বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান: চিন্তা নিয়ন্ত্রণ নাকি জ্ঞানের কারাগার?

বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো অনেক সময় এমন এক পরিবেশ তৈরি করে থাকে যা শিক্ষার্থীদের মধ্যে নির্দিষ্ট চিন্তাধারা বা মতামত গড়ে তুলতে পারে। এই প্রক্রিয়াটি কখনও কখনও ‘থট্ পুলিশ’ হিসেবে বর্ণিত হয়, যা বিভিন্ন ধরণের চিন্তার প্রসার বা বিকাশে বাধা দেয়। এই ধরণের প্রতিষ্ঠান শিক্ষার্থীদের এক ধরণের চিন্তার পেনিট্রেশনের মাধ্যমে নার্কোটাইজ করে তুলতে পারে, যা তাদের মুক্ত চিন্তা ও সৃজনশীলতাকে বাধাগ্রস্ত করে।

আমি জানি এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ অভিযোগ, এবং এই বিষয়ে আলোচনা করা জরুরি। বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা যদিও বৈশ্বিক র‍্যাংকিংয়ে পিছিয়ে আছে, গবেষণায় পেছনে পড়েছে, এবং কর্মমুখী শিক্ষা বিস্তারে সফল হতে পারেনি, তবুও আরও বড় উদ্বেগের বিষয় হলো শিক্ষার্থীদের মনে এক ধরণের নেশা তৈরি করা, যা তাদের চিন্তাভাবনাকে সীমিত করে দেয়। আমার আজকের প্রবন্ধে আমি এই সমস্যার উপসর্গগুলো একে একে তুলে ধরবো এবং ব্যাখ্যা করবো যে কিভাবে এই প্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষার্থীদের মনে একটি সীমিত চিন্তার প্রক্রিয়া তৈরি করে।

‘ক’ বিশ্ববিদ্যালয় নামক এই রুপক প্রতিষ্ঠানটি যদি আমাদের সত্যিই নার্কোটাইজ করে তোলে, মানে চিন্তার দিক থেকে তাহলে আমরা সেটা বুঝবো কি করে? আমি ধরে নিচ্ছি, ‘ক’ নামক বিশ্ববিদ্যালয় যে বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের চিন্তা এবং সৃজনশীলতার জায়গা ক্রমশ ছোট করে, আমাদের বিদ্যা আমাদের জন্য আশীর্বাদ হয়ে উঠে না বরং অভিশাপ হয়ে উঠে।

উপসর্গ সমূহ

১. শিক্ষাগত কঠোরতার অভাব (Lack of Academic Rigor)

এটি দুঃখজনক যে ‘ক’ নামক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়লেও ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত ঠিক নেই। নতুন নতুন বিষয় যোগ হলেও তা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অর্থহীন। ‘ক’ বিশ্ববিদ্যালয় চিন্তার সাথে যোগাযোগ রাখে না, জটিল বিষয়ে চিন্তা করার প্রবণতা তৈরি করে না। শিক্ষার্থীদের এত বেশি কাজে ব্যস্ত রাখা হয় যে তারা কি শিখছে তা নিয়ে চিন্তা করার সময় পায় না। এতে তাদের সমালোচনামূলক চিন্তা প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়। কর্তৃপক্ষের ভয়াবহতা এমন যে শিক্ষার্থীরা প্রশ্ন করার সাহস হারায়, এবং তাদের আত্মবিশ্বাসে ধ্বস নামে।

২. মত প্রকাশের সীমাবদ্ধ স্বাধীনতা (Restricted Freedom of Expression)

বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল উদ্দেশ্য হল জ্ঞানের প্রসার এবং চিন্তার স্বাধীনতা নিশ্চিত করা। কিন্তু যখন কোন বিশ্ববিদ্যালয় স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মত আচরণ করে, তখন তা শিক্ষার্থীদের মনে ভয় ও সংকোচের অনুভূতি জাগায়। উন্মুক্ত চিন্তা এবং তর্ক-বিতর্ক একটি সুস্থ শিক্ষামূলক পরিবেশের অপরিহার্য অংশ। যদি একটি বিশ্ববিদ্যালয় এই মৌলিক অধিকারগুলোকে হুমকি হিসেবে দেখে, তাহলে তা শিক্ষার্থীদের বৌদ্ধিক বিকাশের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।

এমন বিশ্ববিদ্যালয় যেখানে নতুন ধারণা ও সৃজনশীল চিন্তাভাবনা কে গুরুত্বহীন মনে করা হয় এবং যেখানে প্রতিষ্ঠিত ও গতানুগতিক বিষয়গুলোর বাইরে যাওয়াকে উৎসাহিত করা হয় না, সেখানে বৌদ্ধিক স্বাধীনতা বিপন্ন হয়। এই ধরণের পরিবেশ শিক্ষার্থীদের মধ্যে নতুন আইডিয়া ও চিন্তার বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করে এবং তাদের মানসিক বিকাশের পথে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়। এই ধরণের বিশ্ববিদ্যালয় শুধু নতুন আইডিয়াকেই হেয় করে না, বরং যে ব্যক্তি নতুন আইডিয়া প্রদান করেন, তাকেও হেয় করে।

