মক্কা বিজয়ের গোপন প্রস্তুতি: রাসূল (সাঃ) এর কৌশল ও সফলতা
হুদাইবিয়ার সন্ধি থেকে মক্কা বিজয়: ইসলামের শান্তিপূর্ণ বিজয়ের ইতিহাস
আল্লাহর রাসূল (সাঃ) মক্কা বিজয় করবেন এটা তিনি গোপন রেখেছিলেন। বিশিষ্ট কিছু সাহাবী একান্ত ঘনিষ্ঠ তারা জানতেন যে আল্লাহর রাসূল মক্কা বিজয়ের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন। কিন্তু আম সাহাবীদের এই বিষয়টা জানতে দেওয়া হয়নি। তার কারণ, এটা জানাজানি হয়ে গেলে যুদ্ধটা ভয়ঙ্কর হবে এবং ওদের প্রস্তুতিটা অনেক মারাত্মক হবে। এজন্য আল্লাহর রাসূল (সাঃ) পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সেনাপতি হিসেবে মক্কা বিজয়ের প্রস্তুতি গোপন রেখেছিলেন।
হুদাইবিয়ার সন্ধি
হুদাইবিয়ার সন্ধিতে বলা ছিল, আমরা দশ বছরের মধ্যে একে অপরের সঙ্গে যুদ্ধ করবো না। কিন্তু মক্কা বিজয় হলো হুদাইবিয়ার সন্ধির মাত্র ২ বছর পরে। কেন হলো? কারণ মক্কার মুশরিকরা সন্ধির শর্ত ভঙ্গ করেছিল। এই শর্ত ভঙ্গ করার পরে, আল্লাহর রাসূল (সাঃ) তাদের বিরুদ্ধে অভিযান চালাবেন, এটা তিনি গোপনে প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন।
বনু বকর ও বনু খোজা
হুদাইবিয়ার সন্ধিতে বলা ছিল, ছোট ছোট দলগুলি ইচ্ছে করলে কোরাইশদের সাথে বন্ধুত্ব করতে পারে, ইচ্ছে করলে মোহাম্মদ (সাঃ) এর সাথে বন্ধুত্ব করতে পারে। এই প্রস্তাবে, বনু বকর কুরাইশদের সাথে বন্ধুত্ব করেছিল এবং বনু খোজা মোহাম্মদ (সাঃ) এর সাথে বন্ধুত্ব করেছিল। কিন্তু হুদাইবিয়ার সন্ধি সম্পাদিত হওয়ার অল্প দিন পরেই, বনু বকর ও বনু খোজা দুই দলের মধ্যে যুদ্ধ লাগলো।
কুরাইশদের গোপন সহায়তা
যুদ্ধের পরে বনু বকর কুরাইশদের বন্ধু এবং বনু খোজা মুসলমানদের বন্ধু ছিল। বনু বকর এসে বনু খোজার উপর আক্রমণ করল এবং কুরাইশরা গোপনে তাদের সাহায্য করলো। এতে বনু খোজার অনেক লোক হতাহত হল। তারা এসে আল্লাহর রাসূলের (সাঃ) কাছে অভিযোগ করল যে, কুরাইশরা সন্ধির শর্ত ভঙ্গ করে বনু বকরকে সাহায্য করেছে এবং আমাদের বহু লোক হতাহত হয়েছে।
ব্লাডমানি দাবি
আল্লাহর রাসূল (সাঃ) আবু সুফিয়ানকে জানালেন, তোমরা আমাদের বনু খোজা বন্ধু দলের লোকগুলো হত্যা করেছ, এই প্রত্যেকটা মানুষের পরিবর্তে ব্লাডমানি ১০০টা উট আমার কাছে জমা দাও। যদি জমা না দাও তাহলে মনে কর যে হুদায়বিয়ার সন্ধি শেষ। কুরাইশরা এতগুলো লোকের ব্লাডমানি পরিশোধ করতে অক্ষম ছিল এবং হুদায়বিয়ার সন্ধি শেষ হয়ে গেল।
মক্কা বিজয়ের প্রস্তুতি
আল্লাহর রাসূল (সাঃ) মক্কা বিজয়ের জন্য প্রস্তুতি নিলেন কিন্তু এটি গোপন রেখেছিলেন। মক্কার লোকেরা বুঝতে পারল, আমরা এত যুদ্ধ করে মুসলমানদের কিছু করতে পারলাম না, এখন হুদাইবিয়ার সন্ধি যদি ভঙ্গ হয়ে যায়, তাহলে মুসলমানরা যদি আমাদের শহরে আক্রমণ করে, আমরা তাদের সাথে পারবো না।
আবু সুফিয়ানের মদিনা যাত্রা
