ম্যানিপুলেশন (Manipulation) ইন ডার্ক সাইকোলজি (পর্ব – ০৭)
১৯৮৪ সালে প্রকাশিত ড. রবার্ট সিয়ালডিনি এর বই ‘Influence: Science and Practice’ থেকে আমি ৫টি ডার্ক সাইকোলজির ম্যানিপুলেশন টেকনিক খুঁজে পেয়েছি। এই পাঁচ ধরণের ম্যানিপুলেশন আমাদের জীবনে ক্রান্তি এনে দিতে পারে। অর্থবহ এই পাঁচ টেকনিক একই সাথে ভয়ানক এবং এ সম্পর্কে অবগত থাকা নিজ অস্তিত্ব টিকে রাখার জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ।
Disclaimer: This article discusses aspects of psychology and manipulation techniques. The purpose of this article is to raise awareness. Please refrain from using all these techniques for personal gain.
সতর্কতা: এই প্রবন্ধে মনোবিজ্ঞানের অন্ধকার দিকগুলো নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এই প্রবন্ধের উদ্দেশ্য হচ্ছে আপনাকে সচেতন করা। অনুগ্রহ করে এই সমস্ত কৌশল আপনার ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য ব্যবহার করবেন না।
১৯৮৪ সালে প্রকাশিত ড. রবার্ট সিয়ালডিনি এর বই ‘Influence: Science and Practice’ থেকে আমি ৫টি ডার্ক সাইকোলজির ম্যানিপুলেশন টেকনিক খুঁজে পেয়েছি। এই পাঁচ ধরণের ম্যানিপুলেশন আমাদের জীবনে ক্রান্তি এনে দিতে পারে। অর্থবহ এই পাঁচ টেকনিক একই সাথে ভয়ানক এবং এ সম্পর্কে অবগত থাকা নিজ অস্তিত্ব টিকে রাখার জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ।
১. Reciprocation (বিনিময়)
একটি গল্পের সাহায্যে বিষয়টি আরো পরিষ্কার করা যেতে পারে। আমি একদিন ট্রেনে করে বাড়ির দিকে ফিরছিলাম। তখন রমজান মাস এবং আমি রোজা আছি। একসময় ট্রেনে একজন দাড়ি টুপিওয়ালা লোকের উপস্থিতি। তিনি কাছে আসতেই আমাকে দুটো জিনিস দিলেন,
(ক) রমজান মাসে সেহেরি এবং ইফতারের সময়সূচির একটি পেপার
উল্লেখ্য, সেহেরি ও ইফতারের সময়সূচির পাতায় লক্ষ্য করলাম একটি এতিমখানার ছবি এবং নাম। এসব দেখতেই হঠাৎ তিনি একটি রশিদ আমার হাতে ধরিয়ে দিলেন যেখানে ঐ এতিমখানায় ডোনেশন করার কথা উল্লেখ আছে।
আমি কিছুটা ধার্মিক হলেও প্রাকটিসিং মুসলিম নই। আর আমি জানি রমজান মাসে দানের কত ফযিলত আছে। এছাড়াও আমি জানি বাংলাদেশের এতিমখানার অবস্থা সম্পর্কে। ওদের জীবন খুব কাছে থেকে দেখার সময় হয়ে ওঠে নাই। কিন্তু যেটুকু দেখেছি তাতে মনে হয়েছে ওদের প্রতি আমাদের সরকারের সুনজর দেওয়া খুবই জরুরী।
এখন এখানে আমার সাথে কি ঘটছে সেটা কি বুঝতে পারছেন? অথবা, এই রমজান মাসে এতিমখানা বা কওমী মাদ্রাসার নাম নিয়ে যদি আপনাকে একটি রশিদ ধরিয়ে দেওয়া হয় তাহলে আপনি ঠিক কি করবেন? আপনি এদেশের এতিমখানা সম্পর্কেও জানেন, কওমী মাদ্রাসা সম্পর্কেও জানেন; হোক একটু কমবেশি।
আমি তখন নিরেট ছাত্র। পকেটে ওটুকুই থাকতো, যা না থাকলে নয়। বাবা বা দাদুর দেয়া হয়তো যাত্রা পথের ভাড়া আর সাথে কিছু এক্সট্রা। কিন্তু উনাকে ‘না’ বলা মুশকিল হয়ে পড়লো। আবার অন্যদিকে এই এতিমখানা কোথায় আছে তা খুঁজে বের করবার মতন হাতে কোনো উপায় নাই। সুতরাং আমার সাধ্যমতো আমি উনাকে ৫০/১০০ (যতদূর মনে পড়ছে) টাকা দিয়ে দিলাম। খেয়াল করে দেখলাম, আমার বগিতে বসা সবাই কোনো অভিযোগ ছাড়াই ১০০-৫০০ টাকা দিয়ে যাচ্ছেন।
আমি এটি বলার চেষ্টা কোনোভাবেই করছি না যে, এমন এতিমখানা নাই, সবাই রমজান মাসে এমন ভন্ড সেজে এসে আমাদের ধোকা দেয়। না, মোটেই আমি এসব বলার চেষ্টা করছি না। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে এরা ভন্ড। যার কারণে দেখবেন, এই দান-দক্ষিণা অনেক কমে গেছে। কিন্তু উনি যদি সত্যিও এতিমখানার জন্যই এসে থাকেন তাহলে পূর্বেই কিছু বিনিময় আমার সাথে কেন করলেন? যে এতিমখানার নিজের টাকা দরকার সে এতিমখানা বিনিময় করছে কেন? মানে ঐ সময়সূচি এবং ছোট্ট পবিত্র আল-কোরআনের তো কিছু দাম আছে।
তাই কেউ যখন আপনাকে কিছু ফ্রি-তে দেয় তখন তার সাথে লুকায়িত কিছু শর্ত থাকতে পারে। ছোট্ট উপহারের জন্য বড় মূল্য চুকাতে হতে পারে। উনি মানসিকভাবে আমাদের সবার সাথে পরিষ্কার একটি ম্যানিপুলেশন ঘটিয়েছেন। সাম্প্রতিক সময়ে কানাডিয়ান একটি অ্যাপ্লিকেশন এবং ভুল তথ্য দিয়ে লাখ টাকা লোপাট করার মত ভুরিভুরি উদাহরণ এ দেশে যে মিলছে সেসবের মধ্যে এই ধরণের বিনিময় থাকতে পারে।
তাই বলে ‘ফ্রি’ মাত্রই ভুলচুক তাও নয়। আবার আপনার কোন বন্ধু যদি আর্থিক ও মানসিকভাবে আপনার অনেক খেয়াল নেয় তাহলে একসময় ওর খেয়াল রাখাটা আপনার দায়িত্ব বলে মনে হতে পারে। তাই সাবধান থাকুন।
২. To Create The Scarcity (ঘাটতি তৈরি করুন)
তিনি সকল কৃষকদের ডাকলেন এবং স্পষ্ট নির্দেশনা দিলেন যে, এখন থেকে টিউলিপ ফুল উৎপাদন করা যাবে না। শুধুমাত্র রাজার জন্য/নামমাত্র কিছু টিউলিপ ফুল উৎপাদন করা যেতে পারে। এখন তো মূল্যস্ফীতির দরুন বাজার সম্পর্কে সবাই কমবেশি জানেন। পেঁয়াজের আমদানি হুট করে কমে গেলে দাম বেড়ে যায়, তাই না? ঠিক তেমনি সে রাজ্যে টিউলিপ ফুলের দাম এত বেড়ে গেল যে সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে গেল। অনেকটা এরকম হলো যে, ১ টাকার টিউলিপ ফুল ৫০০ টাকায় কে ক্রয় করবে? ফলে টিউলিপ ফুল হয়ে উঠলো একমাত্র রাজার জন্য।
ঠিক তেমনি যারা যারা বড় তারকা আছেন তারা ইছে করেই নিজেদের সবসময় ‘Available’ করেন না। তাদের স্ক্রিন-টাইম/উপস্থিতির একটা মূল্য আছে। যদি তারা সবসময় সবখানে যান তাহলে ঐ মূল্য কি তারা পাবেন? পেলেও কি হ্রাস পেতে পারে না?
একটি মজার প্রবাদ আছে, “সে-ই সবচেয়ে ভালো আত্মীয় যে তার আত্মীয়ের বাড়িতে যাই-ই না।” আপনি যদি আপনার একান্ত কাছের বন্ধুর কাছেও খুব ঘনঘন দেখা করেন, কথা বলেন তাহলে আপনাদের বন্ধুত্ব বেশিদিন টিকতে নাও পারে। কারিনা (পড়ুন ‘করোনা’) ভাইরাসের মধ্যে ডিভোর্স যেভাবে বেড়ে গিয়েছিলো।
৩. Liking (অভিরুচি)
কিন্তু সবকিছুর একটা পর্যায় থাকে। কাউকে আল্লাহ্/ঈশ্বর (নাউজুবিল্লাহ) ভাববেন না। এতে করে এদেশের এক খ্যাত ক্রিকেটার আর্থিকভাবে অনেক মানুষকে ডুবিয়েছেন। নাম বললে চাকুরী নাও থাকতে পারে।
দেখুন কাউকে পছন্দ করা খারাপ কিছু নয়। কিন্তু এটাও নোট করে নেওয়া ভালো যে, ঐ ব্যক্তি একজন মানুষ এবং যেহেতু একজন মানুষ সেহেতু তাঁর দ্বারাও ভুল হতে পারে। তাই ভুল বুঝে আবার মন্তব্যে ‘Dream 11’ এর বিজ্ঞাপনে জড়িত একজন বিখ্যাত ক্রিকেটারের নাম লিখতে যাবেন না! কারণ উনার ফ্যান কিন্তু এদেশেও কম নয়।
৪. Rule of Authority (কর্তৃত্ব)
এটুকু মেনে নেওয়াতে কিছুটা কম ক্ষতি আছে। কিন্তু উমুক বাবা/হুজুর ভালো জানেন মানে পৃথিবীতে আর কোনো ভন্ড বাবা/হুজুর-ই নাই। এই যুক্তিতে সমস্যা আছে এবং এই যুক্তিতেই বহু লোকের ধান্দা আজও চলছে।
উদাহরণস্বরূপ, আমি একই সাথে ওয়েবসাইট এবং গুগল সম্পর্কে জানি। কিছু আয়ের রশিদও আছে। কিন্তু বারবার সিক্স ডিজিট অতিক্রম করবো এবং একদিন হঠাৎ সেভেন ডিজিট হয়ে যাবে এই বিশ্বাস কিছুটা হলেও অপরিণত এবং খুব বেশি বাস্তবসম্মত নয়।
কিন্তু যিনি জানেন-ই না তিনি যদি একই ব্যবসা খুলে বসেন তবে সিক্স ডিজিট তো অনেক দূর! থ্রি ডিজিট কি অতিক্রম করতে পারবেন? ফের, যিনি সিক্স ডিজিট অতিক্রম করতে পেরেছেন তাকেও হরহামেশাই বিশ্বাস করা যাবে না। তারও ভুল হতে পারে। এবং ভয়ংকর ভুল হতে পারে।
সুতরাং অথোরিটি আপনাকে দিয়ে কাজ করাচ্ছে বা কিছু গুলিয়ে খাওয়াচ্ছে তখন সেই অথোরিটি কি সত্যিকার অর্থেই সঠিক অথোরিটি? নাকি ভন্ড? এটি বুঝার জন্য আপনার ‘Intuition (স্বজ্ঞা)’ ব্যবহার করুন। সত্যকারের অথোরিটির কাছে থাকলেই বুঝতে পারবেন, ইংরেজিতে ‘ভাইব’ পাবেন।
৫. Social Proof (সামাজিক স্বীকৃতি)
এখন আমি যদি তাকে জানাই, রিয়া আমাকে আজ এটা বললো! টিনা আমার সাথে দেখা করতে চায়, এজন্য সে খুবই অস্থির হয়ে আছে। আর মিনা! সে তো সেদিন রেস্টুরেন্টে আমার সাথে ডিনার করলো।
মেয়েটা এক মিনিটের জন্য ভাববে, এর কাছে এমন কি আছে? সত্যিই তো রিয়া-টিনা-মিনা সবাই একে সময় দেয়। সুতরাং আমার কাছে সোশ্যাল প্রুফ আছে যে, আমি মেয়েদের জন্য নিরাপদ। শুধু নিরাপদ-ই নয়, জীবনসঙ্গী হিসেবেও দারুণ হবো। ইতোমধ্যেই এত এত মেয়ে আমার জন্য পাগলী!
ফলে খুব ভালো চ্যান্স থাকে যে মেয়েটি আপনার কথায় পটে যাবে। সামাজিক স্বীকৃতি নিয়ে খুব লঘু মানের উদাহরণ টানলেও আশা করি আপনাদের বুঝতে কোনো অসুবিধা হয় নাই।
আপনার প্রতিক্রিয়া কি?