৩. চিন্তার অভিন্নতা (Uniformity of Thought)

বৈচিত্র্যময় চিন্তাভাবনা এবং সৃজনশীল আলোচনা হলো উচ্চশিক্ষার মূল ভিত্তি। কিন্তু যখন ‘ক’ নামক বিশ্ববিদ্যালয় একক চিন্তাকে প্রাধান্য দেয় এবং নতুন ধারণা বা বৈচিত্র্যপূর্ণ চিন্তাকে ষড়যন্ত্র তত্ত্ব হিসেবে আখ্যা দেয়, তখন তা বৌদ্ধিক স্বাধীনতা ও সৃজনশীলতার পথে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়।

যেমন, শেক্সপিয়রের লেখাগুলো নিয়ে নতুন তত্ত্ব প্রদান করা একটি শিক্ষার্থীর জন্য উচিত এবং প্রশংসনীয় হওয়া উচিত। কিন্তু যদি ‘ক’ নামক বিশ্ববিদ্যালয় এই ধরণের চিন্তাকে নাকচ করে দেয় এবং পূর্ণাঙ্গ রিসার্চ পেপার প্রদান করা সত্ত্বেও তা মানতে অস্বীকার করে, তবে তা শিক্ষার্থীর বৌদ্ধিক বিকাশের পথে বড় ধরণের বাধা। এই ধরণের বিশ্ববিদ্যালয় শুধু যে নতুন চিন্তাকে অগ্রাহ্য করে, তা নয়, বরং সেই চিন্তার প্রবক্তাকেও হেয় করে।

সৃজনশীল ডিসিপ্লিনে এই গোঁড়ামি আরও বেশি তীব্র হয়ে উঠে। এই ধরণের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের মধ্যে নতুন চিন্তা ও সৃজনশীলতার বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করে, যা শিক্ষার মূল উদ্দেশ্যকেই বিপন্ন করে।

৪. সীমিত কোর্স অফার করা (Limited Course Offerings)

একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কোর্স অফারিংস তার শিক্ষামূলক মান এবং বৈচিত্র্যের প্রতিফলন করে। যখন ‘ক’ নামক বিশ্ববিদ্যালয় প্রি-ডিফাইনড এবং স্থির কোর্স অফারিংস দিয়ে থাকে, যেখানে শিক্ষার্থীদের কোন ইতিহাস, দর্শন, সাহিত্য, বিজ্ঞান ইত্যাদি জানতে হবে, কোন বিষয় পড়তে হবে, এবং কোন জ্ঞান অর্জন করতে হবে তা আগেই নির্ধারিত হয়, তখন তা শিক্ষার্থীদের বৌদ্ধিক বিকাশের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই ধরণের বৈষম্য বিশেষ করে চোখে পড়ে, যেখানে সিলেবাস এবং কোর্সগুলো কোন বিশেষ শ্রেণীর জন্য নির্ধারিত মনে হয়। এই ধরণের প্রতিষ্ঠানে শুধুমাত্র নির্দিষ্ট কিছু শিক্ষার্থী প্রশংসিত হয় এবং উপকৃত হয়, যা শিক্ষার সার্বজনীন অধিকারের বিরুদ্ধে। এই বায়াসনেস একটি দূর্বল এবং অসম্পূর্ণ প্রতিষ্ঠানের লক্ষণ, যা শিক্ষার মূল উদ্দেশ্যকে বিপন্ন করে।

৫. গবেষণার সুযোগের অনুপস্থিতি (Absence of Research Opportunities)

গবেষণা হলো উচ্চশিক্ষার এক অপরিহার্য অংশ, যা শিক্ষার্থীদের জ্ঞানের সীমানা বিস্তার করে এবং নতুন ধারণা ও সমাধানের পথ খোলে। যখন ‘ক’ নামক বিশ্ববিদ্যালয় আগে থেকেই নির্ধারণ করে দেয় কে ভালো শিক্ষার্থী এবং কে গবেষণা করতে পারবে, তখন তা শিক্ষার্থীদের মধ্যে কৌতুহল এবং উদ্ভাবনী চিন্তার প্রসারে বাধা দেয়। এমন একটি প্রক্রিয়া যেখানে CGPA বা মার্কস একমাত্র মাপকাঠি হিসেবে বিবেচিত হয়, তা অনেক সময় গবেষণার মান এবং বৈচিত্র্যকে ক্ষুণ্ণ করে।

বাংলাদেশের বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন মাপকাঠি নিয়ন্ত্রণ বা মেনে চলার প্রবণতা আছে তা গবেষণা সংস্কৃতির বিকাশে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এই ধরণের প্রক্রিয়া শুধু যে গবেষণার সুযোগকে সীমিত করে, তা নয়, বরং শিক্ষার্থীদের মধ্যে নতুন চিন্তা ও উদ্ভাবনী চেষ্টাকেও হতোদ্যম করে।

