুইন অব টিয়ারস (Queen of Tears)’ সিরিজের গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রগুলো হচ্ছে,
১. বাক হিউন-উ (Baek Hyun-woo): একজন সফল ব্যবসায়ী যিনি তার স্ত্রীর প্রতি অবহেলা দেখান।
২. ও হে-ইন (Oh Hee-in): বাক হিউন-উ এর স্ত্রী, একজন গৃহিণী যিনি তার স্বামীর অবহেলার কারণে কষ্ট পান।
৩. কিম সু-হক (Kim Soo-hyuk): ইয়ং-উ-এর বন্ধু এবং ব্যবসায়িক অংশীদার।
৪. ই জি-হো (Lee Ji-ho): হে-ইনের বন্ধু এবং একজন সাংবাদিক।
৫. চা য়ং-হি (Cha Young-hee): ইয়ং-উ-এর মা।
৬. ও জুন-হো (Oh Joon-ho): হে-ইনের বাবা।
৭. সিও জি-সু (Seo Ji-soo): একজন অভিনেত্রী যিনি ইয়ং-উ-এর সাথে একটি সম্পর্ক শুরু করেন।
৮. হং সু-চল (Hong Soo-chol): হে-ইনের ছোট ভাই।
৯. চিওন দা-হাই (Cheon Da-hye): সু-চলের স্ত্রী।
১০. ইউন এন-সাং/ডেভিড ইউন (Yoon Eun-sang / David Yoon): হে-ইনের বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু।
সিনেমা সমালোচকের এই সিরিজ একটি মারাত্মক সমস্যায় ফেলে দিয়েছে। আপনাকে যদি জিজ্ঞেসা করা হয়, এই সিরিজের ভিলেন বা খলনায়ক কে? খুব সম্ভবত আপনি উত্তর খুঁজে পাবেন না। কোন চরিত্রের উপর ঘৃণা আসাটা অন্যায় নয় কিন্তু ঐ চরিত্রের ভূমিকা সম্পর্কে জেনে যখন আপনি আনন্দিত হতে পারেন না তখন একধণের সরলীকরণ করতে পারেন।
এই সিরিজের প্রধান চরিত্র যদিও ‘বাক হিউন-উ’ ও ‘ও হে-ইন’ হলেও বাকি চরিত্রগুলো বাদ দিয়ে এই সিরিজ সম্পূর্ণ করা সম্ভব নয়। এখানে ‘পক্ষ/প্রধান চরিত্র/নায়ক-নায়িকা (Protagonist)’ ও ‘প্রতিপক্ষ/খলনায়ক (Antagonist)’ যারা আছেন তাদের ভূমিকা বেশ জটিলতায় ভরপুর।
কেউ কেন কোন সম্পর্কে ডিভোর্স চাইছেন? সেটাও ন্যায়সঙ্গত মনে হয়েছে। কেউ কেন এত রুক্ষ ব্যবহার করছেন তার স্বামীর প্রতি? সেটাও কিন্তু ন্যায়সঙ্গত মনে হয়েছে। গল্পে যে ত্রিমাত্রিক প্রেমের ধারণা বিদ্যমান সেটাও আমাদেরকে প্রশ্নে ফেলে দেবে। কারণ, কাউকে ভালোবাসা অন্তত আর যাই হোক, অন্যায় নয়।
একই সাথে সম্পত্তি বা কুইন গ্রুপের সিইও হতে চাওয়া মিথ্যে প্রেমিকা সেজে থাকার দর্শন খুব বেশি বিরুক্তি এনে দেবে না। সিরিজ যত এগুবে তত বেশি খোদ নায়ক বা প্রোটাগনিস্ট হিসেবে বাক হিউন-উ আমাদের কাছে যদি আদর্শিক চরিত্র হয় তাহলে যে ন্যারেটিভ ইয়ং এন-সাং এর রয়েছে, তার বেড়ে উঠা, তাকে ছোট বা তুচ্ছ মনে করে সাইডে রাখা ঠিক ততটাই আমাদের তার প্রতি এক ধরণের খারাপলাগা বা আফসোস তৈরি করতে পারে।
সম্পর্কে ধনী-গরিবের বৈষম্য সাময়িক অবস্থা বিবেচনায় দেখানো হয়েছে কিন্তু ভালোবাসা এবং নিয়তির দর্শন স্পষ্ট করা হয়েছে। এই নিয়তিতে কারো স্ত্রী কাউকে ধোকা দিচ্ছে আবার ফিরেও এসেছে, কেউ নিজে কিছুই করতে পারছে না কিন্তু অন্যের আস্তবড় ফ্ল্যাটে রয়েছে। কেউ সেলুনে কাজ করছে আর গ্রামের নারীদের অনর্থক কথাগুলো গিলছে সেটাও বা কম কীসে?
