সম্পাদকীয়

‘কেন?’ প্রশ্নের অত্যাচার: আমাদের কি সবকিছুর ব্যাখ্যা দিতে হবে?

বিজ্ঞাপন

উদ্দেশ্যবিহীন কোন কাজ ভালো ফলাফল এনে দিতে পারে না। আবার আমরা সবকিছুই উদ্দেশ্য রেখেই করবো; তাও নয়। কিছু কাজ আমাদের এমনিতেই করতে ভালো লাগে, কিছু কাজ করতে আমরা বিনোদন পাই, কিছু কাজ আমরা কেন করি সেটা আমরা নিজেরাও জানি না। আমার মতে, জরুরী নয় আপনি সবসময় আপনার সকল কাজের ব্যাখ্যা খুঁজে বেড়াবেন। অথবা, আপনার সকল কাজের ব্যাখ্যা দিয়ে লিফলেট বিতরণ করবেন।

একইভাবে আমরা কথা বলার সময় সবসময় তো আর হিসাব-নিকাশ করে কথা বলি না। কিন্তু যখন চিন্তাযুক্ত কাজ বা কথা থাকে এবং সেখানেও অনর্থক কিছু করা বা বলা হয় সেটা সোজা বেয়াদবির পর্যায়ে পড়ে। আমি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে কিছু মানুষকে এই অভ্যেস ছাড়ার জন্য অনুরোধ করবো।

গড়ে একজন মধ্যবয়সী/বৃদ্ধ মানুষ পত্রিকা বেশি পড়ে থাকেন কিন্তু সমসাময়িক যে গভীর সমস্যা বা চারদিকে যে যুদ্ধগুলো চলছে সেটা জেনে তিনি কি করবেন? যার কিনা পরিবার অর্থ সংকটে, নিজে অসুস্থ! অবশ্য এসব পড়ে যদি ভালো লাগে বা বিনোদন পান তাহলে ব্যাপারটা নায্য হলে হতেও পারে। আচ্ছা, চায়ের দোকানে ভূ-রাজনৈতিক সমস্যা নিয়ে আলাপ দেখে আপনার হাসি পায় না? না-কি অতি মুগ্ধ হয়ে আপনি ঐ আলাপে যুক্ত হোন?

সেলুনে দেশের মন্ত্রী কে হবেন সেটা নিয়ে আলাপ তো হয়-ই কিন্তু ভোটের আগে উপসংহারে পৌঁছানোর যে ব্যাপারটা! চুলের বদলে আবার নাক কাটা না পড়ুক। হরহামেশাই আপনার চলার রাস্তার সামনে এসে অনাকাঙ্খিত চাচা/কাকা কিছু অপ্রয়োজনীয় প্রশ্ন করেন? কিন্তু কেন করেন? তার তাতে লাভ কি? তিনি হয়তো বাংলাদেশের শার্লক হোমস্ হবার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

কেন জানিনা মনে হয়, এই পৃথিবীতে আমরা সবাই অন্যের জন্য আদর্শ বিচারক এবং নিজের জন্য আস্তবড় কালো কোট পরা ন্যায়ের উকিল। চা-সেলুনের বাইরের দুনিয়া তো আরো বেশি জটিল। আপনি ঘমার্ক্ত হয়ে কোথাও বসেছেন, তৃষ্ণা পেয়েছে ভীষণ। হঠাৎ অনাকাঙ্খিত চাচা/কাকা এসে বলতে পারেন, “আপনি এখানে বসেছেন কেন? আপনি একটু এগিয়ে গিয়ে পাশের চেয়ারে পারলে বসুন!” কন্ঠে তার খুব রাগ কিন্তু যুক্তি দিয়ে ভেবে দেখবেন তার কাছে এই যুক্তির পেছনে কোন যুক্তি নাই।

বিজ্ঞাপন

ফুল সুগন্ধ ছড়ায় কিন্তু এটা তার গুণ নয়। ফুল এমনই… ওর কাছে থেকে সুগন্ধি পাওয়া যায়। ওটা ফুল আমাদের দান করে না, ওটা ফুলের সহজাত প্রবৃত্তি। ঠিক তেমনি বেকার লোকের সাথে একটু বসে আলাপ জমাবেন, দেখবেন তার কাছে হাজারো/লাখো দুর্দান্ত আইডিয়া আছে। আপনি সেসব শুনে ‘হা’ হয়ে যাবেন। কিন্তু মোটের উপর সে এক পয়সাও রোজগার করে না। কিন্তু আমরা তাকে লজ্জায় প্রশ্ন করি না যে, “এই আইডিয়াগুলো নিজ জীবনে প্রতিস্থাপন কেন করতে পারছেন না?”

আমরা আমাদের ব্যক্তি কম মানুষকে নিয়ে পিএনপিসি করতে পছন্দ করি। অন্যদের নিয়ে সমালোচনা করতে আমার ও আমাদের খুব মজা লাগে। আর যদি গালি দেবার প্রসঙ্গে বলি তো সেটা আমাদের অতি প্রিয় বিষয়। কিন্তু ঠাহর হয়ে একবিন্দু সময়ও কি নিজেকে নিয়ে আমরা ভাবি?

আমরা অন্যের কাছে তার ক্রিয়ার ব্যাখ্যা চাই। কারণ আমরা কৌতুহলী, আমাদের তার উপর অধিকার আছে বলে চালিয়ে দেই। কিন্তু নিজের ক্রিয়ারই ব্যাখ্যা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আমাদের কাছে থাকে না। অন্যের ব্যাপারে আগ্রহ থাকা মানে প্রতিক্রিয়াশীল হওয়া নয় কখনো কখনো অনেক যত্নের। কিন্তু অতি যত্ন বা অতি ভক্তি কাউকে সংশয়ে ফেলতেও তো পারে।

আপনারা যারা এখনো এই পর্যায়ের নন, এই ক্লাসে পড়েন না অন্তত আপনাদের অন্যকে নিজের কাজের ব্যাখ্যা দেওয়াটা বন্ধ করা উচিত। কারণ আপনি ব্যবসা করলে অনাকাঙ্খিত চাচা/কাকা এসে বলবেন, “তাহলে সরকারী চাকুরী হলো না?” আর সরকারী চাকুরী করলে এই অনাকাঙ্খিত চাচা/কাকা উল্টো টা বলবেন। আবার সময়মত বিয়ে না করলে এরা যেচে বিয়ে দিয়ে দেবেন। এখন বাচ্চা হলে সেসবের জন্য ক্যালকুলেটর নিয়ে খরচের হিসাব-নিকাশ কিন্তু করবেন না। আবার বিয়ের বয়েস পার হলে ছেলেদের শারীরিক সমস্যা আর মেয়েদের চারিত্রিক দোষ বলে গুজব ছড়াবেন।

আপনি যা কিছুই করবেন সেখানে এই সমস্ত অনাকাঙ্খিত চাচা/কাকাদের আপত্তি থাকবেই। এদের বয়সও বাড়বে পাশাপাশি এদের আজব-আজব সব কান্ডও বাড়তেই থাকবে। দু-পয়সা দিয়ে জীবনে আপনাকে সাহায্য না করলেও চার-পয়সার ক্ষতি করতে এরা পারদর্শী। আমার নিজের চোখে দেখা। এদের সম্মান দিয়ে যে সালাম/আদাব দিয়ে থাকেন এঁরা কি অদৌ তার যোগ্য? এঁরাই কি সেই সো-কল্ড ‘মুরুব্বী’? আচ্ছা, মানলাম কিন্তু মুরুব্বীদের সংজ্ঞা কি? কারণ, এরা বয়সে বড়? আদতে এঁরা কারা? আপনার ব্যক্তি জীবনে, আপনার পরিবারে যার কোন ভূমিকাই নাই উল্টো বহু ক্ষতি করেছে! তাও সম্মান জানাতে হবে? যদি এটাই হয় সামাজিক হওয়া হয় তাহলে সেই সমাজের মুখে থু!

বিজ্ঞাপন

আমাদের একটু ‘Solitude’ এ থাকতে দিন, একটু সৃজনশীল হই। নিজেকে নিয়ে কাজ করি, নিজেকে নিয়ে একটু কথা বলি, নিজেকে নিয়ে একটু ভাবি। সর্বোপরি, নিজের ভুলগুলো শোধরানো তো জরুরী। আর এই চেষ্টার পরেও আমরা যদি কিছুই করতে না পারি তো কি-বা এসে যায়! “চেষ্টা তো কম করি নাই” – এটা বলে একদিন পৃথিবী থেকে বিদায় নেবো।


Discover more from অভিযাত্রী

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন

মেহেদি হাসান (বিকেল)

প্রধান সম্পাদক, অভিযাত্রী

আপনার মতামত জানান?

বিজ্ঞাপন
Back to top button

Discover more from অভিযাত্রী

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading