ইউনুস (আঃ) এর জাতির তওবা: আল্লাহর রহমত ও ক্ষমার অনন্য উদাহরণ
ইউনুস (আঃ) এর দাওয়াত, জাতির তওবা এবং আল্লাহর করুণা
আল্লাহ তাআলা বলেন,
فَلَوۡ لَا کَانَتۡ قَرۡیَۃٌ اٰمَنَتۡ فَنَفَعَهَاۤ اِیۡمَانُهَاۤ اِلَّا قَوۡمَ یُوۡنُسَ ؕ لَمَّاۤ اٰمَنُوۡا کَشَفۡنَا عَنۡهُمۡ عَذَابَ الۡخِزۡیِ فِی الۡحَیٰوۃِ الدُّنۡیَا وَ مَتَّعۡنٰهُمۡ اِلٰی حِیۡنٍ
অর্থ: সুতরাং কোন জনপদ কেন এমন হল না যা ঈমান এনেছে অতঃপর তার সে ঈমান গ্রহণ হয়েছে কল্যাণকর? অবশ্য ইউনুসের সম্প্রদায়ের কথা আলাদা। তারা যখন ঈমান আনে তখন আমি তুলে নেই তাদের উপর থেকে অপমানজনক আজাব-পার্থিব জীবনে এবং তাদের যে কল্যাণ পৌঁছায় এক নির্ধারিত সময় পর্যন্ত। [সূরা ইউনুস, আয়াত-৯৮]
ইউনুস (আঃ) এর জাতির তওবা
আদম (আঃ) থেকে মোহাম্মদ (সাঃ) পর্যন্ত এক আইন একভাবে চলে আসছে। শাস্তির ওয়াদা করলে শাস্তির নিদর্শন এসে গেলে কোন মানুষের ঈমান কবুল হয় না। আল্লাহ তাআলা বলেন কিন্তু একটা ব্যতিক্রম আছে।
ইউনুস (আঃ) এর জাতিকে শাস্তির ওয়াদা দেওয়া হয়েছিল তারপরে ওরা তওবা করার পরে, তাদের তওবা কবুল করা হয়েছিল। এই একটাই নিদর্শন এটা আছে। এটার কারণ হলো আল্লাহর জন্য কোন আইন পালন করা ওয়াজিব না। আল্লাহর জন্য কোন আইন পালন করা ফরজ ওয়াজিব না। আইন আছে, এটা আমি মানবো না। আল্লাহ সেটা দেখিয়ে দিলেন। শাস্তি দেখে ঈমান আনলে ঈমান কবুল হয় না। কিন্তু একটা ব্যতিক্রম।
সেটা হল, ইউনুস (আঃ) এর জাতি যখন তারা ঈমান আনলো আল্লাহ বলেন আমি তাদের থেকে শাস্তি দূর করলাম। এবং নির্ধারিত সময় পর্যন্ত তাদের ভোগ বিলাসের সুযোগ আমি দিলাম। ইউনুস (আঃ) এর এলাকাটা ছিল দজলা নদীর উত্তর পাড়ে।
ইউনুস (আঃ) এর দাওয়াত
ইরাকের মোসা শহরের অন্তর্ভুক্ত নিনুয়া জায়গায় ইউনুস (আঃ) কে আল্লাহ তাআলা নবী হিসেবে পাঠিয়ে ছিলেন। এবং এইখানে যে মূর্তিটা ছিল সেই মূর্তি টার নাম বায়াল। বায়াল মুর্তি এবং বায়ালের নামে ওখানে একটা শহর আছে সেই শহরের নাম বালা-বাক্যু শহর।
এই বায়াল মূর্তিটার চতুর্দিকে চেহারা ছিল ৪০ হাত লম্বা ছিল। শয়তান এই মূর্তিটার ভিতরে ঢুকে কথা বলতো। এই মূর্তির নবী ছিল ৪০০ জন। শয়তান যা বলত এই নবীরা অন্যান্য এলাকায় যেয়ে সেগুলো প্রচার করতো।
ইউনুস (আঃ) এ এলাকায় নবী হয়ে গেছেন, “মানুষদেরকে দাওয়াত দিলো কিন্তু কেউ দাওয়াত কবুল করলো না।” শেষ পর্যন্ত তিনি আল্লাহর কাছে দোয়া করেছেন আল্লাহতালা বলেছেন “তিন দিন পরে তাদের উপর শাস্তি আসবে।” এরপর ইউনুস (আঃ) তা জাতিকে জানাই দিলেন, “যে তিন দিনের মধ্যে তোমরা যদি ঈমান আনো, আনতে পারো। তাছাড়া তিনদিন পরে তোমাদের উপর শাস্তি আসবে। এখন জাতিরা তাও বিশ্বাস করে না।”
শাস্তির আগমন
এখন ওরা চিন্তা করছে যদি এটা সত্য হয় তাহলে আমরা দেখব যে ইউনুস (আঃ) যখন আমাদের থেকে পালিয়ে যাবে, আমার মধ্যে থাকবে না তখন বুঝবো যে আমাদের মধ্যে শাস্তি আসবে। যতক্ষণ নবী আমাদের মধ্যে থাকবে ততক্ষণ শাস্তি আমাদের উপর আসবে না। হঠাৎ করে তারা দেখে কোন এক সকালবেলা আকাশে খুব ঘন মেঘ এবং মেঘের মধ্যে ধোঁয়া সেই ধোঁয়া এমন ধুয়া যে, তাদের শহরটা সম্পন্ন আচ্ছন্ন করে ফেলেছে অন্ধকার হয়ে গেছে।
তখন ওরা ভয় পেয়ে গেল এবার শাস্তি মনে হয় এসে গেছে, তখন তারা ইউনুস (আঃ) কে খোঁজ করলো, এবং দেখল যে ইউনুস (আঃ) নাই। তখন ওরা নিশ্চিত হয়ে গেল যে পয়গাম্বর যখন চলে গেছে। তখন শাস্তি নিশ্চয়ই আমাদের উপরে আসবে। তখন ওরা ওই সময় আল্লাহর কাছে তওবা করল এইভাবে, নারী-পুরুষ সবাই একটা খোলা মাঠে চলে গেল। নারী-পুরুষ পৃথক হয়ে গেল। নারীরা তাদের সন্তানদেরকে পৃথকভাবে খাঁচায় বন্দি করে রাখলো।
সন্তানেরা ওখানে বসে কাঁদছে, মায়েরা এখানে বসে কাঁদছে। পশু গুলো মাঠে নিয়ে যাওয়া হলো। মা পশুগুলো এক জায়গায় রাখা হলো, বাচ্চা পশুগুলো আলাদা করা হল। এরপর পশু মানুষ এমনভাবে কান্না শুরু করল যে আকাশ পৃথিবী মুখরিত করে তুলেছে।
তখন আল্লাহ তাআলা এই জাতির তাওবা কবুল করেছেন। তাওবা কবুল হওয়ার ৩ দিন পর ইউনুস (আঃ) দেখলেন যে, ওরা সব ঠিক আছে। তখন ইউনুস (আঃ) মনে করলেন যে, “এখন আমি ওদের কাছে গেলে, ওরা আমাকে হত্যা করবে।”
কারণ সেই জাতির নিয়ম ছিল কেউ মিথ্যা বললে তাকে কতল করা হতো। ইউনুস (আঃ) ঘাবড়ে গেলেন এরপর জাতির কাছে না গিয়ে তিনি পালাতে শুরু করলেন। কিন্তু আল্লাহ কি ওনাকে বলেন, এইটুকু অপেক্ষা করেন নাই। এটাই ওনার একটু ব্যস্ততা হয়ে গেছে। যে আল্লাহ তাকে কি বলেন, এইটা না শুনে উনি আগেই প্রাণ ভরে পালাতে শুরু করলেন। দজলা নদীর পাড়ে যে একটা ভরা নৌকা যাচ্ছে উনি সেই নৌকায় উঠে গেলেন।
ইউনুস (আঃ) কে বিনা ভাড়ায় নৌকায় নিলেন কারণ তারা জানত যে ইনি নবী। কিন্তু নৌকা কিছু দূর যাওয়ার পরে আর চলে না। সামনেও যায় না, পিছনেও যায় না, ডানেও যায় না, বামেও যায় না। এরপর সবাই ভীত হয়ে গেল যে নৌকা ডুবে যাবে আমরা সবাই ধ্বংস হয়ে যাবো।
তখন সবাই বলল এই নৌকায় কিছু না কিছু ঘটেছে। এ নৌকায় কোন পালাতক গোলাম আছে। তখন ইউনুস (আঃ) বললেন যে, আমি পালাতক গোলাম তোমরা আমাকেই নদীতে ফেলে দাও।
তখন সবাই বলল, না আপনি নবী মানুষ আপনি পালাতক গোলাম হতে পারেন না, এরপর তিনবার লটারি করলো তিনবারই ইউনুস (আঃ) নাম উঠল। এরপর ইউনুস (আঃ) নৌকার পিছন দিক থেকে পানিতে ঝাঁপ মারলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে একটা মাছ তাকে গিলে ফেললেন।
গিলে ফেলার পর এই মাছটা আস্তে আস্তে সমুদ্রের গভীরে চলে গেল। এরপর ওই মাসকে আল্লাহতালা জানিয়ে দিলেন, দেখো মাছ ইউনুস (আঃ) তোমার খাবার নয় তোমার পেট জন্য জেলখানা। তুমি তাকে রক্ষা করো হেফাজত করো। এবং নদীর গভিরে পাথরের নুড়ি গুলো আল্লাহর তসবিহ পাঠ করছে এটা ইউনুস (আঃ) শুনতে পাইলেন। তখন ওখানেই বসে আল্লাহকে ডাক দিয়ে বললেন,
وَ ذَاالنُّوۡنِ اِذۡ ذَّهَبَ مُغَاضِبًا فَظَنَّ اَنۡ لَّنۡ نَّقۡدِرَ عَلَیۡهِ فَنَادٰی فِی الظُّلُمٰتِ اَنۡ لَّاۤ اِلٰهَ اِلَّاۤ اَنۡتَ سُبۡحٰنَکَ ٭ۖ اِنِّیۡ کُنۡتُ مِنَ الظّٰلِمِیۡنَ
অর্থ: আর স্মরণ কর যুন-নূন এর কথা, যখন সে রাগান্বিত অবস্থায় চলে গিয়েছিল এবং মনে করেছিল যে, আমি তার উপর ক্ষমতা প্রয়োগ করব না। তারপর সে অন্ধকার থেকে ডেকে বলেছিল, আপনি ছাড়া কোন ইলাহ নেই। আপনি পবিত্র মহান। নিশ্চয় আমি ছিলাম যালিম। [সূরা আম্বিয়া, আয়াত-৮৭]
এরপর আল্লাহ তাআলা মাছকে অর্ডার করলেন। তখন মাছ ইউনুস (আঃ) কে নদীর চরে বমি করে ফেললেন। এবং আল্লাহ তাআলা ইউনুস (আঃ) কে মুক্ত করে দিলেন।
বিপদে পড়লে কী করবেন?
আমাদের সময়জে যদি মহা বিপদ হয়, তখন আমরা দোয়া ইউনুস পাঠ করি। তার কারন হল, যেটা হবেনা সেই অসম্ভব ব্যাপার এখানে ঘটেছে। তো এখন আমরা এই দোয়াটাতো পড়ি, আমাদের ওলামা মাশায়েখ তারা চিন্তা করেছে যে ইউনুস (আঃ) এর জাতি সম্বন্ধে কোরআনে বলা আছে, এক লক্ষ অথবা এক লক্ষের কিছু বেশি ছিল ইউনুস (আঃ) এর উম্মত। এক লক্ষ বা তার চাইতে কিছু বেশি লোক এই দোয়া পড়ে মুক্তি পেয়েছে।
তাহলে এই দোয়াটা আমরা এক লক্ষ বারের উপরে পড়বো। এক লক্ষ বা সোয়া লক্ষ বার এটা আমরা পড়ব, পরে যদি আল্লাহর কাছে মাফ চাই আল্লাহ ক্ষমা করতে পারেন। এই জন্যই কিন্তু আমরা দোয়া ইউনুস টা পড়লে এক লক্ষ বা তার উপরে পড়ি। যেহেতু কোরআনে বলা আছে এক লক্ষ বা তার চাইতে একটু বেশি, এই জন্য এটা একটা অবলম্বন এই উসিলায় আল্লাহতালা আমাদের মাফ করতে পারেন।
দোয়া ইউনুস
লা ইলাহা ইল্লা আনতা সুবহানাকা ইন্নী কুনতু মিনাল জালিমীন
অর্থ: আপনি ছাড়া কোন ইলাহ নেই। আপনি পবিত্র মহান। নিশ্চয় আমি ছিলাম যালিম।
ইউনুস (আঃ) এর গল্পের শিক্ষা
ইউনুস (আঃ) এর গল্প থেকে আমরা কিছু গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা পেতে পারি:
- আল্লাহর রহমত: আল্লাহ তাআলা যে কোন সময়ে তাওবা কবুল করেন এবং তাওবা করলে শাস্তি থেকে মুক্তি দেন।
- নবীর ভূমিকা: নবীগণ মানুষকে সঠিক পথে নিয়ে যাওয়ার জন্য আল্লাহর দূত হিসেবে কাজ করেন।
- মানুষের তওবা: মানুষ যখন তাওবা করে তখন আল্লাহ তাআলা তাদের শাস্তি থেকে মুক্তি দেন।
উপসংহার
ইউনুস (আঃ) এর গল্প আমাদের শিক্ষা দেয় যে, আল্লাহ তাআলার রহমত অসীম। তিনি যে কোন সময়ে তাওবা কবুল করেন এবং তাওবা করলে শাস্তি থেকে মুক্তি দেন। ইউনুস (আঃ) এর জাতির তওবা কবুল হওয়ার কাহিনী আমাদের প্রতিটি মুসলমানের জন্য একটি অনুপ্রেরণামূলক উদাহরণ।
আমরা যখন বিপদে পড়ি, তখন আল্লাহর কাছে দোয়া করা উচিত। দোয়া ইউনুস পাঠ করে আমরা আল্লাহর রহমতের উপর ভরসা করি এবং তাওবা করি। আল্লাহ তাআলার রহমতের উপর আমাদের অটুট বিশ্বাস থাকা দরকার, কারণ তিনি সর্বদা আমাদের দুঃখ-কষ্ট থেকে মুক্তি দিতে পারেন।
আমরা যেন সর্বদা আল্লাহর পথে চলতে থাকি এবং তাঁর আদেশ মেনে চলি। ইউনুস (আঃ) এর গল্প আমাদের জীবনের একটি বড় শিক্ষা দেয় যে, আল্লাহর রহমত ও করুণা সর্বদা আমাদের সাথে আছে। আমরা যেন সর্বদা আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞ থাকি এবং তাঁর আদেশ মেনে চলি।
শেষ কথায়, আমরা যেন সর্বদা আল্লাহর পথে চলতে থাকি এবং তাঁর আদেশ মেনে চলি। ইউনুস (আঃ) এর গল্প আমাদের জীবনের একটি বড় শিক্ষা দেয় যে, আল্লাহর রহমত ও করুণা সর্বদা আমাদের সাথে আছে। আমরা যেন সর্বদা আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞ থাকি এবং তাঁর আদেশ মেনে চলি।
Discover more from অভিযাত্রী
Subscribe to get the latest posts sent to your email.