জীবন যেমনই হোক, এক পরিবারের সমৃদ্ধি কিন্তু আরেক পরিবারের দীনতা বা দারিদ্রতা কে দূর্বল হিসেবে দেখানো হয় নাই। খুব কঠিন মহিলাও খারাপ সময়ে তার চোখে জল আসছে। যিনি সবাইকে ধোকা দেন তিনি ভালো মানুষে রুপান্তরিত হচ্ছেন। এবং পুঁজিবাদী সমাজের টাকার ধারণা এবং লোভ মানুষকে কীভাবে সর্বস্বান্ত করে তার রুপকার হিসেবে গল্পের ‘গ্র্যান্ড পা’ অনেকক্ষেত্রে প্রমাণিত উদাহরণ।
কেউ তিনটে বিয়ের পর চার নম্বর বিয়েতে নিজের সঠিক সঙ্গী খুঁজে পাচ্ছে। কেউ বা আবার ভুল মানুষকে নিজের স্ত্রী বিবেচনায় নিজের জীবন মহা-চ্যালেঞ্জে লাগিয়ে দিচ্ছেন। এখানে বাক হিউন-উ এর ব্যক্তিত্ব মন ছুঁয়ে যেতে পারে কিন্তু এই চরিত্র খুবই চতুর প্রকৃতির। এমন মানুষ সাধারণ ক্যাটেগরি তে পড়েন না।
ও হে-ইন বরাবর বিরুক্তিকর চরিত্র মনে হতে পারে বিশেষ করে তার ডুয়ালিটি এবং ১,০০০ বিলিয়ন ক্লাবে জয়েন হবার তীব্র আকাঙ্খা একজন সুপার-উইমেন উপহার দেয়। যে কিনা জানে ভোগবাদের ফাঁদে মানুষকে কীভাবে ফেলে দেওয়া যায়! অথচ, এতকিছু জানার পরেও তার সেক্রেটারি তার প্রতি বিরুক্ত হচ্ছে না উল্টো একজন ওরা ভালো বান্ধবীতে পরিণত হয়েছে।
এখানে ‘মৃত্যু’ কে যখনই টানা হয়েছে এবং একের অধিক উকিল সিরিজে বিদ্যমান থাকায় ‘মৃত্যু’ ভাবনা একাধিক চরিত্রে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। কিন্তু পুনর্জীবন বা মৃত্যু থেকে ফিরে যখন কেউ আসে তখন তার প্রকৃত চেহারা দেখা যায়।
সর্বশেষ যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়েছে সেটা হলো, বাক হিউন-উ এর চরিত্র। এই চরিত্র কিছুটা বাস্তবতা বিবর্জিত এবং সুপার-হিউম্যানের স্থান পেতে পারে। যেটাকে সংক্ষেপে বলা যেতে পারে, “Larger than life (প্রকৃত জীবনের চেয়ে বড় অর্থে)।” বাক হিউন-উ এমন এক চরিত্র যার কাছে সব সমস্যার সমাধান রয়েছে; যা একজন ব্যক্তির পক্ষে থাকা অসম্ভব এবং যৌক্তিকভাবে কিছুটা চোখেও লাগবে।
এই সিরিজের শেষংশে বাক হিউন-উ এর স্বগতোক্তি দিয়ে শেষ হয়। যেখানে বলা হচ্ছে, “আমরা পরিকল্পনা করি যাতে আমাদের জীবন সে পরিকল্পনা মোতাবেক চলে। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আমাদের জীবন কোন পরিকল্পনার ধার ধারে না। জীবন যেমনই হোক একসাথে কাটানো জরুরী… (বাংলা ভাবার্থ)।” প্রথমে মনে হবে এটা এক ধরণের রোমান্টিক কথোপকথন বা স্বগতোক্তি তাই পাত্তা দেবার প্রয়োজন নাই কিন্তু তারপরেই মনে প্রশ্ন জাগে যে, আমাদের জীবন কি আমাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী চলছে?
চিত্রনাট্য খুবই ধীরস্থির কিন্তু আকর্ষণীয়। ব্যক্তিগত রেটিং, ৮/১০
বিজ্ঞাপন
Discover more from অভিযাত্রী
Subscribe to get the latest posts sent to your email.