৬. অপর্যাপ্ত রিসোর্স (Inadequate Resources)

যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলার জন্য প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার অপরিহার্য। যখন ‘ক’ নামক বিশ্ববিদ্যালয় বড় বড় বিল্ডিং তৈরি করে এবং কোটি কোটি টাকা খরচ করে, কিন্তু শিক্ষার্থীদের জন্য আধুনিক প্রযুক্তি বা নতুন শিক্ষার ম্যাটেরিয়াল সরবরাহ করতে অনিচ্ছুক থাকে, তখন তা শিক্ষার মান এবং শিক্ষার্থীদের বৌদ্ধিক বিকাশের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।

এই ধরণের বিশ্ববিদ্যালয় যেখানে কম্পিউটার নিয়ে ক্লাসরুমে যাওয়াকে বেয়াদবি হিসেবে দেখা হয় এবং শিক্ষার্থীদের ক্লাসরুম থেকে বের করে দেওয়া হয়, তা স্বৈরতান্ত্রিক আচরণের পরিচয় দেয়।

৭. অসমর্থমূলক পরিবেশ (Non-supportive Environment)

যে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের মানসিক সমস্যা এবং আর্থ-সামাজিক চ্যালেঞ্জগুলোকে প্রাধান্য দেয় না, সেই ‘ক’ নামক বিশ্ববিদ্যালয় তার শিক্ষার্থীদের সম্পূর্ণ সমর্থন দিচ্ছে না। এই ধরণের পরিবেশ যেখানে ইউনিফর্মিটি ভাঙ্গার জন্য শিক্ষার্থীদের সাথে বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয়, তা শিক্ষার মূল উদ্দেশ্যকে বিপন্ন করে।

এই ‘ক’ নামক বিশ্ববিদ্যালয় যেখানে শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত জীবনকে তার শিক্ষাজীবনের সাথে গুলিয়ে ফেলে এবং ইউনিফর্মিটি না মানার জন্য তাদের এড়িয়ে চলার প্রবণতা তৈরি করে, তা একটি অস্বাস্থ্যকর শিক্ষামূলক পরিবেশের নিদর্শন।

৮. সেকেলে শিক্ষণ পদ্ধতি (Outdated Teaching Method)

‘ক’ নামক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাপদ্ধতি যেখানে মুখস্তবিদ্যা এবং পাঠ্যবইয়ের লাইন হুবহু ক্লাসে পাঠ করাই একমাত্র শিক্ষার মাধ্যম, তা শিক্ষার্থীদের বৌদ্ধিক বিকাশের পথে বাধা। এই ধরণের পদ্ধতি যেখানে ক্রিটিকাল থিংকিং বা ইন্টেলেকচুয়াল গ্রোথ এর কোন জায়গা নেই, তা শিক্ষার মূল উদ্দেশ্যকে বিপন্ন করে।

নতুন বিষয়ে বিশেষ পর্যবেক্ষণ বা উদ্ভাবনের গুরুত্ব না দেওয়া এবং শিল্প বিপ্লবের যুগেও প্রাচীন প্রিজুডিস বহন করা ‘ক’ নামক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাপদ্ধতির অপর্যাপ্ততা দেখায়।

৯. আজীবন শেখার উদ্যোগের অভাব (Lack of Lifelong Learning Initiatives)

যে বিশ্ববিদ্যালয় তার শিক্ষার্থীদের জীবনে এমন কোনো বিশেষ প্রভাব ফেলতে পারে না যা প্রতিষ্ঠান ছাড়ার পরেও কাজে আসে, তা শিক্ষার মূল উদ্দেশ্যকে বিপন্ন করে। এই ‘ক’ নামক বিশ্ববিদ্যালয় যেখানে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলার মতো কোনো পদক্ষেপ নেয় না, তা শিক্ষার্থীদের জীবনে কোনো স্থায়ী মূল্য যোগায় না।

ফরমাল এডুকেশনের বাইরে নতুন কিছু ভাবার অনিচ্ছা এবং শিক্ষার্থীদের জীবনে দীর্ঘমেয়াদি কাজে আসার মতো কোনো পদক্ষেপ না নেওয়া ‘ক’ নামক বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বড় সীমাবদ্ধতা।

১০. সমালোচনামূলক চিন্তা ও সমস্যা সমাধানে অবহেলা (Neglect of Critical Thinking and Problem-Solving)

যদি কোনো প্রতিষ্ঠান সক্রিয়ভাবে সমালোচনামূলক চিন্তা ও সমস্যা সমাধানের দক্ষতা শেখানো এবং উৎসাহিত না করে, তাহলে সেই প্রতিষ্ঠান হয়তো শিক্ষার্থীদেরকে বৌদ্ধিক চ্যালেঞ্জের জন্য প্রস্তুত করছে না।


Discover more from অভিযাত্রী

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

Leave a Reply

Discover more from অভিযাত্রী

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading