ইমপ্রিন্টিং এবং সংযুক্তি তত্ত্ব: শৈশবের অভিজ্ঞতা কিভাবে আমাদের জীবনে প্রভাব ফেলে?
বাঘ ও বিড়ালের উদাহরণ থেকে মানুষের আচরণগত বিকাশের রহস্য উদঘাটন
ভুল পরিবেশে একজন মেধাবী ছাত্র বড় হলে তার মেধা সম্পূর্ণভাবে বিকশিত হতে পারে না।
বাঘ ও বিড়ালের তুলনা
বাঘ ও বিড়াল দুটোই ফেলিড পরিবারের অন্তর্ভুক্ত প্রাণী। ছোটবেলা থেকে একটি বাঘ যদি বিড়ালের সাথে বেড়ে ওঠে, তাহলে খুব সম্ভবত বাঘ বিড়ালের বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য নিজের মধ্যে আবিষ্কার করতে পারে। কিন্তু জিনগতভাবে একটি বাঘ কিন্তু বাঘ-ই থেকে যায়। এটাকে বলা হয় ‘ইমপ্রিন্টিং (Imprinting)’। প্রাণীরা যখন জন্মগ্রহণ করে তখন তার আশেপাশে যা দেখে থাকে সেটাকেই আপন করে নেয়, সেটাকেই অনুলিপি করতে শুরু করে। ঠিক তেমনভাবেই বাঘ যখন বিড়ালের সাথে বেড়ে উঠে তখন খুব স্বাভাবিক সে বিড়ালের মত করে “মিঁয়াও… মিঁয়াও… মিঁয়াও…” করতে শুরু করতে পারে। বিড়ালের মত ইঁদুরের পেছনে ছোটাছুটিও হতে পারে তার একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য। কিন্তু এতে করে বাঘ কিন্তু বিড়াল হয়ে যায় না। প্রাণীদের এই আচরণ নিয়ে বিস্তর গবেষণা পাওয়া যায়।
ইমপ্রিন্টিং এবং মানুষের আচরণ
কনরাড লরেঞ্জ (Konrad Lorenz) নামক একজন আচরণবিদ (Ethologist) প্রাণীদের মধ্যে এই ইমপ্রিন্টিং বিষয়ে আমাদের পরিষ্কার করেছেন। প্রশ্ন হচ্ছে, এই ইমপ্রিন্টিং কি মানুষের মধ্যে ঘটতে পারে? মনোবিজ্ঞান এখানে আমাদের ‘সংযুক্তি তত্ত্ব (Attachment Theory)’ উপহার দেয় যার ভিত্তি কিন্তু ঐ কনরাড লরেঞ্জের আবিষ্কার ইমপ্রিন্টিং।
সংযুক্তি তত্ত্ব
সংযুক্তি তত্ত্ব, যা জন বোলবি দ্বারা বিকশিত এবং পরে মেরি এইন্সওয়ার্থ দ্বারা সম্প্রসারিত হয়, এটি ব্যাখ্যা করে যে কীভাবে ব্যক্তিদের মধ্যে গভীর আবেগগত বন্ধন গঠিত হয়, বিশেষ করে শিশু এবং তাদের প্রধান যত্নদাতাদের মধ্যে। এই তত্ত্বটি প্রস্তাব করে যে, এই প্রাথমিক বন্ধনগুলি একজন ব্যক্তির আবেগগত বিকাশ এবং তাদের জীবনের সম্পর্কগুলিতে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলে। আমরা কত ভালো বা মন্দ তা প্রধানত শিখে থাকি আমাদের অভিভাবকদের কাছ থেকে এবং পরবর্তীতে এক জীবন আমরা আমাদের অভিভাবকদের থেকে যা যা শিখেছি তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে পারি। আমাদের আচরণগত দিক নির্ধারিত হয় আমাদের শৈশবকালে (Formative Stage)।
ইমপ্রিন্টিংয়ের প্রকারভেদ
ইমপ্রিন্টিংকে তিনভাগে ভাগ করা হয়েছে:
১. Filial Imprinting: নতুন বাচ্চা এবং তার পিতা-মাতার প্রতি এক ধরণের শক্তিশালী বন্ধন অনুভব করা। ২. Sexual Imprinting: শৈশবকালে যে ধরণের অভিজ্ঞতা হয় তারই প্রতিফলন ঘটে বড় হয়ে আমাদের যৌনতার ইচ্ছা কেমন হবে বা কেমন ব্যক্তির প্রতি আমরা আগ্রহী হবো। এই ধরণের ইমপ্রিন্টিং সাধারণত ‘Westermarck Effect’ কে প্রকাশিত করে। ৩. Limbic Imprinting: সহজভাবে বলতে গেলে, লিম্বিক ইমপ্রিন্টিং হলো গর্ভাবস্থায় এবং জন্মের পরপরই আমাদের অভিজ্ঞতাগুলি কীভাবে আমাদের মস্তিষ্কের লিম্বিক সিস্টেমকে প্রভাবিত করে। লিম্বিক সিস্টেম হলো মস্তিষ্কের একটি অংশ যা আমাদের আবেগ, স্মৃতি এবং বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় আচরণগুলি নিয়ন্ত্রণ করে। যদি গর্ভাবস্থায় বা জন্মের পরপরই এই সিস্টেমে কোনো সমস্যা হয়, তাহলে তা আমাদের জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে আবেগ এবং আচরণগত সমস্যার কারণ হতে পারে। এটি বোঝায় যে, আমাদের প্রাথমিক অভিজ্ঞতাগুলি আমাদের ভবিষ্যতের আবেগগত এবং আচরণগত স্বাস্থ্যের উপর বড় প্রভাব ফেলতে পারে।
উদাহরণ
আমরা বড় হয়ে যার প্রতি যৌনতায় আগ্রহী হই, খুব স্বাভাবিক আমরা তার সাথে নরম ও ভদ্রভাবে কথা বলবো। কারণ আমরা ছোটবেলায় শিখেছিলাম বা অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলাম যে আপনার বিপরীত লিঙ্গের প্রতি শ্রদ্ধা থাকা জরুরী। আর যারা উল্টোপাল্টা আচরণ করেন? তাহলে বুঝে নিতে হবে সে বা তিনি ছোটবেলায় ঠিক কি কি শিখেছেন! অন্তত মনোবিজ্ঞান এখানে সেটাই বলার চেষ্টা করছে। মনোবিজ্ঞান এখানে আরো বলছে, হয়তো সেখানে ভালো জিনিস ছিলো অনুলিপি করার কিন্তু এই ধরণের নারী/পুরুষ অনুলিপি করেছেন খারাপ কিছু।
সংযুক্তি তত্ত্বের কৌশল
সংযুক্তি তত্ত্ব দিয়ে মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য বিভিন্ন কৌশল ব্যবহার করা হয়। এই কৌশলগুলোকে সাধারণত নিম্নলিখিত ৫টি ভাগে ভাগ করা যায়:
১. নির্ভরশীল করা: একজন ব্যক্তিকে অন্যের উপর নির্ভরশীল করে তোলা। যেমন, কারো কাছে বলা যে, “তুমি ছাড়া আমি কিছুই করতে পারবো না।” এতে সেই ব্যক্তি নিজের সিদ্ধান্ত নিতে পারার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলতে পারে। ২. আবেগ নিয়ন্ত্রণ করা: কারো আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করা। যেমন, প্রথমে কাউকে খুব ভালোবাসা দেখানো, তারপর হঠাৎ করে অবহেলা করা। এতে সেই ব্যক্তি সবসময় অনিশ্চিত থাকে এবং নিয়ন্ত্রকের প্রতি আকৃষ্ট থাকে। ৩. আচরণ নিয়ন্ত্রণ করা: কারো আচরণকে পরিবর্তন করা। যেমন, কাউকে এমন কাজ করতে বাধ্য করা যা সে নিজে করতে চায় না। ৪. আত্মসম্মান কমিয়ে দেওয়া: কারো আত্মসম্মান কমিয়ে দেওয়া। যেমন, কাউকে বারবার বলা যে, “তুমি কিছুই করতে পারো না।” এতে সেই ব্যক্তি নিজের উপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলতে পারে। ৫. আবেগগত অস্থিরতা তৈরি করা: কারো আবেগকে অস্থির করে তোলা। যেমন, এক মুহূর্তে ভালোবাসা দেখানো, আবার অন্য মুহূর্তে রাগ দেখানো। এতে সেই ব্যক্তি মানসিকভাবে বিভ্রান্ত হয়ে পড়তে পারে।
কেন এই কৌশলগুলো ব্যবহার করা হয়?
১. অন্যকে নিজের উপর নির্ভরশীল করার জন্য যাতে অন্য ব্যক্তি নিজের সিদ্ধান্ত নিতে না পারে। ২. সম্পর্ককে নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য যাতে অন্য ব্যক্তি সম্পর্ক ছেড়ে যেতে না পারে। ৩. নিজের অবস্থান শক্তিশালী করার জন্য যাতে অন্য ব্যক্তি নিজের চেয়ে দুর্বল মনে করে।
উপসংহার
সংযুক্তি তত্ত্ব এবং ইমপ্রিন্টিং আমাদের জীবনের বিভিন্ন দিককে প্রভাবিত করে। আমাদের শৈশবের অভিজ্ঞতাগুলি আমাদের ভবিষ্যতের আচরণ এবং আবেগগত স্বাস্থ্যের উপর গভীর প্রভাব ফেলে। সঠিক পরিবেশ এবং ইতিবাচক অভিজ্ঞতা একজন ব্যক্তির মেধা এবং মানসিক বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
Discover more from অভিযাত্রী
Subscribe to get the latest posts sent to your email.