মক্কার লোকেরা আবু সুফিয়ানকে মদিনায় পাঠালো যাতে তিনি মোহাম্মদ (সাঃ) এর সাথে হুদাইবিয়ার সন্ধি পুনর্জীবিত করার জন্য আলোচনা করেন। আবু সুফিয়ান মদিনায় এসে প্রথমে তার কন্যা উম্মে হাবিবার গৃহে প্রবেশ করলেন। উম্মে হাবিবা তার বাবা দেখে বিছানাটা গুটিয়ে ফেললেন। এরপর আবু সুফিয়ান বললেন, “মা, এটা কি করলে তুমি বিছানাটা গুটিয়ে ফেললে? আমি কি এই বিছানার উপযুক্ত না?” উম্মে হাবিবা বললেন, “আপনি নাপাক, আপনি মুশরিক, আল্লাহর রাসূলের বিছানায় আপনার বসার অধিকার নেই।”
সাহাবীদের সাথে আলোচনা
আবু সুফিয়ান এরপর আবু বক্কর সিদ্দিক (রাঃ), ওমর ফারুক (রাঃ) এবং হযরত আলী (রাঃ) এর কাছে গেলেন কিন্তু কেউই তাকে সাহায্য করতে রাজি হলেন না। আলী (রাঃ) তাকে মদিনার মসজিদের কাছে গিয়ে নিজের নিরাপত্তা দাবি করতে বললেন। আবু সুফিয়ান এভাবে পালিয়ে গেলেন এবং হুদাইবিয়ার সন্ধির কোন পুনর্জীবন হলো না।
সারা নামক মহিলার ঘটনা
এরপর সারা নামক একজন মহিলা, যিনি গায়ক, ড্যান্সার এবং সিঙ্গার ছিলেন, মদিনায় এসে আল্লাহর রাসূলের (সাঃ) সাথে দেখা করলেন। আল্লাহর রাসূল (সাঃ) তাকে জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি কি মুসলমান হয়েছো?” সে বলল, “না।” এরপর তাকে জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি কি হিজরত করেছ?” সে বলল, “না।” তখন সে বলল, “আমি অভাবগ্রস্ত, আমি আপনাদের কাছ থেকে খাদ্য ও পোশাক চাই।” আল্লাহর রাসূল (সাঃ) বনি মোতালিবকে ডেকে বললেন, “এই মহিলাকে তোমরা যে যা পারো সাহায্য কর।”
হাতেম ইবনে আবি বোলতার চিঠি
হাতেম ইবনে আবি বোলতা, একজন বদরী সাহাবী, তার পরিবার-পরিজন মক্কায় ছিল এবং তিনি জানতেন আল্লাহর রাসূল (সাঃ) মক্কা বিজয়ের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তিনি সারা নামক মহিলাকে দশটা স্বর্ণমুদ্রা দিয়ে একটি চিঠি দিলেন, যাতে লেখা ছিল, মোহাম্মদ (সাঃ) আপনাদের উপর আক্রমণ করবেন। এই চিঠি নিয়ে সারা যখন যাচ্ছিল, তখন জিব্রাইল আমিন এসে আল্লাহর রাসূলকে জানালেন।
চিঠি উদ্ধার
আল্লাহর রাসূল (সাঃ) হযরত আলী (রাঃ), মেঘদাত (রাঃ), তালহা (রাঃ) এবং জুবায়ের (রাঃ) কে বললেন, “তোমরা সোজা মক্কার পথে ঘোড়া ছুটিয়ে যাও এবং রওজায় খাক নামক জায়গাতে সারা নামক মহিলাকে পাবে, তার কাছে একটি চিঠি আছে, ওটা নিয়ে আসবে। সে যদি দিতে রাজি না হয় তাহলে তাকে হত্যা করবে।” তারা সেখানে গিয়ে মহিলাকে পেল এবং চিঠি উদ্ধার করল।
হাতেম ইবনে আবি বোলতার ক্ষমা
আল্লাহর রাসূল (সাঃ) হাতেম ইবনে আবি বোলতাকে ডেকে বললেন, “এই চিঠি কার?” তখন তিনি বললেন, “হুজুর, এটা আমার চিঠি।” তিনি বললেন, “ইয়া রাসুল আল্লাহ, আমি মোনাফেক হইনি, ঈমান ত্যাগ করিনি, কিন্তু আমার পরিবার-পরিজন মক্কায়, তাদের দেখাশোনার কেউ নেই। কাজেই এই যুদ্ধের মধ্যে আমার পরিবার-পরিজনকে যেন তারা দেখে, এ কারণে আমি এই চিঠিটা দিয়েছি।” ওমর ফারুক (রাঃ) রেগে গেলেন এবং বললেন, “ইয়া রাসুল আল্লাহ, হুকুম দেন আমি ওকে হত্যা করব।” তখন আল্লাহর রাসূল (সাঃ) বললেন, “উমর, তুমি অপেক্ষা কর, এ লোকটা কিন্তু বদরী সাহাবী।” এরপর আল্লাহর রাসূল (সাঃ) হাতেম ইবনে আবি বোলতাকে ক্ষমা করে দিলেন।
মক্কা বিজয়ের প্রস্তুতির গোপনীয়তা
আল্লাহর রাসূল (সাঃ) মক্কা বিজয়ের প্রস্তুতি গোপন রেখেছিলেন কারণ তিনি জানতেন যে, যদি এই তথ্য প্রকাশ পায়, তাহলে কুরাইশরা আরও শক্তিশালী প্রস্তুতি নেবে এবং যুদ্ধ আরও ভয়ঙ্কর হবে। তিনি তার সেনাবাহিনীকে প্রস্তুত করছিলেন এবং কৌশলগতভাবে মক্কা বিজয়ের পরিকল্পনা করছিলেন।
মক্কা বিজয়ের ঘটনা
মক্কা বিজয়ের সময়, আল্লাহর রাসূল (সাঃ) তার সেনাবাহিনীকে চারটি দলে বিভক্ত করেছিলেন এবং মক্কার চারটি প্রবেশদ্বার দিয়ে প্রবেশ করেছিলেন। তিনি নির্দেশ দিয়েছিলেন যে, কেউ যেন যুদ্ধ না করে এবং শুধুমাত্র আত্মরক্ষার জন্য অস্ত্র ব্যবহার করে। মক্কা বিজয়ের সময় কোন বড় যুদ্ধ হয়নি এবং মক্কা শান্তিপূর্ণভাবে বিজিত হয়েছিল।
মক্কা বিজয়ের পরবর্তী ঘটনা
মক্কা বিজয়ের পর, আল্লাহর রাসূল (সাঃ) কাবা শরীফে প্রবেশ করেন এবং সেখানে থাকা মূর্তিগুলো ধ্বংস করেন। তিনি ঘোষণা করেন, “সত্য এসেছে এবং মিথ্যা বিলুপ্ত হয়েছে।” এরপর তিনি মক্কার জনগণকে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন এবং তাদেরকে ইসলামের দিকে আহ্বান জানান। মক্কার অনেক মানুষ ইসলাম গ্রহণ করেন এবং মক্কা ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হয়ে ওঠে।
মক্কা বিজয়ের প্রভাব
মক্কা বিজয়ের ফলে ইসলামের প্রচার ও প্রসার আরও দ্রুত হয়। মক্কা বিজয়ের মাধ্যমে মুসলমানরা একটি শক্তিশালী ভিত্তি পায় এবং ইসলামের শত্রুরা দুর্বল হয়ে পড়ে। মক্কা বিজয়ের মাধ্যমে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) ইসলামের শান্তিপূর্ণ ও সহনশীল প্রকৃতি প্রদর্শন করেন, যা পরবর্তীতে ইসলামের প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
উপসংহার
আল্লাহর রাসূল (সাঃ) মক্কা বিজয়ের প্রস্তুতি গোপন রেখেছিলেন কৌশলগত কারণে। তিনি জানতেন যে, এই তথ্য প্রকাশ পেলে কুরাইশরা আরও শক্তিশালী প্রস্তুতি নেবে এবং যুদ্ধ আরও ভয়ঙ্কর হবে। মক্কা বিজয়ের মাধ্যমে তিনি ইসলামের শান্তিপূর্ণ ও সহনশীল প্রকৃতি প্রদর্শন করেন এবং মক্কার জনগণকে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন। মক্কা বিজয়ের ফলে ইসলামের প্রচার ও প্রসার আরও দ্রুত হয় এবং মুসলমানরা একটি শক্তিশালী ভিত্তি পায়।
তথ্যবহুল টেবিল
বিষয় | ঘটনা | মন্তব্য |
---|---|---|
মক্কা বিজয়ের প্রস্তুতি | গোপন রাখা | যুদ্ধের প্রস্তুতি গোপন রাখা হয়েছিল |
হুদাইবিয়ার সন্ধি | শর্ত ভঙ্গ | মক্কার মুশরিকরা শর্ত ভঙ্গ করেছিল |
বনু বকর ও বনু খোজা | যুদ্ধ | কুরাইশরা বনু বকরকে সাহায্য করেছিল |
ব্লাডমানি দাবি | ১০০ উট | কুরাইশরা ব্লাডমানি দিতে অক্ষম ছিল |
আবু সুফিয়ানের মদিনা যাত্রা | সন্ধি পুনর্জীবিত | আবু সুফিয়ান ব্যর্থ হন |
সারা নামক মহিলা | চিঠি | হাতেম ইবনে আবি বোলতার চিঠি |
চিঠি উদ্ধার | সাহাবীদের অভিযান | চিঠি উদ্ধার করা হয় |
মক্কা বিজয় | শান্তিপূর্ণ | কোন বড় যুদ্ধ হয়নি |
মূর্তি ধ্বংস | কাবা শরীফ | মূর্তিগুলো ধ্বংস করা হয় |
সাধারণ ক্ষমা | মক্কার জনগণ | মক্কার জনগণকে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হয় |
Discover more from অভিযাত্রী
Subscribe to get the latest posts sent to your email.